bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












সুন্দর ফন্টের জন্য SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন...


গল্প

হুমায়ূন আহমেদ ও এক
অতিপ্রাকৃত নারী

দিলরুবা শাহানা



তার মাথা পাগল করা দুশ্চিন্তা আর নাই। গত রাত ১১টা কি ১২টা থেকেই আচানক উপায়ে তার দুর্ভাবনার অবসান। কি ভয়ংকর মানসিক চাপের মাঝেই না সে ছিল। বিদেশ বিভূঁইয়ে কাউকে চেনে না, জানে না। কী করবে বুঝতে পারছে না। আজ দুপুর ১২টা বাজার আগেই তার হোটেল ছাড়ার কথা ছিল। যে এসে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা, সে কোনো যোগাযোগই করেনি। অথচ শাহবাজ জানে তার বাবা মূল সম্পত্তি, অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির পুরো টাকা ওই লোকের পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন। ভদ্রলোক আমেরিকাতে তার পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ বাবদ ডলার দেবে; এ রকমই কথা। ভদ্রলোক তাঁর ইউনিভার্সিটির টিউশন ফি ঠিকঠাক মতো জমা দিয়েছেন। এই হোটেলও বুকিং দিয়ে তার থাকার ব্যবস্থা করেছে। তাকে এই হোটেল থেকে নিয়ে গিয়ে ইউনিভার্সিটির কাছে থাকার জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কথা। কিন্তু এর কোনো কিছুই কথামতো ঘটল না।

এখানে এসে এ রকম অসহায় এক পরিস্থিতিতে পড়েছে, তা বাবাকে জানায়নি শাহবাজ। অসুস্থ বাবা মাতৃহীন ছেলের সোনালি ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় বিস্তর অর্থ বিশ্বাস করে একজনের হাতে তুলে দিয়েছেন। যদি শোনেন ছেলে আমেরিকায় আসার পর তিনি তাঁর ছেলের খোঁজই নেননি বা এখনো নিচ্ছেন না, তবে ছেলের বিপৎচিন্তায় ও টাকার হয়তো শোকে মারাই যাবেন। সেই কথা চিন্তা করে বাবাকেও বিষয়টি জানায়নি।

গতকাল বিকেলেই হোটেলের লোক বলেছে, আজ ১২টার আগে রুম ছেড়ে দিতে হবে। তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। লোকটি আসেননি। সন্ধ্যায় শাহবাজ হোটেলের সামনে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। ভাড়ায় চালিত ক্যাব হোটেলে এলেই গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে ওই লোক এলো কি না। দেখতে দেখতে শাহবাজ একটু যেন আনমনা হয়ে পড়েছিল। এ সময় হঠাৎ দেখে শাড়িপরা লম্বা এক মেয়ে ছুটতে ছুটতে তার কাছে এসে ভীত ও উত্তেজিত গলায় বলল,
‘ভাইজান আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’
ঘন নীল জমিনের ওপর টকটকে লাল পাড়ের শাড়িতে কালো কিন্তু লম্বা মেয়েটার ভীত চেহারা দেখে নিজেই ভয় পেল শাহবাজ। অবাক করার মতো ওই মেয়ের দীর্ঘ চুল। বিনুনিতে বাঁধা চুল। বেণিটি তার নিতম্ব ছাড়িয়েছে।
শাহবাজ ভীত স্বরে বলল, ‘কী, কী চাই?’
‘আমাকে একটু লেখক হুমায়ূন আহমেদের ওখানে পৌঁছে দেবেন? আমি একটা ঝাড়া জানি। ওই ঝাড়া ঝাড়লে উনি ভালো হয়ে যাবেন। আল্লার কসম ভাইজান, এটা পরীক্ষিত সত্য!’
‘আমি নিজেই এখানে মাত্র দুদিন হয় আসছি, ইন্টারনেটে বাংলা কাগজ পড়ে জেনেছি হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতালে এখন।’
মেয়েটা অধৈর্য কণ্ঠে মিনতি করল, ‘আমাকে ওই হাসপাতালে নিয়ে চলেন, ওনাকে ভালো করতে পারব, এমন জ্ঞান আমার আছে। টাকা–পয়সার কথা চিন্তা করবেন না, আমার কাছে টাকা আছে।’
একদমে কথা কটি বলে তবেই মেয়েটি নিঃশ্বাস নিল। তারপর আবার গড়গড় করে কথার গাড়ি চালাল।
‘দুই দিন বিমানবন্দরে বসেছিলাম। আজকে এক লোকের কাছে গিয়ে ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ বার বার বলার পর সে কি বুঝল কে জানে, হাতের ইশারায় তার সঙ্গে যেতে বলল। বাইরে আসার পর এক মোটরগাড়িতে তুলে দিল। ওই মোটর-ওয়ালা আমাকে এইখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে, ভাড়াও চায় নাই।’
‘তু...তু...তুমি কোথা থেকে, কী ভিসাতে এসেছ? ইংরেজি জানো?’
‘ইংরেজি জানি না? ভিসা কী, তা–ও জানি না। তবে আসছি বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে। জানেন ভাইজান, আমার সুটকেসটা প্লেন থেকে নামাতে ভুলে গেছি। তবে এই ব্যাগে আসল জিনিস আছে, এইটা হারাইনি।’

শাহবাজ বিস্ময়ে হতভম্ব। ভাষা জানে না, কী ভিসা জানে না। চলে এসেছে আমেরিকা হুমায়ূন আহমেদকে সুস্থ করে তুলতে। পাগল না ছাগল, কে জানে। কীভাবে সে এল এই দেশে? শাহবাজ নিজে দেখেছে তাকে পাঠাতে তার বাবার প্রাণান্ত অবস্থা। মেয়েটি আবার করুণ গলায় বলল,
‘একটু গা, হাত–পা ধুয়ে লেখকের কাছে যেতে চাই।’
‘আমি নিজেই জানি না উনি কোন হাসপাতালে?’
‘আপনি লেখাপড়া জানা মানুষ ভাইজান! আপনি খুঁজে বার করতে পারবেন, চলেন আপনার রুমে। এখন গা ধুয়ে পাকসাফ হই।’
‘বসো এখানে।’ বলেই শাহবাজ হোটেলের ইন্টারনেট সার্ভিস ডেস্কে গিয়ে বাংলাদেশের অনলাইন পত্রপত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদ সংক্রান্ত খবর খুঁজল। খবর দেখে সে অবাক। কিছুক্ষণ আগে উনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

দ্রুতপায়ে মেয়েটির কাছে ফিরে এল শাহবাজ। দেখে হোটেল লাউঞ্জের সোফায় বুকের কাছে ব্যাগটি দুহাতে আঁকড়ে লাল পাড় গাঢ় নীল শাড়িপরা কালো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শাহবাজ মৃদু স্বরে ‘এই মেয়ে ওঠো, এই মেয়ে ওঠো’ বলে ডাকল। ঘুম ভাঙাতে পারল না।

শাহবাজ অসহায়ভাবে চারপাশে তাকাল। দেখে নিল কেউ ওদের দেখছে কি না। তারপর মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে আবার যেই বলল, ‘এই মেয়ে, ওঠো’। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি ব্যাগটা একই ভঙ্গিতে জোরে বুকের কাছে চেপে ধরে উঠে বসল। বড় বড় ভয়ার্ত চোখে জিজ্ঞাসা। তারপরই সুস্থির হয়ে খুব ব্যাকুল গলায় বলল,
‘লেখকের খবর পাওয়া গেল? আমাকে ওইখানে পৌঁছে দেবেন ভাইজান?’
মেয়েটির কণ্ঠে এমন এক আন্তরিক আকুতি ঝরে পড়ল যে দুঃসংবাদটা দিতে মন সায় দিল না। শুধু বলল, ‘খবর পেয়েছি, তুমি হাতমুখ ধোও, তারপর যাওয়া যাবে। চল আমার ঘরে।’

লিফট দিয়ে ওপরে উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে শাহবাজ আপন মনেই যেন বলল, ‘লেখকের অবস্থা খুব শোচনীয়, গিয়ে ওনাকে পাবে কি না, কে জানে।’
মেয়েটি যেন ঘোরের মাঝে হাঁটছে। কথাগুলো যেন ওর কানে যায়নি। দরজা খুলে মেয়েটিকে ঢুকতে দিল প্রথম। নিজে যেই পা বাড়িয়েছে ভেতরে ঢুকবে বলে তক্ষুনি টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন ধরার জন্য এগিয়ে যেতে যেতে শাহবাজ হাতের ইশারায় মেয়েটিকে বাথরুম দেখিয়ে বলল, ‘যাও, হাতমুখ ধুয়ে আসো।’
মেয়েটা ছোট ব্যাগটা টেবিলের ওপর খুব যত্ন করে রেখে বাথরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে একটু থেমে ঠোঁটে আঙুল রেখে শাহবাজকে বলল, ‘আমার কথা কাউকে বলবেন না যেন।’

ততক্ষণে শাহবাজ ফেনের রিসিভার তুলেছে। নিচে রিসেপশন থেকে জানাল ওর ওভারসিজ কল এসেছে কয়েকবার, রুমে দিতে দিতে লাইন কেটে যাচ্ছে। সে নিচে গেলে ভালো হয়। শাহবাজ তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরুবে, এমন সময় বাথরুমের দরজা খুলে মেয়েটি বের হলো। খোলা চুল মুখ ঘিরে, পানির বিন্দু চোখের পাপড়িতে মনে হয় যেন কাঁদছিল। অলৌকিক দৃশ্য এক।
‘কোনো খারাপ খবর ভাইজান? লেখক কি আর নাই!’ মেয়েটি বলল।
‘হ্যাঁ মনে হয় তা–ই, আসছি খবর নিয়ে।’
কথা শেষ করার মাঝেই দরজা শব্দ করে বন্ধ করে নিচে ছুট্ল সে। ভয় লাগল ভেবে যে, মেয়েটি যদি কান্নাকাটি শুরু করে, তখন কি উপায় হবে।
রিসেপশনে পৌঁছাতেই আবার ফোন বাজল। শাহবাজ রিসিভার কানে ধরে বুঝল ফোন করেছেন ওর বাবা আহফাজ আলী।
‘কেমন আছিস, তার খবর পেয়েছিস?’ শাহবাজের বাবা বললেন।
আমি ভালো, উনি এসে পৌঁছাননি এখনো, এসে যাবেন নিশ্চয়, চিন্তা করো না।’
ভাঙা গলায় বাবা বললেন, ‘নারে সে আর কোনো দিন আসবে না।’
মানে, কী হয়েছে ওনার?’ শাহবাজ বিস্মিত হয়ে বলল।
‘তার পরিবার এইমাত্র জানিয়েছে সে রোড অ্যাকসিডেন্টে একটু আগে মারা গেছে। তোকে নিতে আমি আসছি...।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইন কেটে গেল। শাহবাজের পায়ের নিচের পৃথিবী দুলে উঠল। মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে সরষের হলুদ ফুল অগুনতি। বাবাকে কোথায় ফোন করতে হবে জানে না। ওদের বাড়িতে ফোন নাই।

শাহবাজ চিন্তা করল, এখন সে কী করবে? প্রথম কাজ ওই মেয়েকে বিদায় করা। কিন্তু কীভাবে করবে, তা ভেবে পেল না। টলতে টলতে এসে ঘরের দরজা খুলতেই ঠাণ্ডা বাতাস নাকে–মুখে ঝাপটা দিল। অবাক হয়ে দেখল, জানালা হাঁ করে খোলা। নাম না জানা মেয়েটিকে খুঁজল, কোথাও নেই। দরজা লক করা ছিল। কীভাবে মেয়েটা উবে গেল। জানালার কাছে এসে নিচে তাকাল। ১৭তলাতে এই রুম। কীভাবে জানালা দিয়ে পালাবে, বুঝতে পারছে না। এবার ঘরের লাইট জ্বালিয়ে সে জানলার কাছে আবার এল। তখন যা দেখল তাতে তার হৃদয়ের স্পন্দন প্রায় থেমে গেল। জানলার এক পাটের হুকের সঙ্গে ঘন নীল লাল পাড় শাড়ির এক টুকরা আটকে আছে। টুকরাটুকু হাতে নিয়ে একা ঘরে ফুঁপিয়ে উঠল সে। চোখে পানি নিয়ে চারদিকে তাকাল। ব্যাগটা টেবিলে যেভাবে রেখেছিল মেয়েটি সেভাবেই রয়েছে। আবার নিচে নেমে আসল শাহবাজ। হোটেল থেকে ধীর পায়ে বাইরে এল। হোটেলের চারপাশ আস্তে আস্তে ঘুরে ঘুরে দেখল। নাহ কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। কী হলো ওর, ভেবে পাচ্ছে না শাহবাজ। অবাক হয়ে দেখল, লাল পাড় নীল শাড়ির টুকরাটাও তার হাতে নেই।

ভয় এসে জাপটে ধরল ওকে। কী করবে এখন। আসলেই কি এমন এক মেয়ে এসেছিল? নাকি পুরো বিষয়টা তার নিজের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনের কল্পনা। লিফট দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মনে হলো, সে যেন ভেসে আছে। লিফটের দরজা খুলতেই তার পা দুটো প্লেন ল্যান্ডিংয়ের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে মাটিতে নামল। নিজের ঘরের দরজায় পৌঁছে ভয়টা গাঢ় হলো। কাঁপা কাঁপা হাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলল। আস্তে ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকল। জানালা তেমনি খোলা রয়েছে। এবার ভয় আরও বাড়ল। কল্পনা নয় আসলেই রহস্যময়ী মেয়ে এসেছিল। রহস্যময়ভাবে উবেও গেছে। শাহবাজ হেঁটে নয়, মনে হলো উড়ে গিয়ে জানালা বন্ধ করল। ঘরে আলো জ্বালিয়ে দেখে ওই মেয়ের ব্যাগ টেবিলে তেমনি রাখা আছে।

টেবিলের কাছে এসে দ্বিধা আর ভীতি ঝেড়ে ফেলে ব্যাগটা হাতে নিল। কী আছে এতে? মেয়েটির পাসপোর্ট নিশ্চয় রয়েছে এতে। পাসপোর্টের ভাবনা মাথায় আসতেই সে তাড়াহুড়া করে ব্যাগ খুলে উপুড় করে টেবিলে সব ঢেলে দিল। তারপর যা দেখল তাতে তার চোখ অবিশ্বাসে বিশাল হয়ে গেল। একগাদা ডলার। শুধু ডলার। গোছা গোছা ডলারের নোট রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো সব। আর কিছু ব্যাগে খুঁজে পাওয়া গেল না। হুমায়ূন আহমেদের খোঁজে আসা অতিপ্রাকৃত এক মেয়ে অলৌকিক উপায়ে এই অর্থ তার বিপদ উদ্ধারের জন্যই যেন রেখে গেছে।


দিলরুবা শাহানা - মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
প্রথম আলো - নভেম্বর ২৯, ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত







Share on Facebook               Home Page             Published on: 14-Dec-2014

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far