bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন


গল্প
অরূপ
দিলরুবা শাহানা



সকালের সোনা রোদ গায়ে মেখে আদিবা বেতের দোল চেয়ারে বসে তাকিয়েছিল। দৃষ্টি তার শূণ্যতায় নিবদ্ধ ছিল না। দূরে ব্যাডমিন্টন কোর্টে ঘাসের উপরে ছেলে অরূপ। তার হাতে র‍্যাকেট। সে চেষ্টা করছে খেলার। তাকেই আদিবা দেখছিল। ট্রেইনার আর সাহায্যকারীও আছে অরূপের সাথে।

মাত্র ছয়মাসে কি অদ্ভুত পরিবর্তন মা ছেলের জীবনে। যদি ওই রাতে ভয়ংকর ঝড় না হতো আর সমুদ্র থেকে মরণ আলিঙ্গন দিতে জলোচ্ছাস ছুটে না আসতো তবে কি তাদের কপালে এত প্রাপ্তি ঘটতো? মনে হয় না। দেশের দক্ষিণে সমুদ্র ফুঁসে উঠেছিল প্রচন্ড রাগে। সব সম্বল পিছনে ফেলে অগুন্তি অসহায় মানুষ প্রাণটুকু হাতে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটেছিল। আদিবা কেমন আচানক ভাবে ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আগেভাগেই পৌঁছে গিয়েছিল। যখন চারদিকে ধ্বংস আর মৃত্যুর হাহাকার তখন কেউ যেন ওদের উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল ওই রাতে। আদিবার ভাইয়ের বউটা ঝড়ের কোপ থেকে বাঁচতে পারেনি। সরল মায়াবতী বউটা আদিবার একমাত্র সহায় ছিল। ওই হৃদয়বতী বউটাই প্রথম বলেছিল
-আল্লাহপাক আদিবাকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছেন।
আদিবার মায়ের পেটের ভাই বিষয়টা একেবারেই বুঝতে চায়নি। বউটা ভাইকে বলেছিল
-দেখ এমন এক সন্তান দিয়ে আল্লাহ ওকে যে কষ্টের মাঝে ফেলেছেন তা দেখে আমাদের উচিত নয় কি ওকে মায়া আর দরদ দেখানো।
আদিবার স্বার্থপর ভাই তাকে বাপের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে, গর্ভবতী বোনের খোঁজও নেয়নি। এমন কি বাচ্চাটাকেও হাসপাতালে দেখতে আসেনি। সে রাগে চিড়বিড় করে উঠেছিল।
-ও কেন বাচ্চাটাকে হাসপাতালে ফেলে আসেনি? কেন? বাপ আর দাদী তো বাচ্চার ভয়ংকর রূপ দেখেই পালিয়েছে আর আসেনি।
বউ বলেছিল
-মা কখনো বাচ্চাকে ফেলতে পারে না। ও ভয়ংকর নয়, ও ছোট্টবাচ্চা, ও একটা মানুষ।
আদিবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেছিল
-আল্লাহ্ ওকে রূপ দেননি ও হচ্ছে অরূপ। ভাই আমি কোথায় যাব বল?
ভাইয়ের সরল বউটা বলেছিল
-কোথায় যাবে মানে? এইখানে থাকবি। আমি খেলে তুই আর তোর ছেলেও খাবে। আমি মারা গেলে এই বাড়ী থেকে চলে যাস।
তার বে-রহম ভাই বউকে বলেছিল
-তুমি বোকারও অধম।
ভাইয়ের বাড়ীতেই অবহেলা অনাদর, গঞ্জনা সয়ে এতোগুলো বছর পার করেছে আদিবা। ভাইয়ের চোখের সামনে সহজে অরূপকে যেতে দিত না। ঝড়ে ভাইয়ের বউ মারা যাওয়ার পর ভাই আশ্রয়কেন্দ্রেই আঙ্গুল দিয়ে অরূপকে দেখিয়ে বলেছিল
-এইটা কেন মরলো না, হ্যাঁ? এ মরলে বাঁচতাম। শোন্ আদিবা আমার কাছে তোদের আর ঠাঁই হবে না।

ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে দেশীবিদেশী ডাক্তার নার্স মানুষের সেবায় ভিড় করেছে। ঝড়ে আহত মানুষও অনেক। চিকিৎসা শিবির খুলে কাউকে ওষুধ, কাউকে ব্যান্ডেজ, কাউকে রক্ত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। যারা অক্ষত ও সুস্থ তারা রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে লাইনে খর্বাকৃতি, ছোটখাটো মাথা, ধনুকের মত বাকানো পা, কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়েও ছোট হাতের স্বাস্থ্যবান বোবা অরূপও ছিল। অরূপের রক্ত নিয়েই ডাক্তারদের মাঝে কানাঘুষা। ওর রক্তের মধ্যে অসাধারন কিছু উপাদান ছিল যা দেখে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও হতবাক। তারপরই বিদেশী ডাক্তারদের টীম অরূপ ও তার মাকে সবার মাঝ থেকে আলাদা করে নিয়ে আসে। কত পথ পেরিয়ে শেষমেশ এ্যারোপ্লেনে তারা এখানে এসে পৌঁছায়। তারা দু’জনে এখন এই পাহাড়ঘেরা স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রে আছে। জায়গাটা মেঘালয় ঘেষা বাংলাদেশের সীমান্তে। অরূপকে এখানে লেখাপড়া, ছবি আঁকার পাশাপাশি খেলাধূলায় ব্যাস্ত রাখা হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে ট্রেনার এসে অরূপকে ব্যাডমিন্টন খেলা শেখায়। তখন দূরে বসে ছেলের খেলা দেখতে খুব ভাল লাগে আদিবার।

যদিও এখানে আসার ব্যাপারে আদিবা ভয় পাচ্ছিল খুব। আশ্রয়কেন্দ্রেই কেউ কেউ বলেছিল
-তোমার ছেলের চোখ, কিডনী, হৃদপিন্ড বড়লোকদের কাছে বিক্রি করার জন্যই যত ফন্দিফিকির ওদের। অরূপের রক্তের গুণ আছে এগুলো সব তালবাহানা।
একজন বুড়ো ফকির কিসিমের মানুষই শুধু আশার কথা শুনিয়ে বলেছিলেন
-দেখ গো মা, ওদের কথা সত্য হতেও পারে। এমন নদী, এমন অনেক কুয়া এই দুনিয়ায় আছে যার পানি মানুষের রোগ বালাই সারায়। তোমার ছেলেও ওই উপকারী নদীর মত কেউ একজন হবে হয়তো।

এই স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রে আসার পর অরূপকে নিয়ে নানা গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তারা নিয়মিত রক্ত নিচ্ছেন পরীক্ষা করার জন্য। অরূপের মা আদিবা শুনতে পেয়েছে, যেকোন রোগীকেই অরূপের রক্ত দেওয়া যায়। আরও অবাক করার মত ব্যাপার হল কঠিন অসুখে ভোগা মানুষকেও অরূপের রক্ত সামান্য পরিমানে দিলেও সে মানুষ অসুখ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। এসব আদিবা শুনেছে মাত্র। সত্যিমিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা তার ছিল না। এই কেন্দ্রে অরূপকে নিয়ে বিস্ময়ের যেমন কমতি নাই তেমনি অরূপের যত্নআত্তিরও কোন কমতি নাই। আদিবারও অনেক স্বস্থি, শান্তি আর আয়েশের জীবন এখন।

আদিবার অতীত অনেক বিচিত্র। মা ছাড়াই মানুষ হয়েছে সে। আদিবার বয়স তখন বছরখানেক। দুপুরে ঘুমে ছিল সে। বাইরে হঠাৎ প্রচন্ড বেগে ঘূর্নিঝড় উঠলো। বৃষ্টিও নামলো। ছাতা মাথায় মা বেরিয়ে ছিল বাইরে শুকাতে দেওয়া কাপড় তুলতে। অল্পক্ষণের মাঝে কয়েকটি ঘর, কিছু গাছপালা শিকড়শুদ্ধ উপড়ে নিয়ে ঘূর্নিঝড় কোথায় যেন চলে গেল। চারদিক শান্ত হল একসময়। সে ঝড় আদিবার মাকে জড়িয়ে পেচিয়ে কোথায় যে নিয়েগিয়েছিল তা কেউ কোনদিন জানতে পারেনি।

কলেজে পড়তে পড়তেই বাবা ভাল ছেলের সাথে আদিবার বিয়ে দেয়। শাশুড়ী ও স্বামীর ছোট্ট সংসারে আদিবা ভালই ছিল। বাচ্চাটা আসলো বিয়ের বছর সাতেক পর। বাচ্চা হচ্ছে না তা নিয়ে মন খারাপ ছিল সবার। আদিবার বাবার নাতির মুখ দেখা হয় নি। সে মানুষটি হঠাৎ করেই চলে গেছেন অন্য ভুবনে। বাচ্চা আসছে এই আনন্দে আবিষ্ট ছিল আদিবা আর তার স্বামী। জন্মের পর বাচ্চা কাঁদেনি প্রথমে। তবে ওর অবয়ব দেখে শাশুড়ী, স্বামী বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বাচ্চাকে মৃত ভেবে বাপ আর দাদী মনে হয় খুশীই হয়েছিল। সবাই মৃত ভাবা সত্ত্বেও বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল আদিবা। পাথর হয়ে বসেই ছিল সে। স্বামী কত সাধলো ওকে বাড়ী যেতে। আদিবা নড়লো না। একটা কথাও বললো না। এর মাঝে আচমকা নড়েচড়ে চিৎকার করে কান্না জুড়লো ছেলে। চারপাশে সবাই অবাক। নার্স আর ডাক্তারদের ছুটাছুটি শুরু হল বাচ্চাটাকে নিয়ে। যখন হৈচৈ চলছে আদিবার বিস্ময় বাবুকে নিয়ে তখন দাদী-বাবা নিষ্ঠুরের মত মা-ছেলেকে ফেলে রেখে চলে গেল। আর ফিরে আসেনি ওরা। পরদিন আদিবার ভাইয়ের মিষ্টি বউটা এসেছিল বাচ্চা দেখতে। এসে যখন দেখলো বিদঘুটে বাচ্চা দেখে স্বামী-শাশুড়ী নারাজ হয়ে ওদের হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে গেছে সে ব্যথিত হল খুব। মায়াবতী ভাবীটি ওদের নিয়েই বাড়ী ফিরলো।

তারপর অনেক কষ্টের মাঝ দিয়ে দিন কেটে গেছে আদিবা আর অরূপের। আদিবাও মানুষ। মানবিক অনুভূতি কামনা বাসনা তারও ছিল। পড়শী এক তুতোভাই আদিবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল এক সময়ে। আদিবাও তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করছিল একটু একটু করে। তবে একসময়ে যখন বুঝলো ওর ছেলেকে ত্যাগ করতে হবে তখনই তার হুশ ফিরলো। সে পিছিয়ে আসলো সুখের হাতছানি থেকে। অনেক গঞ্জনা অপমান সহ্য করেও আদিবা আর অরূপ বেঁচে রইলো। আদিবার ভাইও বোন আর বোনের ছেলেকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে মরিয়া হয়ে উঠলো। মৃতদার অবস্থাপন্ন এক বৃদ্ধলোক পুত্রসহ আদিবাকে বিয়ে করতে এগিয়ে আসলো। বৃদ্ধের কন্যা আর পুত্রবধুরা এসেছিল আদিবার সঙ্গে দেখা করতে। তারা সবাই আদিবার চেয়েও বয়সে বড়। অনেক উপহারও এনেছিল ওরা। আদিবার অসহ্য কষ্টের জীবন দেখে ওরাই দুঃখীত হল বেশী। কিন্তু উপহারসামগ্রী রেখে বিয়ের কথা বাতিল করে আদিবাকে মুক্তি দিয়ে চলে গেল তারা। চারপাশের সবাই তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো অন্তহীন কষ্টই বোধহয় আদিবার অদৃষ্টের লিখন। অদৃশ্য শক্তি হেসেছিল কি তখন?

চৌদ্দ বছরে পৌঁছলো অরূপ। এরমাঝে আশপাশের বাড়ীর ছোটছোট কয়েকটি বাচ্চাকে হোমওয়ার্কে সাহায্য করা শুরু করেছিল আদিবা। পড়ন্ত দুপুরে ভাই বাড়ী থাকতো না। ঘরের বারান্দায় পাঁচছ’টি শিশুর সাথে অরূপও বসতো। খেলতো কখনো। কখনো বা কাগজ পেন্সিল পেলে আঁকিবুকি আঁকতো। ওর পেন্সিল-কাগজ নিয়ে খেলার আগ্রহ দেখে আদিবার ভায়ের বউ খাতা পেন্সিল কিনে দিয়েছিল। অরূপ শান্তশিষ্ট ছিল। খাতা পেন্সিল পেয়ে নিয়ম করে মায়ের পড়ুয়াদের পাটিতে বসে আঁকতে থাকলো। পেন্সিল তার বশ মানলো। সুন্দর করে পেন্সিল ধরা শিখলো। আপন মনে কিসব ছবিও আঁকতে শুরু করলো।

ছাত্রদের মা-বাবারা পয়সা কড়ি দিতো না কখনো তবে অরূপের জন্য জামা টামা কিনে দিতো মাঝে মাঝে। ঈদের সময় ওরা চাঁদা তুলে মা-ছেলের জন্য নতুন কাপড়,জুতা উপহার দিতো। অরূপের মামী প্রতি শীতে ওর জন্য ফ্লানেলের শার্ট এনে দিতো। তাতেই ওর চলতো। অরূপের তেমন অসুখবিসুখ করতো না। অতি সাধারন খাবার খেয়ে, সামান্য কাপড়চোপড়ে অরূপ-আদিবার জীবন চলে যাচ্ছিল। আদিবা ভাবতে চাইতো না তবুও একটা ভয়ংকর ভাবনা মনে হানা দিতো মাঝে মাঝে। ভাই বের করে দিলে কি উপায় হবে, কোথায় বা যাবে ওরা। ভাবলে আদিবা অস্থির হয়ে পড়তো। ছেলের পিঠে মাথায় হাত বুলাতো আর অবিরাম স্রষ্টাকে স্মরণ করতো। একটা স্বপ্ন আদিবা দেখতে ভালবাসতো তা হল একদিন ঝড় আসবে, ভীষণ এক ঝড়। তেমন ঝড় যে ঝড় আদিবার মাকে কোন এক অজানায় নিয়ে চলে গেছে। সেই ঝড় তাকে ও অরূপকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। কারোর দয়ায় তাদের বাঁচতে হবে না, তারা আর কারও উপর বোঝা হয়ে থাকবে না। আদিবার দূর্ভাগ্য দেখে কেউ দুঃখ করতো। কেউ আবার অপয়া বলে ওদের করুণা করতো। তবে একরাতের তুমুল ঝড় তার কষ্টের ললাটলিখন ধুয়ে মুছে দিয়ে তাদের যেন রূপকথার রাজ্যে পৌঁছে দিল।

মেঘালয়ের সীমান্তে সিলেটের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুব ভাল আছে ওরা। তবে আরও বিস্ময় বাকী ছিল। একদিন ভিনদেশী চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের একটি দল উপস্থিত হল এই কেন্দ্রে। তারা গবেষণার জন্য অরূপকে আদিবাসহ ভিয়েনা নিয়ে যেতে এসেছে। অরূপ এখন আর কারোর জন্য যন্ত্রণা নয়, কারোর উপর সে বোঝা নয়। বোধহয় ওর মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে বলেই জন্মেছে অরূপ।




দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া





Share on Facebook               Home Page             Published on: 30-Nov-2018

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far