ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এর এ্যারমিতাজ দিলরুবা শাহানা
গত ৩১শে জুলাই (৩১/৭/২০১৫) থেকে মেলবোর্নে ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে রাশিয়ার এ্যারমিতাজ থেকে আনা অপূর্ব সব শিল্পকর্ম ও সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের কিছু ব্যক্তিগত মূল্যবান ধনদৌলতের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। যদিও ইংরেজিতে লেখা হয় Hermitage তবে মূলভাষা রুশে বলা হয় এ্যারমিতাজ। ক্যাথরিন ছিলেন শিল্প-প্রেমী মানুষ। সম্রাজ্ঞীর সম্পদতো ছিলই আর ছিল তার শিল্পের জন্য আগ্রাসী ক্ষুধা। সম্রাজ্ঞীর এই শিল্প-মগ্নতা ও বহুমূল্যে শিল্পকর্ম সংগ্রহের ব্যাকুলতাকে ক্যাথরিন নিজেই ‘রয়্যাল এ্যাফেয়ার’ বলে অভিহিত করেছেন। খ্যাতিমান শিল্পী দা ভিঞ্চি, রিউবেন, র্যামব্রাণ্ট ও আরও অনেকের শিল্পকর্ম রয়েছে মেলবোর্ন প্রদর্শনীতে।
এই চিত্রকর্মটি ১৭৭৯সালে বিলাত থেকে এ্যারমিতাজের জন্য সংগৃহীত অন্যতম চিত্রকর্ম। পাশে লিখিত ছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (স্কুল অব), এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে এটি স্বয়ং দা ভিঞ্চি'র বা তার কোন সতীর্থ শিক্ষার্থীর অংকিতও হতে পারে। চারশো বছর আগে শিল্পীর মেধা, শ্রম ও ভালবাসা মিশিয়ে ক্যানভাসে আঁকা তৈলচিত্র তার অপূর্ব সৌন্দর্যে দর্শকদের মুগ্ধ করে যাচ্ছে আজও।
মেলবোর্নের আর্ট গ্যালারির আয়োজন বিশাল তবে এ্যারমিতাজের তুলনায় নিতান্তই ছোট্ট এই প্রদর্শনী। ছোট্ট বলার পেছনে কারণ আছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্স বুর্গ (একসময়ের লেনিনগ্রাদ নামের) শহরে অবস্থিত এ্যারমিতাজ যাদুঘরে রয়েছে পৃথিবীর সর্বাধিক সংগ্রহ। বলা হয় কেউ যদি এ্যারমিতাজ যাদুঘরের প্রতিটি শিল্পকর্ম বা দর্শনীয় বস্তু মাত্র এক মিনিট করেও দেখে তবু তার জন্য সময় লাগবে এগারো বছর।
একবার ছাত্রজীবনে এ্যারমিতাজে এস্কারশনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন দলবেঁধে একজন শিক্ষকের নেতৃত্বে একদিনে যতটুকু দেখা সম্ভব ততোটুকু দেখতে গিয়ে পায়ে ব্যথা, চোখ ব্যথা, এবং মাথা তুলে ক্ষণে ক্ষণে ছাতে অংকিত শিল্পকর্ম দেখতে গিয়ে হয়েছিল ঘাড়ে ব্যথা। ছবি তোলা ও লিখনগুলো পড়ার সময় ও সুযোগ কোনটাই হয়নি।
তবে রাজবাড়ীতে সম্রাজ্ঞীর স্বর্ণনির্মিত ডিনার সেট দেখে রাজন্যদের রুচিহীন বৈভব উপভোগের উপর বিতৃষ্ণা জেগেছিল। এবার যখন মেলবোর্নে ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের এ্যারমিতাজের প্রদর্শনীর খবর টিভি নিউজে পরিবেশিত হচ্ছিল বলা হল এই প্রদর্শনীতে শিল্পকর্মের পাশাপাশি দর্শকদের জন্য রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট বা রুশ ভাষায় বলা যায় ভিলিকাইয়া ইয়েকাতেরিনা'র ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্রও থাকবে। তখন টিভি-পর্দায় ভেসে উঠলো সম্রাজ্ঞীর সেই কনকময় ডিনার সেট। মানুষের সৃষ্ট অথবা সংগৃহীত সব দর্শনীয় সুন্দর বস্তুর পেছনে কিছু না কিছু কাহিনী থাকে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দুইবার গিয়েছি, সব দেখা হয়নি বা সবকিছুতে আগ্রহ ছিল না। আমি শিল্প-রসিক বা শিল্প-সমঝদার নই। তবে ওই সব বহু মূল্যবান সংগ্রহের পেছনের তথ্য অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত জানতে খুব আগ্রহী। মিউজিয়াম ঘুরে শুধু মনোলোভা অপূর্ব সব বস্তু দর্শন নয় আমার জানতে ইচ্ছে করে এর পেছনে জড়িয়ে থাকা মানুষের আগ্রাসনের ও দুষ্প্রাপ্য সম্পদ অর্জনের বিচিত্র সব আখ্যান। ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে উজ্জ্বল করে রেখেছে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে লুঠতরাজ করে আনা অসাধারণ সব বস্তু। মোঘল দরবার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অনেক রত্নরাজি ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে আলোকিত করে আছে।
এই ছবির মূল্যবান চোখ জুড়ানো জিনিসগুলো ক্যাথরিনের নিজস্ব সম্পদ। উল্লেখ্য যে ১৮৮২সাল থেকে এ্যারমিতাজ মিউজিয়াম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এ্যারমিতাজ মিউজিয়ামে অনেক চিত্রকর্ম কবে, কোথা থেকে এবং কত দাম দিয়ে কেনা হয়েছে সে তথ্য উল্লেখিত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হল প্রথম এবং সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পৌত্র জর্জ ওয়ালপোল (থার্ড আর্ল অব অক্সফোর্ড) এর কাছ থেকে ক্যাথরিনেরসময়ে (শাসনকাল ১৭৬৩-১৭৯৬) ১৭৭৯ সালে ৪০হাজার পাউন্ডেরও বেশী মূল্য দিয়ে ১৯৮টি শিল্পকর্ম কেনা হয়। উল্লেখিত চিত্রকর্ম বা পেইটিংগুলো বিলাতের বাইরে অন্যদেশে চলে যাক বা অন্য কারো কুক্ষিগত হউক তা ইংল্যান্ড-বাসী অভিজাতরা চায়নি। কিন্তু শিল্প-বিপ্লব উত্তর সমৃদ্ধ বিলাতের চেয়ে আধা সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়ার সম্রাজ্ঞীর অর্থনৈতিক পেশীর শক্তি ছিল প্রচণ্ড বেশী। যখন রুশ রাজারাজ্ঞীরা জগত ঢুঁড়ে বহু ব্যয় করে সৌখিন শিল্প ও সম্পদ সংগ্রহে নিবেদিত তখন পলুফিউডাল ঐ দেশে সাধারণ রুশ জনগণের জীবন ছিল দাসানুদাসেরও অধম। রাজন্যরা প্রজাদের মঙ্গল বিধানে উৎসাহী ছিলনা, বরং ছিল প্রজা-নির্যাতনে ওস্তাদ । ব্রিটিশরাও যখন কলোনি লুণ্ঠন করে দর্শনীয় মূল্যবান সব সম্পদ এনে মিউজিয়ামে সাজাচ্ছে তখন কলোনির মানুষেরা নির্যাতিত ও শোষিত হয়েছে ব্রিটিশেরই হাতে।
সবার কল্যাণ বা বিশেষ করে সাধারণ মানুষের উপকার হয় এমন অনেক কাজ জমিদার-রাজা-সম্রাটরা করেছেন। পুকুর বা দিঘি খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এধরনের কাজের ভুড়িভুড়ি উদাহরণ আমাদের উপমহাদেশে আছে। ভারত সম্রাট শেরশাহ্ দিল্লী থেকে ঢাকার সোনার গাঁ পর্যন্ত গ্রান্ডট্রাংক রোড নির্মাণ করেছিলেন সর্বসাধারণের জন্য, শুধু নিজের বাপ-ভাই ও বংশধরদের জন্য নয় নিশ্চয়। মেলবোর্নের এক্সিবিশনে এ্যারমিতাজের সংগ্রহ থেকে পৃথিবী বিখ্যাত সব শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম বা পেইটিংগুলো তো ছিলই আর ছিল বুলেট প্রুফ কাঁচের বেষ্টনীতে সম্রাজ্ঞীর নানা সম্পদ। কত বিচিত্র উপায়ে যে সেকালের ধনাঢ্যরা সম্পদ উপভোগ করতেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ রাজ্ঞীর সোনার কারুকাজ খচিত থালায় সোনার চামচে খাবার খাওয়া।
মনে হয়, নাকি সুনিশ্চিত যে ভবিৎষ্যতে দর্শকরা কোন এক যাদুঘরে গিয়ে দেখতে পাবেন সৌদি বাদশাহ এর মেয়ের বিয়ের সময়ে উপহার হিসাবে পাওয়া সোনার কমোড। একশ্রেণীর মানুষের সম্পদ আস্বাদনের পদ্ধতি বড়ই বিচিত্র। আঠারো সালে পাশ্চ্যতের রুশ মহারানী খাবার টেবিলে সোনার নকশাদার থালায় সোনার চামচ দিয়ে খাবার খেয়েছেন। দুই হাজার সালে প্রাচ্যের সৌদি বাদশাহজাদি টয়লেটে সোনার তৈরি কমোড ব্যবহার করছেন!
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|