অবৈধ অভিলাষ দিলরুবা শাহানা
সারা শহর এখন ঘুমে। সত্যি? নাকি পুরোপুরি সত্যি নয়। এই শহরে কেউ হয়তো বা জেগে থাকলেও থাকতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে এই পাড়াতে সবাই ঘুমে। ঘুমে অচেতন বাড়ীটি। ঘুমন্ত ভালমানুষ প্রেমময় স্বামীটিও। এই সুযোগে আইভি হাঁটুর বয়সী এক যুবা-পুরুষকে ভীষণ যত্নে আগলে নিয়ে পালাচ্ছে। খুব শঙ্কিত সে। বাড়ী ছাড়ার আগে শোবার ঘরে ঘুমন্ত স্বামীর দিকে গভীর ভালবাসা নিয়ে তাকালো। নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল। বিবেকে বড় বাধছিল। এমন সজ্জন, সুহৃদ ভাল মানুষটিকে অপদস্থ হতে হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে। পরিচিত-জনদের শত প্রশ্নের মুখে বিব্রত হতে হবে স্বামীকে। শুধু বিব্রত নয় রীতিমত বিপর্যস্ত হতে হবে লোকটিকে। একবার মনে হল স্বামীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সে তার শেষ প্রেম জানাবে। ভয় পেল ভেবে যদি জেগে যায়। ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে আকুল আকুতিকে শাসন করলো। তারপর একটু ভেবে নিয়ে ভালমানুষ স্বামীটির পায়ের পাতায় ওই আঙ্গুলের স্পর্শে তার শেষ সম্মান জানালো। ইনি আইভির তৃতীয় স্বামী, নিখাদ সোনার মত তাঁর হৃদয়। তাঁকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে ওর। খুব কষ্ট। তবু এক দুরন্ত অভিলাষের তাড়নায় দারুণ উতলা সে এখন।
মধ্য-চল্লিশে পৌছে এই ছেলেটিকে সে পেয়েছে। এরসাথে অদ্ভুত এক বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছে। এমন সম্পর্কের বাঁধন কোনমতে ছিন্ন করতে সে রাজী নয় । এই সম্পর্ক তাকে দিয়েছে নারী জীবনে পরম কাঙ্ক্ষিত তবে অনাস্বাদিত এক আনন্দ।
প্রথম স্বামীর সাথে প্রেম ছিল উচ্ছ্বসিত। মনে হয়েছিল জীবনে সব পাওয়া হয়ে গেছে। এই আনন্দঘন প্রাপ্তিকে ধরে রাখা, লালন করাই দু’জনের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল। বাকী সব মিথ্যা, সব ফালতু। তবে স্বার্থের সংসার বড় নিষ্ঠুর। অল্পদিন যেতে না যেতেই বিষয়-সম্পত্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের টানে স্বামী ফিরে গেল তার মা-বাবার কাছে। তাদের শর্ত মেনে বাধ্য সন্তানটি আইভিকে ত্যাগ করলো উকিল নোটিশের মাধ্যমে। তখন আইভি বুঝলো এ ছিল ঘোরলাগা এক উচ্ছ্বাস মাত্র, প্রেম নয় ভালবাসাতো অবশ্যই নয়।
প্রথম দিকে আইভির মা-বাবা কঠিন থাকলেও প্রায় খাদে পড়ে যাওয়ার সময়ে আইভিকে কাছে টেনে নিলেন। পড়াশুনা শেষ করতে উৎসাহ দিলেন। দেখেশুনে বিয়েও দিলেন। মৃতদার এক ব্যক্তি। বেপরোয়া গাড়ী চালাতে গিয়ে লোকটির স্ত্রী মারা গেছেন। বিত্তশালী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকার ভদ্রলোক। প্রেম নয়, ভালবাসা নয় এবারের বিয়ে একসাথে জীবনযাপনের এক নিশ্চিত বন্দোবস্ত মাত্র। ভদ্রলোক বললেন ‘আমরা দুজনেই বঞ্চনার শিকার, আমি তোমাকে সুখে রাখতে চাই তবে একটি সন্তান এলে আমাদের মাঝে ভালবাসা ও বন্ধুতা প্রগাড় হবে। আমার স্ত্রী সন্তান বিষয়ে অনাগ্রহী ছিলেন।’ ‘আপনি তাকে আপনার সন্তানের মা হিসাবেই শুধু চেয়েছিলেন?’ ‘না আমি তাকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম; সে ছিল অপূর্ব সুন্দরী, তবে তুমিও খুব নম্র, লাবণ্যময়ী; আমি এখনও বুঝতে পারছিনা তুমিও তার মত সৌন্দর্য-সচেতন কিনা?’ ‘এই সচেতনতা কি খুব দোষের?’ ‘না। তবে আমার স্ত্রী ওই একটি বিষয়েই সব মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিলেন, অন্য কোনকিছুতে তার আগ্রহ ছিলনা। আমরা দু'জনে একান্তে বসে কোন নাটক-সিনেমাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একসাথে গান শোনা, বইপড়া দূরে থাক। আমার মনে হয় উনি আমাকে নয় আমার টাকা-পয়সাকেই বেশী ভালবাসতেন।’
বিত্তবান লোকটিকে বড় দুখী দুখী মনে হয়েছিল আইভির। এই লোকটিকে সুখী করবে এই ব্রত নিয়ে ফেললো আইভি। স্বামীও আইভির মমত্বে গভীরভাবে মোহিত যখন, তখনই আইভি জানলো সন্তানের স্বপ্ন তার দ্বারা কোনদিনই পূর্ণ হবেনা। সে একদিন চিঠিতে সব লিখে রেখে চলে এসেছিল। ভদ্রলোক কোনদিন আর যোগাযোগ করেননি। আইভি বুঝেছিল সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল এক হৃদয়ে তার মত বন্ধ্যা নারীর ঠাঁই হবে না।
তৃতীয় স্বামী পরিণত বয়সী উদার একজন মানুষ। অনঘ আনন্দে সদা ভরপুর চিত্ত। অকৃতদার মানুষটি আইভিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন ‘দেখ এই বয়সে প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া হবে না তবে গভীর ভালবাসায় ঘরবাঁধা যাবে’ আইভি বললো ‘কিন্তু আমার জীবনে সঙ্গী বদলের ঘটনাতো কম নয় তাছাড়া...’ প্রাণখোলা হাসি ছড়িয়ে বললেন ‘তুমিতো সখ করে পায়ের জুতা পাল্টানোর মত সঙ্গী পাল্টাওনি আইভি; আর সন্তান? আমিতো রাজা নই যে সিংহাসনের জন্য আমার উত্তরাধিকার দরকার। আর শোন বালিকা শুধু সন্তান নয় আমার মনে হয় ভালো কর্ম দিয়ে পৃথিবীতে ভাল কিছু করাই হচ্ছে চিহ্ন রেখে যাওয়া।’
তার ভালবাসার দেবতা স্বামী, যাকে মনে মনে আইভি কতবার বলেছে ‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালমন্দ মিলায়ে সকলি, এবার পূজায় তারি দিব আজ আপনারে বলি’। সেই স্বামীকে আইভি আজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে আচমকা তার জীবনে আবির্ভূত আদরকাড়া মায়াবী তরুণটির জন্য!
বেশ কিছুদিন ধরে ছেলেটি তাকে অনুসরণ করছিল প্রায় ছায়ার মত। নীরবে, নিঃশব্দে। আনন্দ অনুষ্ঠানে, মিলাদে, দাওয়াত-দোয়াতে সবখানে। এই শহরে নতুন আসা ছেলেটি মানুষের চোখে পড়লো। ধীরে ধীরে আইভিকে অনুসরণ করার ব্যাপারটাও মানুষ খেয়াল করতে শুরু করলো। যেদিন আইভির স্বামী বিস্মিত স্বরে বললেন ‘ছেলেটিকে দেখলাম আজ আমাদের রাস্তায়!’ ‘কোন ছেলেটি?’ ‘মনে আছে গত দিন মিলাদ থেকে ফেরার পথে কয়েকজন বলছিলেন...’ ‘কি বলছিলেন?’ ‘বলছিলেন মিলাদেও ওই ছেলেটি ছিল যে তোমাকে খুব খেয়াল করে দেখেছিল’ ‘মনে পড়ছে কয়েকজন বলছিলেন, কিন্তু আমিতো ছেলেটির দিকে চেয়েও দেখিনি, চিনিও না,’ ‘এটাই রহস্য, কয়েকজন বললেন অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানেও তারা বিষয়টা খেয়াল করেছেন’ ‘ছেলেটা কে, কোত্থেকে এসেছে?’ ‘শুনলাম ছাত্র, পড়তে এসেছে এই শহরে, তোমার কোন দূরের আত্মীয়টাত্মীয় হবে হয়তো’ ‘দূরের হউক কি কাছের হউক, কথা তো বলতে পারে এসে’ ‘হয়তো সংকোচ হয় বা লজ্জা পায়' ‘কি যন্ত্রণা বলতো!’ ‘তুমিই একদিন ডেকে কথা বলো না কেন’ ‘বলবো ভাবছি, কিন্তু কি বলবো বলতো?’ ‘কি বলবে মানে? জানতে চাইবে কে সে, কিভাবে তোমাকে চেনে ইত্যাদি ইত্যাদি’ । স্বামীর উৎসাহে ছেলেটির সাথে কথা বলতে আগ্রহী হল আইভি। একদিন কাজ থেকে ফিরছিল যখন তখন সে নিজ বাড়ীর গেটের কাছেই ছেলেটিকে দেখলো। গাড়ী থামিয়ে নেমে ছেলেটির কাছে গেল। ‘কি ব্যাপার বলতো? তুমি কে, আমাকে কি চেনো? কি চাও?’ ছেলেটি মনে হল ভয় পেয়েছে। খুব নীরিহ, সততা ও সরলতায় ছাওয়া তরুণ অবয়ব। কাঁপছে যেন একটু। ভীষণ নিচু গলায় বললো ‘আপনার কথা একজন বলেছেন আমাকে’ ‘কে বলেছে? কে সে?’ ‘একদিন এসে বলবো’ ‘ঠিক আছে, এই আমার বাড়ি। শুক্রবার দিন সকালে আসতে পার। তুমিতো ভয় পাইয়ে দিয়েছো বাপু, ঠিক আছে পরশু শুক্রবারেই আসতে পার।’ বলেই হনহন করে চলে এলো। ফিরে একবারের জন্যও তাকানোর ইচ্ছা হলোনা। তখনও সে জানেনা এই রহস্যময় ছেলে কিভাবে তার হৃদয়ের গভীর কন্দরে এসে ঠাঁই নেবে। আর সে নিজেও এই হঠাৎ পাওয়া ধন আগলে রাখার জন্য কতটা ব্যতিব্যস্ত ও ব্যাকুল হবে।
কথামত ওই শুক্রবারেই ছেলেটি এসেছিল। কথাবার্তা হল। আইভির স্বামী ছিলেন না। শহরের বাইরে কাজে গিয়েছিলেন। আইভি একাই শুনলো সব অবাক হওয়ার মত বৃত্তান্ত। ছেলেটির বাবা একটি ভিন-ধর্মী মেয়েকে মা-বাবা ও আত্মীয়পরিজনের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করে। এমন কি এই কারণে বন্ধুবান্ধবরাও তার শত্রু হয়েছিল। স্বাধীনচেতা, চৌকস এবং কিছুটা খেয়ালী কিসিমের মেয়েটি সন্তানের জন্মের পর স্বামী-সন্তান ফেলে রেখে কোথায় যেন চলে যায়। মেয়েটির নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নানা রহস্যময় গল্প-গাথা চালু ছিল। কখনো শোনা গেছে ছেলেটির পরিবারই মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আবার এমন গুজবও রটেছিল যে মেয়ের পরিবারই তাকে দেশের বাইরে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর বা দেশের বাইরে কোন ঠিকানায় সে কেউই নিশ্চিত জানে না। তবে সেই নিখোঁজ খেয়ালী মেয়ের সন্তান হচ্ছে এই ছেলেটি। তার অসহায় বাবা তখন ছোট্ট বাবুটিকে নিয়ে তার সহোদর বোনের কাছে আশ্রয় চায়। ওই শিশুর মায়ায় কঠিন স্বভাবের নিঃসন্তান পিসী নরম হলেন। মা হীন ভাইয়ের সন্তানকে আদরে আগলে রাখলেও ভাইকে কৃতকর্মের জন্য যথেষ্ট অবহেলা ও গঞ্জনার মাঝে রাখলেন। স্বজনের অনাদর, স্ত্রী বেখবর, একমাত্র সন্তানের জন্য কি করনীয় ইত্যাদি ভাবনায় দিশেহারা লোকটি উধাও হয়ে যায় একদিন। পরে শোনা যায় কবে কোথায় যেন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে সে। তবে এই খবরও সঠিক কি না তাও রহস্যে ঘেরা।
পিসীকেই মা জেনে আঁকড়ে ধরে বড় হয়েছে মা-বাবাহারা অভাগা ছেলেটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে পিসী এক সন্ধ্যায় তাকে তার মায়ের ঘটনা শুনায়। ‘এমন পাষাণী মা বিশ্বসংসারে হয়না!’ ‘তার কোন খবর জান পিসী?’ ‘নাহ। কেন খবর জানলে যাবি নাকি দেখা করতে? শোন সে ছিল জাতে মুসলমান; মুসলমান নারী-পুরুষ সবাই বিয়ে ভাঙ্গতে পারে আবার বিয়ে করতেও পারে। শুনেছি সে বদ-মেয়েটা বিদেশে কাকে বিয়ে করে যেন সুখে আছে তবে স্রষ্টা তাকে এমন শাস্তি দিয়েছেন যে আর সন্তানাদি হয়নি’। সব শুনে আইভি বললো ‘অদ্ভুত ঘটনাতো! তা আমার কাছে কি কারণে?’ ছেলেটি হাতের ব্যাগ খুলে একটি সাদাকালো ছবি বের করে আইভির হাতে তুলে দিল। একটু সময় মন দিয়ে দেখে আইভি ছবিটা চিনতে পারলো। তাদেরই ছাত্রজীবনের একটি গ্রুপ ছবি। তাদের সময়ের ঝড়-তোলা প্রেমিক জুটি অরুণ-আরিফাও আছে এতে। একজনের মুখের উপরই গোল করে ঘুরিয়ে কলমের দাগ। জিজ্ঞাসু চোখে ছেলেটির দিকে তাকালো। ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে ছেলেটি যা বললো তাতে আইভি হতভম্ব। ‘আপনি সবাইকে চিনতে পেরেছেন তো?’ ‘হ্যাঁ চিনেছি’ ‘পিসী বলেছে কলম দিয়ে দাগ দেয়া মুখটাই হচ্ছে আমার মায়ের মুখ’ ‘আর তোমার বাবা কি বলেছেন?’ ‘বাবাতো মারা গেছেন আমার বয়স যখন দেড়-বছর আর পিসীও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন গতবছর’ ‘তুমি কি বিষয়টার সত্যতা যাচাই করবে না?’ ছেলেটি আবেগময় বিষাদ নিয়ে বললো ‘ভয় পাবেন না। আমি অভিযোগ, অনুযোগ কোনটাই করছিনা, মায়ের কাজের বিচারও করবো না, আপনাকে মা হিসাবে ভালবাসি শুধু এটুকু জানাতে এসেছি’ পায়ের নীচে ভূ-গোলক দুলে উঠলো আইভির। একটি সন্তানের জন্য আইভির মনে আকুতি ছিল বরাবরই। বিয়েও করেছে দু'তিনটে। গর্ভে সন্তান আসেনি কখনোই। গর্ভবতী নারীর কষ্ট-যন্ত্রণা অনুভব করা বা তার পৃথিবী কি সুখে উথালপাথাল হয় তা জানা হলো না এই জীবনে। অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় থেকে থেকে কোন স্বপ্নের জাল বোনা হলোনা তার। তার অঙ্গ মাতৃত্বের গর্বে বিরাট বিশাল হওয়ার সুযোগ পায়নি, সন্তানের আগমনী জানাতে বক্ষদেশ সুধায় স্ফীত হয়নি কোনদিন। আজ আরিফা ও অরুণের সন্তান তাকে একি সংবাদ দিচ্ছে? একি অবাক কাণ্ড! তবে এই সত্য হোক চিরন্তন। একে কোনদিন ভেস্তে যেতে দেবেনা আইভি। পালাচ্ছে সে পরিচিত জনদের কাছ থেকে, পালাচ্ছে চেনাজানা পরিবেশ থেকে। অন্য কোথা, অন্য কোন জনপদে। সেখানে তারপর যা জানার তা জানবে শুধু সে আর ওই ছেলেটি। এই ছেলের সাথে তার যে বন্ধন তা হবে অবাস্তব এক নাড়ীর বন্ধন। অমরাবতীর অনিলে বয়ে আনা অলৌকিক বন্ধন।
*মেলবোর্ন থেকে প্রকাশিত ‘সংকলনে’ ২০১৮তে প্রথম প্রকাশ
|