bangla-sydney












গল্প
মায়াবী মিথ্যা
দিলরুবা শাহানা



সুপারি পাতার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ব্যালকনীতে। কিছু কিছু মেঘও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আকাশের গায়ে। তাতে ক্ষণে ক্ষণে মেঘের ঘোমটায় মুখ ঢাকছে চাঁদ আবার কখনো ঘোমটা সরিয়ে আলোর হাসি ছড়াচ্ছে। ঐশী এসে দাঁড়ালো ব্যালকনীতে। ওর মুখেও আধো আলো আধো ছায়া খেলে যাচ্ছে। ওর চোখে পানির বিন্দু চিক চিক করছে। কি জন্য এই কান্না? ঐশীর একটি মাত্র ভাই ইমন, কাল বিদেশ চলে যাচ্ছে, তাই কি তার চোখে কান্না উথলে উঠছে? নাকি মায়ের ছবি দেখে, মায়ের প্রতি করা অবহেলার কথা ভেবে ঐশীর চোখ ভিজে উঠছে? খালার প্রতি অহেতুক কঠিন ব্যবহার করার জন্য অনুশোচনার কান্নাও হতে পারে হয়তো। কে জানে, হয়তো সবকিছু মিলেই ওকে এই মুহূর্তে কান্না-কাতর করে তুলেছে সময়। কখনো কখনো মানুষের আচরণ বা অনুভূতির প্রকাশ অন্যের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। কখনো নিজের কাছেও তা অবোধ্য থেকে যায়। কোন বেদনায় হৃদয় উথালপাতাল হয় তা ব্যক্তি-মানুষটি নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। কবির ভাষায়, ‘কেন অকারণ বেদনা ঘনায়……’। তার মানে অকারণেও বেদনা ঘনাতে পারে। তবে এই মুহূর্তে ঐশীকে ঘিরে যে দুঃখ ঘনিয়ে এসেছে তা অকারণে নয়।

বিকালে ইমন যখন একটা সাদা-কালো ছবি ওর হাতে দিয়ে বললো ‘বুবু, ছবিটা সুটকেসে দিয়ে দিও। আমি এর কপি তৈরি করে তোমাকে পাঠাবো কেমন।’
ইমনকে বিদায় জানাতে ওদের খালা এসেছেন একটু আগে। তিনি হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিয়ে বললেন -‘দেখি কার ছবি’
ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ইমন বললো, মা’র সাথে আমার ছবি খালা।
ছবিটা দেখে খালা বললো, ‘শোন ঐশী ইমনের মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। এটা তো বুবু’র সাথে তোর ছবি!’
খালার হাত থেকে ছবিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে ঐশী দরজার দিকে তাকায়। ইমন কি শুনে ফেললো! সে তড়িঘড়ি ছবিটা ইমনের সুটকেসে ঢুকিয়ে দেয় যাতে আবার কেউ এই ছবির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মেতে না উঠে। তারপর গম্ভীর মুখে সংসারের অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ঐশী-ইমনের খালা বহুদূর থেকে আদরের টানেই বিকালে এসে পৌঁছেছেন। এসেই এমন ব্যবহার পেয়ে একটু মন খারাপ করলেন! ইমন স্কলারশিপ নিয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশ। কবে ফিরবে কে জানে। আর কোনদিন বোনের ছেলেটিকে দেখতে পাবে কিনা তাও অনিশ্চিত। তিনি মনমরা হয়ে বসার ঘরে টিভির সামনে চুপচাপ বসে রইলেন। টিভি চলছিল। তবে খালা আনমনে স্মৃতির দরজা খুলে সে রাজ্যে ঢুকে পড়লেন। কেউ দেখলে ভাববে উনি টিভি দেখছেন।

মনে পড়ছে বাইশ বছর আগের কথা। ইমনের জন্মের সময়ে ঐশীর বয়স পাঁচ কি ছয় ছিল বোধ হয়। ওদের বাবা অল্প কিছুদিন আগে চাকুরী নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিলেন। ইমন তখন পেটে। ওরা নানা বাড়ীতে ছিল। কথা ছিল বাচ্চা হওয়ার পর সাকেরা’বু দুই বাচ্চাসহ স্বামীর কাছে চলে যাবেন। তারপর কি যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো ইমন জন্মের পর। ওদের মা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। ছেলেকে ভাল করে কোলেও নিতে পারেনি বেচারি। ইমন জন্মের মাস খানেক পর একদিন ওর মা মাথা ঘুরে পরে জ্ঞান হারান। এ্যাম্বুলেন্সে করে সাকেরা’বুকে হাসপাতালে নেওয়া হল। ওটাই ছিল তার শেষ যাত্রা।

লাশ বাড়ীতে আনা হয়নি আর। হাসপাতাল থেকেই মসজিদ হয়ে তাকে গোরস্থানে দাফন করা হয়। কী দুঃখজনক উদাসীনতা ছিল ওদের মায়ের প্রতি, তা স্বীকার করতেই হবে। বাড়ীতে তখন বড় মামী গর্ভবতী, নানী অসুস্থ। ঐশী-ইমন ছোট্ট, তাদের ঝামেলা। নিরীহ নানী তবু মৃদু স্বরে লাশ বাড়ীতে আনার কথা বলেছিলেন। তার মেয়েকে তিনি নিজে একবার দেখতে চান তাও বলেননি। শুধু বলেছিলেন ঐশীকে একবার দেখানো গেলে ভাল হতো। ঐশীর মামারা বোনের মৃত্যুতে দুঃখিত হয়েছিলেন তবু বাস্তবতার কথা তুলে তারা ঐশী-ইমনের মায়ের লাশ বাড়ীতে না আনার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঐশীর খালা শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে আসেন। দাফনের জন্য লাশ এর মাঝেই গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনে তিনি তক্ষুনি ঐশীকে কোলে নিয়ে গোরস্থানের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। মফস্বল এলাকায় মেয়েদের গোরস্থানে প্রবেশ নিষেধ। লাশ দেখা হয়নি। তবে অনেক কান্নাকাটি ও কাকুতি মিনতির পর ছোট্ট ঐশীকে নিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়াদরুদ পড়ার সামান্য সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। পরদিন গিয়ে একটা শিউলি ফুলের চাড়া ঐশীর হাত দিয়ে কবরের শিয়রের কাছে পুতে দিয়ে এসেছিলেন।

বাড়ী ফিরে দেখেন বাহরাইন থেকে একজন অতিথি এসেছেন কিছু উপহার নিয়ে। তার সাথে একটা ক্যামেরা ছিল। ঐশীর বাবা পাঠিয়েছেন বাচ্চাদের ছবি তুলে আনার জন্য। ক্যামেরা দেখে ঐশীর মামী বলেছিলেন, ‘আহারে বাচ্চাদের সাথে মায়ের কোনও ছবি তোলার সুযোগ হলোনা।’
খালা মন খারাপ করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের তো ক্যামেরা ছিল ভাবী, এক মাসে একটা ছবি তোলা গেলনা?’
সেদিন মামীর মুখে কোন উত্তর ছিল না। সবাই চুপচাপ। সেই মুহূর্তে নীরবতা ভেঙ্গে ঐশীর নানী বলেছিলেন, ‘থাক ঐশীর সামনে ওইসব কথা তোলার দরকার নাই ও কষ্ট পাবে’।
কথাটা মনে আছে বলেই খালা জানতেন ওটা ইমনের ছবি না। তাতেই ঐশীর এই অদ্ভুত আচরণ। মা-হারা বাচ্চাদের মনে কি বোধ খেলা করে কে জানে?

রাতে চাঁদের আলো-ছায়ায় ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে, ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবছিলো ঐশী। মায়ের মৃত্যুর পর ঐশী-ইমন বছর তিনেক নানী বাড়ীতেই ছিল। মামা-মামী, নানীর সাথে কেটেছে সময়টা। তিন বছর পর ঐশীর বাবা নতুন করে চাকরীর চুক্তি নবায়ন করেন নি। ফিরে এসে মিউনিসিপালিটিতে তার আগের কাজে যোগ দেন। মামাবাড়ি ছাড়ার সময় ঐশীর বয়স আট আর ইমনের তিন। বাবা শহরের প্রান্তে আগে কেনা একখণ্ড জমিতে ছিমছাম এক বাড়ী বানালেন। আর বিয়ে করেননি তিনি। ঐশীর নানী ও দাদী ওদের সাথেই ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

নানী বাড়ীতে থাকার সময় মামীর আচরণে আদর-অনাদর কোনটাই তেমন মনে পড়ে না। হয়তো বা সে মনেও করতে চায় না। বাবা বলতেন মানুষের কাছ থেকে ভাল যেটুকু পেয়েছো তাই মনে রাখবে, মন্দটুকু ভুলে যাবে, তাতে কষ্ট পাবে না কখনো।

এই খালাই প্রতি মাসে একবার অনেক মজার খাবার আর জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন। নানীই ইমনকে ছোটবেলায় গোসল করাতেন। খালা যখন আসতেন তখন ঐশী-ইমন ও মামাতো ভাই আরমানকে ভাল করে গা-মাথা ঘসে গোসল করাতেন। নানীর চুল ধুইয়ে, নখ কেটে ঝকঝকে করে দিতেন।

একবার মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে মামীর সাথে আরমানের অনেক ছবি দেখে ইমনের মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছিল। তারপর অদ্ভুত এক অচেনা গলায় জানতে চেয়েছিল, ‘বুবু, মায়ের সাথে আমার কোন ছবি নাই?’
ঐশীর মুখে কথা জোগালো না, চুপ করে ছিল সে।

পরে মার সাথে নিজের ছবিটা পেয়ে ঐশী ইমনকে বলেছিল এটা মার সাথে তোমার ছবি। ছবিটা দেখে খুব খুশী হয়েছিল ইমন। বাবা মায়ের সাথে ঐশীর কিছু ছবি ছিল তবে মায়ের সাথে ইমনের কোন ছবি নাই ভাবলে ঐশীর কষ্ট বাড়ে।

ছবি নিয়ে ইমনকে মিথ্যে বলার কথা বাবাকে চুপি চুপি বলেছিলো ঐশী। মিথ্যা বলতে তার ভয়ও করেছে এটাও সে বাবাকে জানিয়েছিলো। বাবা বলেছিলেন,
‘যে মিথ্যা কারো ক্ষতি করে না সে মিথ্যাতে কোন দোষ নাই, তাতে কোন পাপ হবে নারে মা’।
আজ এই সুন্দর মিথ্যা ভেঙ্গে সত্য বেরিয়ে এলে ইমন খুব কষ্ট পেতো। ইমনের কষ্ট ঐশীকেও কাঁদাতো। খালার সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করে খারাপ লাগছে সত্যি। তবুও ঐশী এই সুন্দর মিথ্যাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে আঁচ করে ঐশী। তার কাঁধে কারো আলতো হাতের ছোঁয়া। চোখের পানি মুছতে মুছতে ফিরে তাকায় ঐশী। ওর স্বামী ওর ঝরে পড়া চোখের পানির শেষ বিন্দু আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বললো, ‘ছি কাঁদেনা ঐশী তাতে ভাইয়ের অমঙ্গল হবে’।




দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া





Share on Facebook               Home Page             Published on: 11-Feb-2024

Coming Events: