মাতৃভাষার গৌরব সন্ধান দিলরুবা শাহানা
নিজের মাতৃভাষাকে ভাল না বাসলে নিজের অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করা হয়, আমার আমিত্বকে অসম্মান করা হয়। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্যই পৃথিবীতে একটি দিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নামে নির্ধারিত হয়েছে। সেই দিনটি হল ২১শে ফেব্রুয়ারি। এই দিনেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখেই মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও নাম না জানা আরও অনেকে। তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন মাতৃভাষা তো প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় খুব একটা কাজে লাগেনা তাই তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার আছে কি? তাছাড়া মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা অর্জন ও অর্থকরী উপার্জন করা যায় কি? উত্তর সহজ নয়। শুধু একটা বিষয় আমরা ভেবে দেখতে পারি তা হল আমরা অনেক কিছু ভালবাসি, তাই নয় কি? দরকারে লাগবে, লাভ হবে এসব চিন্তা করে তো মানুষ ভালবাসেনা। মাতৃভাষার জন্য টান বা ভালবাসা লাভ বা দরকার থেকে উৎসারিত নয়। এ ভালবাসার জন্যই ভালবাসা। এখানে কারণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। তারপরও মাতৃভাষা বাংলায় করা কোন কাজ যদি প্রশংসিত হয় আলোড়ন তোলে আমরা গর্ববোধ করি, আত্মসম্মান বেড়ে যায়। এখানে দুটো ঘটনা বর্ণনা করছি যা জানলে মাতৃভাষা বাংলা বলে অহংকার করা যাবে। বাংলাভাষা তুচ্ছ নয়, বাংলায় যিনি লেখেন তিনি অপাংক্তেয় নন, বাংলাভাষার পাঠকরাও সম্মানের দাবীদার।
ঘটনা বর্ণনার আগে কিছু পুরানো তথ্য আবার বলছি যা এই বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করবে, আমাদেরও ভাল লাগবে। সেই কবে কোন এক সময়ে বাংলাভাষায় লিখে একজন নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন তাঁর নাম আমরা সবাই জানি। আজ থেকে এক শ' তিন বছর (১৯১৩ সালে) আগে প্রথম নন-ইউরোপিয়ান প্রথম নন-হোয়াইট নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতৃভাষা বাংলায়ই সাহিত্য-চর্চা করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। বাংলাভাষা একটি ঋদ্ধ ভাষা ও এই ভাষায় অসাধারণ সব ভাবনাচিন্তা লিপিবদ্ধ করা যায় বলেই এই ভাষাতে লিখে নন্দিত হয়েছিলেন কবি। সুতরাং মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে গৌরব করা অবশ্যই যাবে। বাংলাভাষায় লেখা সৃজনশীল কর্ম বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়ে আদৃত হয়েছে এমন অনেক তথ্যও এই ভাষাভাষীদের গর্বিত করে।
এবার বাংলাভাষার পাঠকেরা কেমন তা তুলে ধরছি। বাংলাভাষী পাঠকদের বিষয়ে ভারতের বাঙালি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আশির দশকের শেষে ঢাকায় গিয়ে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের পাঠকেরা বই পড়েন বলেই বাংলাভাষার লেখকেরা টিকে আছেন’। শীর্ষেন্দুর এই ভাষ্য সেই সময়ে ‘যায় যায় দিন’ নামে সাপ্তাহিকীতে উদ্ধৃতি হিসেবে ছাপানো হয়েছে।
বাঙালিরা গল্প, উপন্যাস, কবিতাই শুধু পড়েন তা নয়, আরও নানা বিষয়ে তাদের আগ্রহ লক্ষণীয়। বৈচিত্র্যময় তাদের পাঠ-স্পৃহা। এই বক্তব্যের সপক্ষে একটি প্রমাণ তুলে ধরছি। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আত্মজীবনী বাংলায় অনূদিত হয়। ওই বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব বা কপিরাইট রয়েছে অস্ট্রেলীয় এক পাবলিশারের। তার কাছ থেকে আইনগত অনুমোদন নিয়েই অনুবাদ করা হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বই ‘আমার কৈশোর আমার তারুণ্য’ বাংলাদেশের পাঠকেরা সাদরে গ্রহণ করেন। এর প্রমাণ বইয়ের বিক্রি-বাট্টা ভাল নয়। বাংলাদেশের প্রকাশক ও অনুবাদক দুজনেই খুশী। পরবর্তী সময়ে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে অস্ট্রেলীয় প্রকাশককে তার প্রাপ্যও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে এসে আমার উপর দায়িত্ব পরে অস্ট্রেলীয় ওশেন প্রেসকে তার প্রাপ্য অর্থ পৌঁছে দেয়ার। উল্লেখ্য এই প্রকাশক ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ বিক্রি থেকে ৪০০, ৫০০ হাজার ডলার অর্জন করে থাকে। তারপরেও সুদূর বাংলাদেশ থেকে বাংলা অনুবাদ বই বিক্রির শতেক ডলার পেয়ে যতোনা খুশী প্রকাশক হলেন তার সাথে সাথে বাংলাদেশের পাঠকদের প্রতি বিস্ময় মিশ্রিত শ্রদ্ধা জানালেন। আমাদের বাংলাভাষার পাঠকও নমস্য!
 এবার বলছি অন্য ঘটনা। আমার পরিচিত অস্ট্রেলীয় একজন ইংরেজির শিক্ষক। যিনি সম্ভবতঃ পাঠ্য বিষয় (অর্থাৎ সিলেবাস) নির্বাচন নির্ধারণেও জড়িত। কিছুদিন আগে আমাদের একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। রবিঠাকুরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে, প্রকাশক পেঙ্গুইন পাবলিশার। বইটি হাতে নিয়ে আমার মনে হল আমিতো রবীন্দ্রনাথ বাংলায়ই পড়তে পারি আমাকে কেন ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে। তারপর যখন জানলাম বইটি ভিসিই'র (মাধ্যমিক পরীক্ষা) সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে তখন একইসাথে গর্ব ও আনন্দ হল। আজও রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক আর উনি লিখেছিলেন মায়ের ভাষাতে। এদেশের স্কুল পড়ুয়ারা শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ পড়েছে, ‘ওথেলো’ পড়েছে একদিন তারা পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’র ইংরেজি অনুবাদ Golden Boat. আমার গভীর প্রত্যয় ও আশা মাতৃভাষায়ই মানুষের শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনা ও কল্পনা প্রকাশিত হউক ও হবে।
*প্রবন্ধটির সংক্ষিপ্ত-রূপ মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদ আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ উদযাপন অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|