bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












লায়লা চৌধুরীকে মনে পড়ে
দিলরুবা শাহানা



মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরী
মানুষের যে কোন বিপদ-আপদ অথবা প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো বা যে কোন মানুষের আনন্দে শরীক হওয়ার উদারতা মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরী ও তাঁর জীবন সঙ্গিনী লায়লা চৌধুরীর সহজাত চারিত্রিক গুণ। তাই তরুণ বয়সে একা একা ঘাটে ঘুরে বেড়ানো গা জুড়ে ঘা ছোট্ট মিন্টুকে আগলে নিয়ে এসে পরম মমতায় ধুইয়ে মুছিয়ে ঠাঁই খুঁজে দেওয়ার কাজটি করতে পেরেছিলেন কামরুল ভাইয়ের মত মানুষই। আজ কামরুল চৌধুরীর কথা থাক আজ বলি লায়লা চৌধুরীর কথা। উনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন আজ বছর হয়ে গেল। এখনও ঘুরেফিরে তাঁর কথা আসে আলোচনায়।

কামরুল ভাইয়ের স্ত্রী লায়লা চৌধুরী একজন অসাধারণ মানুষ। তার উপস্থিতি সরবে উচ্চকিত নয়। চলনে বলনে ধীর-স্থির লায়লা ভাবী যেন ‘আলোর পানে প্রাণের চলা’। তাঁর অনেক কথাই বলা যায় তবে লায়লা চৌধুরীকে বোঝার জন্য দু’টি মাত্র ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।

একবার এক ভারতীয় বন্ধুর নিমন্ত্রণে গিয়েছি। ওখানে সমবেতদের মাঝে আমার পরিচিত-জন কম। একটি টেবিল থেকে পরিচিত মুখ অম্বলী মাসীমা ডাকলেন। তার কাছে গিয়েই বসলাম। ওই টেবিলে বসা অন্যরা জানতে চাইলেন আমি ভারতের কোন শহর থেকে এসেছি। মাসীমা হৈহৈ করে উঠলেন -
‘আরে বলছো কি তোমরা? ও আমার বাংলাদেশের মেয়ে’। মাসীমা নিজে বাংলাদেশের মানুষ বিয়ে হয়েছে ভারতে। তবে বাংলাদেশের জন্য আজও তার টান গভীর। ওইদিন ওই টেবিলে বসা সবার মুখে বাংলাদেশীদের হৃদ্যতার গল্প শুনে মনটা ভরে গেল। একজন শুনালেন লায়লা চৌধুরীর এক ঘটনা। ঘটনাটি হল এক তরুণ দম্পতি ভারত থেকে অভিবাসন নিয়ে এসেছে। ভারতের অবস্থাপন্ন শ্রেণীর মানুষ তারা। বিদেশে কষ্ট তাদের বেশীই হচ্ছিল। তরুণটির চাকরি হতে দেরী হচ্ছিল দেখে তার বউ বাচ্চাসহ দেশে ফিরে যায়। তারপর পরই তরুণটির চাকরি হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বউ-বাচ্চাও অস্ট্রেলিয়ায় আসার জন্য প্লেনে উঠে। দুঃখজনক-ভাবে যেদিন মেলবোর্নে ওদের পৌঁছার কথা সেদিনই শাওয়ার করার সময়ে স্ট্রোক করে তরুণটির মৃত্যু হয়। চারপাশে সবাই হতভম্ব। কে নেবে তরুণটির শেষকৃত্যের ভার? কাকে বলা যায় কাজটি করতে? কে মরদেহ দেশে পাঠানোর খরচ বহন করবে? ইত্যাদি প্রশ্ন যখন উঠছে কমিউনিটিতে তখন নাকি লায়লা চৌধুরী শেষকৃত্যের সমস্ত খরচ বহন করার জন্য এগিয়ে আসেন। টেবিলে সবাই বাংলাদেশের মানুষের মন অনেক বড় এসব বলাবলি করছিলেন তখন। ব্যাপারটা বাংলাদেশীর জন্য আনন্দের ও গর্বের। লায়লা চৌধুরীর গভীর ভাল মনটির পরিচয় জানা হল তাও ভিনদেশী ক’জন ব্যক্তির কাছ থেকে এটা কম কথা নয়।

এর পরের ঘটনা হল আমার অভিজ্ঞা জাত। আমার বন্ধু, ছোটবোনের মত এক তরুণী যার নাম পান্না। নিজে ডাক্তার ছিল তাও অতো বড় অসুখ যে শরীরে দানা বেধেছিল বুঝতেই পরেনি। কঠিন সে অসুখ।। অর্থ-বিত্ত, সফল পেশাগত জীবন, চারপাশে সহৃদয় বন্ধুবান্ধব কোনকিছুর কমতি ছিল না ওর। এখন তাকে কষ্টের মাঝে সময় পার করতে হচ্ছিল। আমার মনটা ভীষণ ভীষণ খারাপ। এর মাঝে রোজার মাস শুরু হল। মন খারাপের সেই সময়ে আমি ওর মঙ্গল চেয়ে আল্লাহ কাছে খতমে তাহলিল পড়ার জন্য প্রতিশ্রুত হলাম। শুধু আল্লাহ নন আমার বিবেকের কাছেও আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্ধুটি নিজে চিকিৎসক, অর্থের ওর প্রয়োজন নাই। আল্লাহ পাকের দয়া ও সহায়তা চেয়ে অঞ্জলি পাতলাম। সোয়া লক্ষ বার দোয়াটি পড়তে হবে। এর সাথে দরুদ-শরীফও পড়তে হবে। কঠিন কাজ সন্দেহ নাই। কাকে বলবো আমার সাথে পড়তে? সবাই ব্যস্ত। ওর ঘনিষ্ঠজনেরা যে যার মত করে ওর জন্য দোয়া কালাম পড়ছেন। আমার ইচ্ছা রোজার মাঝেই খতমটি শেষ করার। আমার বিপন্ন, বিষণ্ণ ব্যাকুলতা দেখে আমার কর্মব্যস্ত কন্যা রত্না বললো সেও চেষ্টা করবে কিছু তাজবীহ পড়ে দিতে।

লায়লা চৌধুরী
একদিন নিবেদিত মনে তাজবীহ জপছি তো জপেই যাচ্ছি। ফোন বাজলো। লায়লা ভাবীর ফোন। আমি ভীত ছিলাম ভেবে যে রোজার মাঝে মানত শেষ করতে পারবো কি না। খতখমে তাহলিল পড়ছি শুনে লায়লা ভাবী আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন উনিও এই দোয়ায় শরীক হবেন। আমি প্রতিদিন কত হাজার কে পড়েছি ডায়েরীর পাতায় তারিখ দিয়ে দিয়ে লিখে রাখতাম। লায়লা ভাবী শত ব্যস্ততার মাঝেও পড়ে গিয়েছেন। কয়েক হাজার হলেই আমাকে জানাতেন। আমিও নিষ্ঠার সাথে তাজবীহর হিসাব লিখতাম। এমন কি সাহরীর সময়ও আমি কখনো কখনো লায়লা ভাবীর মেসেজ পেয়ে ডায়েরীতে তাঁর নামের পাশে তাজবীহর হিসাব লিখেছি। করুণাময়ের কৃপায় শবেকদরের(২৭শে রোজা) মাঝেই খতমে তাহলিল পড়া সম্পন্ন হল। কৃতজ্ঞ আল্লাহর কাছে যে লায়লা ভাবীর মতো নিঃস্বার্থ বন্ধুর সহায়তা করেছেন বলেই খতমটি নিয়ত অনুযায়ী সময়মত শেষ করা গিয়েছিল।

লায়লা ভাবী কোভিড পরবর্তী কাশিতে ভুগছিলেন। চেন্নাই গিয়েছিলেন বড় মেয়ে পিয়ার কাছে বেড়াতে।। ওখানে সে ছিল অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভারতে নিয়োজিত বাণিজ্য প্রতিনিধি। লায়লা ভাবীর শরীরটা ওখানে খারাপ করলো। চিকিৎসার কোন কমতি হয়নি তারপরও তাঁকে ধরে রাখা গেল না। তিন সন্তান পিয়া, নূপুর( অস্ট্রেলিয়ার মাষ্টার সেফ জয়ী কিশোয়ার চৌধুরী), সারা ও জীবনসঙ্গী কামরুল চৌধুরীকে রেখে চলে গেলেন কোথায়, কোন অজানায়! তাঁর আসীন জান্নাতুল ফেরদৌসে হউক এই প্রার্থনা করি।

কামরুল চৌধুরী ও লায়লা চৌধুরীর মতো কিছু মানুষ আছেন যারা নিভৃতে নীরবে মানুষকে সাহায্য করেই সুখী ও তৃপ্ত।




দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া





Share on Facebook               Home Page             Published on: 4-Aug-2025

Coming Events: