এমসিজি'র স্মৃতি ও বাংলাদেশ দিলরুবা শাহানা এমসিজিতে, মানে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, কতবারই তো আসা হয়েছে। এমসিজিতে খেলা মানেই যেন উৎসব। শুধু ক্রিকেট দেখতেই আসা অন্য কিছু নয়। এবারের আসা অন্য রকম। ক্রিকেটই দেখতে আসা তবে এবার যে বাংলাদেশ খেলছে। বিশ্বকাপ খেলছে বাংলাদেশের ছেলেরা। এই প্রথম এমসিজি'র মাঠে ওরা খেলছে। লাল সবুজ দৌড়বে মাঠে, গ্যালারীতে লাল সবুজ পতাকা পত পত করে উড়বে ক্ষণে ক্ষণে, হল্লা চিৎকারে মেতে থাকবে দর্শক, সারি সারি। এ এক যাদুময় মুহূর্ত। পঞ্চাশ-ষাট, একশ'- দু'শো নয় হাজার বাঙ্গালী ছিল, এক হাজার দু'হাজার নয়, হাজার হাজার বাঙ্গালী ছিল। বিস্ময়কর হল বেশীর ভাগেরই পরিধানে লাল-সবুজ জার্সি। ছেলে-মেয়ে, বর-বউ বেশীরভাগই লাল সবুজ জার্সি পড়ে প্রিয় দেশের প্রিয় খেলোয়াড়দের উৎসাহ আর সহমর্মিতা জানাতে ভিড় করেছে। অনেক মা-বাবা তাদের ছোট্ট সোনামণিটির মাথা লাল-সবুজ পতাকার ব্যান্ডেনায় জড়িয়ে দিয়েছেন। ঘোষণা হল ঐদিন এমসিজি চত্বরে ত্রিশ হাজার দর্শক উপস্থিত। ধারনা করা হচ্ছে ওই দর্শকদের মাঝে দশ হাজার দর্শকই ছিলেন বাংলাদেশী। তারা সবাই মেলবোর্ন-বাসী নন, অস্ট্রেলিয়ার নানা জায়গা থেকে এবং পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন অনেকে। এসেছেন এমসিজিতে বাংলাদেশের খেলা দেখতে।
শ্রীলংকার সঙ্গে খেলবে বাংলাদেশ। শ্রীলংকা বিশ্বকাপ জয়ী দল। অভিজ্ঞতা ওদের অনেক। বাংলাদেশ সে তুলনায় নবীন। এমসিজি'র মাঠে শ্রীলংকা নতুন নয়। বাংলাদেশ দলের জন্য এমসিজি'র মাঠ একেবারেই নতুন। তবে এমসিজিতে খেলতে আসা এক সম্মানের ব্যাপার। নব্বই হাজার দর্শক ঠাঁই পায় এমসিজি'র মাঠে। এই বিশাল বড় মাঠে বাউন্ডারি মেরে চার-ছক্কা তোলাও বিরাট কাজ।
আমি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নই, পেশাদার ক্রীড়া-সাংবাদিকও নই। দেখতে ভালবাসি ক্রিকেট ও এই খেলা দেখার ছলেই নানা সময়ে এমসিজি'র নানা আবহ ও উদ্দামতা পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে।
দেখেছি এক সময়ের বিশ্বখ্যাত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ষ্টীভ ওয়ার পকেট থেকে উঁকি দেওয়া তার অলৌকিক লাল রুমাল। কষ্ট পেয়েছি দেখে যখন ফার্স্ট বোলার গ্লেন ম্যাগরা কি অনায়াসে ক্রিকেট লেজেন্ড শচীন তেন্ডুলকারকে আউট করেছে। আর উচ্ছ্বাসে উদ্দাম দর্শকদের মেক্সিকান ওয়েভ তোলার অপূর্ব দৃশ্য। ভিড়ে সব ধরনের মানুষ দেখা যায়। অভব্য, অ-পরিশীলিতদের যেমন দেখা যায়, হাসি-জাগানিয়া চিজদেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মাঠে বসেই দেখেছি হুট করে প্রায় গোল মত হালকা না সাদা না গোলাপি রঙের কিছু একটা এসে পড়লো। অতদূর থেকে বোঝা যায়নি কি ছিল জিনিসটা। পড়ে টিভি নিউজে বললো কেউ একজন কাচা আস্ত মুরগী ছুড়ে মেরেছিল ক্রিকেট মাঠে। আরেকবার দিনের প্রায় শেষে আমাদের সামনের কোন এক সারি থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল একটি মেয়ে। কতো মেয়েই উঠানামা করছে তা বলার মতো তেমন কিছু না। তবে দেখতে নম্র ভদ্র হলেও সেই মেয়ে এক উদ্ভট বেশে নির্লজ্জভাবে হেঁটে চলে গেল । একটু পরেই মেয়েটি যখন কাগজের কাপে দুই কাপ কফি নিয়ে টলোমলো পা সাবধানে ফেলে ফিরছিল তখনি দর্শকদের হতভম্ব দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো। অতঃপর নিম্নাঙ্গে শালীন-শোভন ট্রাউজার্স আর ঊর্ধ্বাঙ্গে শুধুমাত্র ব্রা পরিহিতা নম্র-ভদ্র মেয়েটিকে সিকিউরিটির এক মহিলা সদস্যা এসে শান্তভাবে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। আপদ বিদায় হল!
ভিড়ের মাঝে কিছু কিছু অস্ট্রেলীয়(সবাই নয়) সমর্থকদের আচরণও ভব্যতার ধার ধারেনা। একবার অস্ট্রেলিয়া বনাম ভারতের ক্রিকেট খেলার সময় তেমনি কিছু অস্ট্রেলীয় দর্শকদের আচরণ ছিল অসহনীয় পর্যায়ের কুৎসিত। পরবর্তী সময়ে এই অভব্যতা নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সবই যে খারাপ তা নয় এরমাঝে মজার ঘটনাও ঘটেছে। ভারতীয়রা যখন তাদের খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করার জন্য দর্শক গ্যালারিতে বসে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিল ‘জিতেগা জিতেগা ইন্ডিয়া জিতেগা’। কাছাকাছি বসা অষ্ট্রেলীয়রা কান পেতে কথাগুলো শুনে নিজেরা গলা চড়িয়ে সমান তালে সুর তুললো ‘জিতেগা জিতেগা অস্ট্রেলিয়া জিতেগা’। অষ্ট্রেলীয়রা হয়তো ভেবেছিল ভারতীয়রা খেলাজেতার কোন মন্ত্র আওড়াচ্ছে।
এবারের বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকার খেলায় কোন অসহ্য অভব্য আচরণ সমর্থকদের মাঝে দেখা যায়নি। এক কথায় দর্শকরা ছিলেন মার্জিত ও পরিশীলিত। পতাকা হাতে যার যার দলের জার্সি গায়ে দর্শকরা উৎকণ্ঠা ও আনন্দ নিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন।
খেলার শুরুতেই বাংলাদেশী এক খেলোয়াড় যখন ক্যাচ ড্রপ করলো কষ্টে আমাদের সবারই নিঃশ্বাস প্রায় রুদ্ধ; তখন সামান্য দূরে বসা এক শ্রীলংকান মহিলা আর্তনাদ করে উঠলেন ‘ওহ্ মাই গড! ওহ্ মাই গড! হাউ ক্যান হি ড্রপ দিস ক্যাচ’। কড়া ভাবে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। মন বলেছিল ‘আমাদের ছেলে ক্যাচ ড্রপ করেছে আমরা দেখবো, আমরা বকবো; তুই বলার কে রে’।
যাক খেলায় হারজিত আছে। একজনকে হারতেই হবে। বাংলাদেশ ঐদিন মানে ফেব্রুয়ারির ২৬, ২০১৫, শ্রীলংকার সাথে খারাপ খেলেছিল। কত দোয়া পড়লাম। কাজ হল না। বাংলাদেশ হারলো সেদিন। তারপরও স্বস্তি বাংলাদেশ শ্রীলংকার চেয়েও বেশী ছক্কা তুলেছিল। বাংলাদেশের ছক্কার সাথে সাথে ঐ মহিলাও যখন হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলো। আমি রাগ ভুলে গেলাম। মহিলাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিলাম।
আমাদের লাল-সবুজ টীম এমসিজিতে খেলেছে বলেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা...’ ওই ঐতিহাসিক মাঠে বাজলো।
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|