bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



অপির খালা
দিলরুবা শাহানা



আজ বিকালেই ফিরতে পারবো। তিন দিনও থাকতে হলোনা। কাজ শেষ ফিরে যেতে হবে। এখানে নিকট-আত্মীয় কেউ নাই যে আদর করে বলতে পারে ‘আরও দুইদিন বেড়িয়ে যা’। স্থানীয় দু’একজন বললেন -

‘পাঁচটার বাসের টিকিট পেলে রাত নয়টায় আপনাদের শহরে পৌঁছতে পারবেন’
আরেকজন বললেন -

‘তবে দেরী করে ফেলেছেন ঐ বাসের টিকিট সকালে কিনতে হয়’

‘তাইলে এখন কি করা যায়’

‘উত্তরের বাসে যেতে পারেন, ছাড়বে রাত দশটায় আপনার শহর ছুঁয়ে একদম উত্তরে চলে যাবে ড্রাইভারকে বলে রাখলেই আপনাদের ঐ শহরে নামিয়ে দেবে’

‘কখন নামবো আমরা’



‘রাতের বাস সাবধানে ধীরেসুস্থে চালায় তো তা মনে করেন চার ঘণ্টার বদলে সাড়ে চার বা পাঁচ ঘণ্টা লাগবে’

‘তার মানে রাত তিনটা নাগাদ আমাদের শহরে পৌঁছাতে পারবো, কথা হল নামাবে কোথায়?’

আমাদের মাঝে একজন উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন -

‘টার্মিনালে নামিয়ে দিতে পারবে কি?’

স্থানীয় একজন উত্তর দিলেন।

‘শহরের ভিতরে এই বাস ঢুকবেই না, পাশ দিয়ে চলে যাবে’

আমরা তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। স্থানীয়রা বললেন

‘কোন অসুবিধা হবেনা আপনারা বলবেন মেহেন্দীবাগ নাকি বনগ্রাম নামবেন সেইমত বাস চট করে থেমে আপনাদের নামাবে’

‘কথা হল কোথায় নামলে আমাদের বাসার কাছে হবে?’

এখানের একজন অসহিষ্ণু স্বরে বললেন -

‘আমরাতো ঐ শহরের গলিগুজি চিনি না আপনারাই ভাল বুঝবেন কোথায় নামলে ঠিক হবে’

অন্য আরেক জন বললেন - ‘ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বললে ও বুঝেশুনে আপনাদের সুবিধা হয় এমন জায়গায় নামাবে’

অন্যজন বললেন - ‘ভালোকথা টিকিট পুরো দামে কিনতে হবে, আধা রাস্তায় নেমে যাবেন বলে আধা দাম দেওয়া চলবে না’

আমাদের কাছে রাতে যেতে পারাটাই ভাগ্য বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া এখানের কেউ আর থাকার কথাও বলছেনা, আমরাও নিজেদের বিলাসী টয়লেট-বাথরুমের স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার জন্য মনে মনে উদ্বেল হয়ে পড়েছি। কাজ শেষ তো আর এখানে থাকার দরকার কি। তিনজন মেয়ের পক্ষে রাতে যাওয়া সাহসের কাজ বলা যায়। বাসে যাওয়াতো আরও দুঃসাহসিক অভিযান।

আমরা যাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি; না কথাটা ঠিক বলা হলোনা। বলতে হবে যাদের আতিথ্য জোর করে আদায় করেছি তারা হলেন, ঐ যে কথায় বলে না ‘গাছ তলায় বিয়ালো গাই সে সম্পর্কে মামাতো ভাই’। আসল কথাটা বলি এরা হচ্ছেন আমাদের সঙ্গিনী বান্ধবীর ফুপাতো বোনের জায়ের মামাতো ভাই। আমরা একটি পুরানো তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এমন আত্মীয়-বান্ধব হীন সম্পূর্ণ অপরিচিত এলাকায় এসে হাজির হয়েছি। যাদের কাছে ছিলাম এরা সচ্ছল নন তবে অসাধারণ সজ্জন। আমরা তিন ভিটার তিন ঘরে ছিলাম। একটা ঘর অতিথিদের জন্য দেওয়া সম্ভব ছিল না। এদের মা ও মেয়েদের সাথে মিলেমিশে শীতের রাত আন্তরিক আমেজে কেটেছে। শহরের রুক্ষতা নেই। পাড়াপড়শির সহমর্মীতা, সহযোগিতা মনে রাখার মত। সকালে উঠানের শিউলি তলায় বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চিতে বসে একদিন কারো বাড়ি থেকে আসা খেজুর রসের পায়েসে মুড়ি ঢেলে নাস্তা করেছি। আরেকদিন অন্য কেউ পাঠিয়েছেন মুড়ি, পিয়াজু, বেগুনী তাই ঝরে পড়া শিউলি আচ্ছাদিত উঠানে বসে খেয়েছি। গ্রাম ঘেঁষা মফস্বল শহর। ফেব্রুয়ারি মাস। শীত একটু যেন বেশীই এখানে। আরও একরাত থাকা মানে অতিথি ও আপ্যায়নকারী দুই পক্ষেরই জন্যই অস্বস্তিকর।

রাতেই রওয়ানা দিলাম। খুব আয়েসি মাইক্রোবাস। দেখা গেল পনেরো ষোলজন যাত্রীর মাঝে পাঁচসাত জনই মাঝ পথে নেমে যাবে। বাসে সুন্দর লাগেজ ক্যারিয়ার আছে। শীত লাগবে ভেবে লাগেজ থেকে বের করে শালটা হাতব্যাগে ঢুকালাম। বাসে উঠার আগেই ঠাণ্ডা বোধ হল। শালটা তাড়াতাড়ি বের করতে গিয়ে ওয়ালেট, নোটবুক টুকটাক কি সব ছিটকে পড়লো। অতো কম আলোতে খুঁজে নিতে ঝামেলা হল একটু। সব তুলেছি কিনা বুঝলাম না।

আমি ড্রাইভারের পিছনের আসনে বসলাম। উদ্দেশ্য ড্রাইভারের উপর চোখ রাখা। যদি সে ঘুমে ঢুলুঢুলু হয় তবে সবাই পরপাড়ে পৌঁছে যাব অবশ্যই। বিরক্তি লাগলো অন্ধকার রাতে কিম্ভুত এক জিনিস দেখে। জিনিসটা হল ক্যাপ। এই রাতের বেলাতে ড্রাইভারকে খয়েরী রঙা ক্যাপ পরা দেখে। ক্যাপটা এমন ভাবে কপালে নামানো তাতে তার চোখ দিনেও দেখা যেতো কি না সন্দেহ। তবে লাগেজ ক্যারিয়ারে মালপত্র ছুড়ে ছুড়ে সে ফেললো না। ধীরেসুস্থে গুছিয়ে রাখলো। একটু বেশী মাত্রায় ধীর যেন। নম্র-ভাষী, ক্ষণিক চলাফেরায়ও তার ভদ্র আচরণ দর্শনীয়। বিরক্তি আপনাআপনি উবে গেল।

অন্ধকারে সাতরে বাস চলতে শুরু করলো। শহরের রাস্তা ছাড়ালো। হাইওয়ের দু'পাশে ক্ষেতখামার। মাঝে মাঝে রাস্তার দু'পাশেই গাছের সারি দাঁড়ানো। এক পাশের ডালপালা অন্য পাশের গাছের ডালপাতাকে ছুঁয়ে আছে। বাস চলছে পাতা ছাওয়া পথ কেটে। পুরো রাস্তাটা এমন হলে অপূর্ব হতো। কখনো বা জোনাকি পোকা অন্ধকার চিড়ে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা রহস্যময় তবে ভয় জাগানিয়া নয় মোটেও। ঘোর লেগে যায় অন্ধকার দেখতে দেখতে।

ড্রাইভারের তন্দ্রা পায় কিনা দেখবো বলে সামনের সীটে বসেছিলাম। কপালের এমনি ফের নিজের চোখ কখন ঘুমে জড়িয়ে গেছে বুঝিনি। হঠাৎ ঘুমঘুম চোখ কষ্টে মেললাম। প্রথম বুঝতেই পারিনি কোথায় রয়েছি। ধাতস্থ হয়ে সামনে তাকালাম। ক্যাপওয়ালা গাড়ী চালাচ্ছে আপন মনে। ঘুম তার ধারকাছ ঘেষতে পারে নি। জানলা দিয়ে সামনের পথে চোখ রাখলাম। বেশ দূরে আলোকময় বড়সড় এক স্থাপনা। এরকম কিছু চলার পথে দেখা যাবে কেউ তো বলে নি। পিছনে তাকালাম। একি কাণ্ড! লোকজন কোথায় উধাও হয়ে গেল? অল্প ক'জন মাত্র রয়েছে। আমার সঙ্গিনীরাও কখন নেমে গেছে টেরই পাইনি। আমি ঘুরে ড্রাইভারকে নিচু তবে দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করলাম

‘বনগ্রামে আমাকে নামান নি কেন?’

‘গাড়ী থামলো সবাই হুড়মুড় করে নেমে গেছেন, আপনিও নেমেছেন ভেবেছি। আপনার লাগেজ তো নামিয়ে দিয়েছি।’

আমার স্নায়ু স্তব্ধ, মাথা চিন্তা রহিত। কথা বলারও শক্তি নাই। অন্ধকার কমে ভোর আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমরা আলোর স্থাপনার দিকে ছুটছি।

ড্রাইভার নম্র অথচ পরিষ্কার গলায় বললো - ‘টার্মিনালে গিয়ে ফিরতি বাসের টিকিট কিনে আপনার শহরে কাল সকাল এগারোটার মাঝে পৌঁছে যেতে পারবেন’

‘কেন এই বাস যাবে না?’

‘জি না’।

হাতব্যাগ হাতড়ে দেখি আমার ওয়ালেট নাই। তারমানে টিকিট কেনার পয়সাও নাই। তারচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল ওয়ালেটের মাঝে ছোট্ট চিরকুটে সবার ফোন নাম্বার লিখা ছিল। আমি এখন অর্থ-কড়িহীন, যোগাযোগের সুযোগ বিহীন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ।

ভোরের বেলা বাস এসে থামলো ঐ আলোকময় ইমারতের তিনতলায়। এটিই বাস টার্মিনাল। প্রত্যন্ত এলাকায় ঝমকালো টার্মিনাল। ড্রাইভার নামতেই দু'টি ছেলেমেয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। শুকনা-পাতলা তবে লম্বা, দু'জনের চোখেই চশমা এবং দু'জনই সাদা এ্যাপ্রোন পরা। ছেলেটি গৌরবর্ণ, মেয়েটি ফর্সা নয় আবার কালো নয় তবে পাকা গমের মত সোনালীঘেষা বাদামী গায়ের রং তার।

মেয়েটি ড্রাইভারের দিকে এক টুকরা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো - ‘সুখেনদা এই পেমেন্ট রিসিট। আপনি কাল পরশু যেদিন যান যাবেন। আপনার রক্ত দেওয়ার সব আয়োজন করবে ঐ ক্লিনিক।’

ড্রাইভার অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাগজটি নিলো। ওর নেওয়ার মাঝে অতি বিনয় ছিল না। এমন কি মেয়েটির দেওয়ার মাঝেও দয়া বা ঔদ্ধত্য ছিল না। চশমাপরা ফর্সা ছেলেটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো - ‘এইখানে তিনজনের নাম আর ফোন নম্বর আছে। এদেরও আপনার মতো রেয়ার ব্লাড গ্রুপ। বলা আছে। ফোন করে আপনার নাম সুখেন ধর বললেই কেউ না কেউ এসে যাবে আপনাকে রক্ত দিতে’ আমিও নেমে এসে কখন যে এদের পাশে দাঁড়িয়েছি টের পাইনি। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখি ও এই ভোর বেলাতেই কালো সানগ্লাস পরেছে। কি অদ্ভুত কান্দ। আমাকে দেখিয়ে সে ছেলেমেয়ে দু'জনকে বললো -

‘ভাইয়া-আপু আপনারা ইনাকে একতলার টার্মিনাল থেকে আমাদের পরিবহনের ফিরতি বাসে তুলে দেবেন কি?’

‘অবশ্যই তুলে দেব, আপনি নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন।’

‘আপনি আসুন, আপনার লাগেজ কই’ - ছেলেটি বললো।

আমি ওদের মুখের দিকে তাকালাম। নির্ভর করা যায় এমন সততা ও সহৃদয়তায় ভরা মুখ। আমার ঘুমিয়ে পড়ে ঝামেলা বাঁধানোর গল্প নিঃসংকোচে বলে গেলাম।

হঠাৎ করে মেয়েটি বলে উঠলো - ‘আণ্টি অপি আপনার কি হয়?’

আমার এক জ্ঞাতি বোনের মেয়ের নাম অপি। কিছুদিন আগে কি এক অংক প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পাওয়ার সুবাদে কাগজে, টিভিতে সাক্ষাতকার নিয়েছে ওর। ভাল লাগলো ওর নাম শুনে।

‘আমি ওর খালা,

‘তাইতো আপনার সঙ্গে চেহারার ভীষণ মিল’।

‘তবে আমি বহুদিন ওকে দেখিনি’

ওদের কাছ থেকে জানা হল ড্রাইভার সুখেনের ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে। ভাল হয়ে যাবে ও। কেমো থেরাপির কারণে চুল, ভুরু, চোখের পাপড়ি সব পড়ে গেছে। ভীষণ সৎ, মনোবল সাংঘাতিক। অসুস্থতার মাঝেও মা-বাবা ছোটভাইকে দেখাশুনা করছে, রোজগার করে খাওয়াচ্ছে। সুখেনের মত মানুষদের জন্য একদল মেডিকেল ছাত্র নানা জায়গা থেকে সাহায্য আদায় করে, নিজেরা যতটুকু পারে টাকা-পয়সা, রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করে, এরা সেই দলের দু'জন। ওরা টিকিট কিনে আমাকে বাসে বসিয়ে দিয়ে গেল। ওদের নাম ও ফোন নম্বর চাইলাম। মেয়েটি বললো -

‘পয়সা দিতে চান? না দিতে হবে না। অপির অভিনয় আমরা খুব পছন্দ করি খুব গুণী মেয়ে।’

বাস চলতে শুরু করলো। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম কোন অপির কথা ওরা বলছে। অনেক কথা ভাবছিলাম। ড্রাইভার সুখেনের ক্যাপ, সানগ্লাস পরা দেখে অযথা শঙ্কিত ও বিরক্ত হওয়ার জন্য নিজেই নিজেকে লজ্জা দিলাম।

ফিরে এলাম নিজ শহরে। আমাকে ঘুমে রেখে ওদের নেমে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে রাগ অভিমান করবো কি ঘটনা শুনে গায়ে কাঁটা দিল। তর্কবিতর্কের পর আবার সবাই মিলে হাসলাম। ওরাও ঘুম-চোখে নেমেছে বলে বুঝতেই পারেনি যে আমি নামিনি। তবে তৃতীয় একজন বাস থেকে নেমেছিলেন। ট্যাক্সিতে উঠেও আমারই মতো সামনে বসলেন। ঘুম চোখে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনি। যখন গাছপালা ঘেরা আলোহীন এক রাস্তায় নামার জন্য কড়া গলায় গাড়ী থামাতে বলেন মহিলা তখন ওরা প্রথম বুঝতে পারে ভয়ংকর ভুল কিছু একটা হয়েছে। মহিলা কোন কথার উত্তর না দিয়ে দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে গাছের অন্ধকারে মিলিয়ে যান । ভয় পাওয়ার মত ঘটনা। তারপর ক্যাপ পরা ড্রাইভারের গল্প, মেডিকেল পড়ুয়া সহৃদয় দু'জন মানুষের সাহায্য পাওয়ার গল্প। অপি যে এতো পরিচিত, এমন বিখ্যাত যে অপির খালা বলে ওরা আমাকে যেন বেশীই সমাদর আর সম্মান করলো। এমন কি টিকিটের টাকা ফেরত দেবার জন্য ওদের ঠিকানা চাইলাম তাও দিল না। উল্টো বললো অপি খুব গুণী মেয়ে। শুনে সবাই খুব হাসলো। তখন জানলাম অংক জেতা অপি নয় নাটক করা অপির কথাই মেয়েটি বলেছিল।



দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 12-Jul-2018

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far