গল্পকনিকা ২ দিলরুবা শাহানা
হি টুক অপিয়াম এন্ড ডাইড
ইংরেজের ম্যাজিস্ট্রেট*। তদন্তে এসেছেন। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। জায়গাটা মুর্শিদাবাদের কান্দি বা মাদারীপুরের ভাঙ্গা। দুটোর একটা হবে। দুই জায়গাতেই ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করেছেন। ইংরেজ শাসকেরা ভগৎ সিং, ক্ষুদিরামকে ততদিনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে চিরদিনের জন্য শ্বাস রুদ্ধ করেছে। কারণ তারা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চেয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের সব জানা। দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ লোকটি ম্যাজিস্ট্রেট। ইংরেজি আর গণিতে ডাবল এম এ। অবয়ব যার আর্যের সমতুল্য এই সেই ম্যাজিস্ট্রেট। ইংরেজরা ছোটখাটো, ময়লা রং এর লোকদের ম্যাজিস্ট্রেট বানিয়েছে কদাচিৎ।
এই ম্যাজিস্ট্রেট দেখতে যেমন ইংরেজ সাহেবদের মতো তেমনি তাদের মতই ক্ষুরধার তার বুদ্ধিমত্তা। এখানে জমিদারবাড়িতে বন্দুক রয়েছে। আর কারও লাইসেন্সওয়ালা বন্দুক নাই। ইংরেজের ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের স্বার্থে জানতে চাইলেন -
কি করে মরেছে লোকটি? সমবেত সবারই উত্তর ছিল গুলি খেয়ে মরছে। জমিদারের চোখে ম্যাজিস্ট্রেট পলকে তাকালেন। কেমন লোক ছিল সে? ভয়ার্ত কণ্ঠে উত্তর হুজুর সে ভিনদেশী, আমরা তাকে চিনি না জমিদারবাবু বললেন ইদানীং এদের উৎপাতে অস্থির... কথা শেষ করলেন না। সবাইকে বিদায় দেওয়া হল। জমিদার শঙ্কা নিয়ে জিগ্যেস করলেন লাল পাগড়ি এসে প্রজাদের ধরপাকড় করবে নাতো? বন্দুক আছে আপনার; প্রজাদের ধরবে কেন? উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণসন্তান জমিদারের দুধ-সাদা রং লাল হয়ে উঠলো। দেরাজ খুলে ছোট্ট এক পুটুলি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন - গুলিটা আমার বন্দুকের না ভয় পাবেন না। আচ্ছা আপনার এলাকায় লোকেরা নেশা-ভাঙ্গ করে কি? গরীব মানুষ এরা; ভাত জোটেনা, নেশা করার পয়সা কই? তামাক বিড়িও টানে না? তা ওইটুকু বিলাসিতা করে অবশ্য, কেউ কেউ আবার মাঝেসাঝে খায় গুলি গুলি কি? মসুরি ডালের সমান ছোট্ট আফিমের বড়ি যাকে এলাকার লোকেরা বলে গুলি এটা কেন খায়? শরীরের ব্যথাট্যথা নাকি কমে
সাহেবদের মতো দেখতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবি কেতায় তদন্তের নিরপেক্ষতার স্বার্থে জমিদারের আদর আপ্যায়ন বিনয়ের সাথে এড়িয়ে গেলেন। খানদানী মুসলমান পরিবারের সন্তান ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। তারও খুব কষ্ট হয় দেশের বাতাসে শ্বাস নিতে। পরাধীনতার গ্লানিতে পীড়িত হওয়া বড় দুঃখের। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ভাবছিলেন আর ভাবছিলেন। ইংরেজরা ভারত থেকে চীনদেশে আফিম পাঠিয়ে দারুণ ব্যবসা করছে। চীনা গোটা জাতটাকেই এরা আফিম খোর করে তুলেছে। কি অবাক কাণ্ড এখানেও এখন কোন কোন দরিদ্র মানুষ ওষুধ মনে করে আফিম খাওয়া ধরেছে। ভাবনা হোঁচট খেল যখন ঘোড়া থামলো ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসের সামনে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দপ্তরে এসে বসলেন। তদন্ত রিপোর্ট যত্ন করে লিখতে শুরু করলেন। বক্তব্য শেষে মৃত্যুর কারণ লিখলেন he took opium and died. ইংরেজের ম্যাজিস্ট্রেট কাকে বাঁচালেন? জমিদার বাবুকে ইংরেজ প্রভুদের অবিশ্বাস থেকে নাকি প্রজাদের ইংরেজের লালপাগড়ি পুলিশের অত্যাচার থেকে? নাকি স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বিপ্লবী একজনকে?
(*আজ থেকে ২১/২২ বছর আগে লন্ডনে আগস্টের এক সন্ধ্যায় খান বাহাদুর আবু আলী চৌধুরীর ভাগনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর মুখে আবু আলী চৌধুরীর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার ঘটনাটি শুনা।)
এখনও মানুষ চেনা বাকী
ভীষণ অস্বস্তি শুরু হল। সামান্য ভুলে এমন কাণ্ড হয়েছে। ভুল মানুষের হয়ই। তবে এমন ভুল না হওয়াই ভাল। যে ভুলের কারণে কেউ কাউকে ঠকবাজ, ধাপ্পাবাজ ভাববে সে যতো ছোট ভুলই হউক লজ্জাজনক অবশ্যই। এখন যাচ্ছে ভুল শুধরাতে। সেদিন লোকটির বদান্যতায় বিস্মিত হয়েছিল। যারপর নাই কৃতজ্ঞ বোধ করেছিল। কথা ছিল ঐদিন বিকালেই সে যাবে। মাথা থেকে সব মুছে গেল। যাওয়ার কথা মনেও পড়েনি আর। সাতদিন পর আজ মনে পড়লো। তাও বৃষ্টি পড়া শুরু হল বলে। ছাতার দিকে নজর গেল বলে। তখনি সব মনে পড়লো। দোকানীর হাসিখুশি গোলগাল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মাথায় যেন হাতুড়ির ঘা পড়লো। সে নিজে মানুষটা হয়তো কালো তবে মনটা তার বড় সাদা। সাদা মনে কষ্টটা বেশীই লাগে। কিভাবে ভুলে গেল। বিশ্বাস করে একজন সাহায্য করলো আর সে কিনা প্রতিশ্রুতি রাখলো না। সেদিনও এমনি বৃষ্টি শুরু হল। স্টপেজ থেকে দশ পনেরো মিনিট হাঁটতে হবে। বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করার মতো সময়ও হাতে ছিল না। ঝটিতে স্টপেজের কাছে দোকানে ঢুকে ছাতাটা পেয়ে গেল। দাম দিতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। ক্রেডিট কার্ড নেবে না। নগদ যা হাতে ছিল তাতে ছাতার দাম হয় না। তার করুন অসহায় চেহারা দেখে দোকানীর কি হল কে জানে। সে আচমকা বলে উঠলো -
ঠিক আছে যা হাতে খুচরা তাই দাও বাকীটা ফেরার পথে দিয়ে যেও।
ছাতাটা ছিল বলে ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এদেশে অচেনা অজানাকে দোকানদার বাকীতে কখনো কিছু দিয়েছে বলে শুনেনি। শুধু এদেশ কেন কোন দেশেই বা দেবে? দোকানীর উদারতায় সে আপ্লুত হল। কি কাণ্ড। ফেরার পথে সব ভুলে গেল। ঐ স্টপেজ থেকেই ফেরার বাস ধরলো। খুচরা পয়সাও ছিল। দোকানীর কথা একবারও তার মনে পড়েনি।
আজ এক সপ্তাহ পর বৃষ্টির সাথে সব কথা মনে পড়লো। এখন অস্বস্তি, লজ্জা সব ছেকে ধরেছে। বুকটা ধড়ফড় করছে। দোকানী কি ভাবছে সে অসহায়ের ভেক ধরে ঠকবাজী করেছে। কপাল কুচকে তাকাবে। চোখে সেই সাথে থাকবে রাগ আর বিরক্তি। মুখে কিছু বলবে না এরা। আচরণে নীরব তাচ্ছিল্য থাকবে। সামান্য ভুলের জন্য এই অপমান হজম করতে হবে। দোকানে পা রাখতে তার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। কি অপমান হজম করতে হবে কে জানে? দূর থেকে দেখলো দোকানী ক্যাশকাউণ্টারের সামনে দাঁড়ানো এক ক্রেতার সাথে কথা বলছে। সে সরে যেতেই তার উপর চোখ পড়লো দোকানীর। তারপর ঘটলো আশ্চর্য সে ঘটনা। বিরাট এক চাঁদের হাসি ছড়িয়ে দোকানী বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো
-ওহ্ ডিয়ার! তিনটা ডলার ফেরত দেওয়ার জন্য এসেছ। তুমিতো দারুণ মানুষ!
থানা থেকে বলছি
-খোকা শোন্ -whats up মা! -আমি থানায় বসে আছি ওপাশে আতংকিত কণ্ঠ -কোন এক্সিডেণ্ট হয়েছে কি? -না খোকা না, সামান্য একটা ঝামেলা হয়েছে তবে মনে হচ্ছে এখনই মিটে যাবে -কি ঝামেলা মা? তোমার ব্যাগ কেড়ে নিয়েছে কেউ? -ঐ রকমই সামান্য ঘটনা তবে আমি তোকে ফোন করেছি পুলিশকে ভয় দেখানোর জন্য ছেলে হাসবে কি কাঁদবে বুঝে উঠার আগেই মায়ের প্রসন্ন গলা -আমি পুলিশকে বলেছি I will not utter a single word without my lawyer বুঝলি, পুলিশই নম্বরটা ডায়াল করে তোকে দিল, তোর ল ফার্ম এর নাম দেখেই ওরা কেমন একটু সংকুচিত, তবে ভয়ের কিছুই নাই মহিলার হুস ফিরে এসেছে আমাকে এখনই ছেড়ে দেবে - -মহিলা কে, হুস কি আর তুমি কি আন্ডার এরেস্ট? -হুস মানে সেন্স। বাংলাটাও বুঝিস না! না আমি আন্ডার এরেস্ট নই, উইটনেস মানে সাক্ষী হিসাবে আটকে রেখেছে একটু সময়ের জন্য। -কোন পুলিশ স্টেশন বলতো? -বড় হসপিটালের উল্টা দিকে যেটি ঐখানে বসে আছি। -আমি আসছি। বলেই ঝট্ করে রিসিভার রেখে দিল। ছেলে থানায় গাড়ী ঢুকাতে ঢুকাতে দেখে তার মা রাস্তায় ট্রাফিক সিগনালের কাছে দাঁড়িয়ে। রাস্তা পার হওয়ার জন্যই চারদিক দেখছে মনে হল। সে থানায় গাড়ী পার্ক করে মায়ের পিছনে এসে দুই হাত মায়ের দুই কাঁধে রাখতেই মা চমকে তাকালো -কই যাচ্ছো? -হসপিটালে মহিলাকে দেখে যাই একটু -গাড়ীতে উঠো, মুখতো শুক্না খাওনি কিছু? গাড়ীতে উঠতে উঠতে মা বললো -কফি, ভেজি স্যান্ডউইচ উইথ এাভোকাডো, রয়াল আইসিং দেয়া ক্যারট কেক খাইয়েছে। বাড়ীর পথে চলতে চলতে ছেলে পুরো ঘটনা শুনলো। বাসায় পৌঁছে বললো -মা এই রকম পরোপকারে আর জড়াবে না কেমন, মহিলার সেন্স না ফিরলে এখনও থানায় বসে থাকতে হত, যদি মারা যেতো কি হত? জেলে ঢুকাতো প্রথমে। -একলা মহিলা থাকে। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নাই। মর্নিং ওয়াকে দেখা হত। কোথায় থাকে তাও জানি না। -ছেলেমেয়েরা ঘটনা শুনেছে? -শাড়ী পরে হাঁটতে আসতো তাই বেশী মায়া লাগলো। অধৈর্য হয়ে ছেলে গলা উঁচু করলো -আপনজনরা খবর পেয়েছে কি? - পুলিশ ক্যানবেরাতে মেয়েকে খবর দেয়; মেয়ের জন্মদিনের কার্ড পোস্ট করবে বলে পোস্টঅফিসে যাচ্ছিল ঐ এনভেলপে ঠিকানা দেখেই... -রাস্তায় ফিট হয়ে পড়া মহিলাকে হসপিটালে নিয়ে গেছ, ট্যাক্সি ডাকলে কিভাবে? -ট্যাক্সি নাতো, ওই যে রাশান ইরা যাচ্ছিল আমাকে দেখে গাড়ী থামালো, তারপর দুজনে মিলে টেনে হিঁচড়ে গাড়ীতে তুলে নিয়ে যাই। -মহিলা মারা গেলে কি হত ভাবতেই পারি না! থানা থেকে ফোন করে তুমি পুলিশকে না আমাকে, হ্যাঁ আমাকে ভয় দেখিয়েছো।
পয়সায় কেনা
হিথরো বিমানবন্দর থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নর্থ লন্ডনের ইষ্ট ফিঞ্চলিতে পৌঁছে বড় ভাল লাগল। এর আগে প্রতিবার গাড়ীতে এসেছে। এবারই নিজে নিজে এতোটা পথ আসা। ইংরেজরা দারুণ জাত। কি রকম সুযোগ সুবিধাই তৈরি করেছে। কি সস্তায় নির্বিঘ্নে আসা গেল। তার নিজের প্রত্যয় ধীরে ধীরে বেড়েছে। বাড়বেই নাই বা কেন? পড়াশুনার কারণে থাকা হয়েছে কিছুদিন। তারপরও অফিসের কাজে যাতায়াত করেছে দু'একবার। আত্মীয়স্বজন এখানে আছে বলে লন্ডনে হোটেলে থাকতে হয় না। এতে পয়সার সাশ্রয় যেমন হয় তেমনি যোগাযোগের ফলে আত্মীয়তাও গভীর হয়। প্রতিবার তার ভাবী সানন্দে অতদূর হিথরো থেকে ড্রাইভ করে নিয়ে আসেন। আজ কি কাজে আটকে পড়েছেন। তার বলে দেওয়া পথ অনুসরণ করে ঠিকমত পৌঁছে গেল।
আরও ঘণ্টা দেড়েক সময় অপেক্ষা করতে হবে। রাস্তার পাশে দোকানগুলো দেখলো ঘুরে ঘুরে। হঠাৎ কি মনে হল কেমিস্ট শপে ঢুকে একটা হ্যান্ড লোশন কিনলো। এই দেশে খুব দরকার। পাশে একটা চুল-সজ্জার সেলুন। সময় কাটানোর জন্য তাতেও ঢুকলো এবার। চুল ধুয়ে, শুকিয়ে, ফাঁপিয়ে দিতে বিশ পাউন্ড। কি মনে হল বিশ পাউন্ড খরচ করে আয়েসে চুল ধুবে ঠিক করলো। এই দেশে টিপস্ দিতে হয়। দুই পাউন্ডের কয়েনও আছে। কাউণ্টারে গিয়ে বলতেই লাল ঠোঁট, সোনালী চুল সাদা এক মেয়ে তার কাজ পেল। চুলের যত্ন শুরু হল। ভালই লাগছিল প্রথমে। স্বস্তি ও আরামে চোখ বন্ধ করে রইলো। ধুয়ানোর শেষে শুকানোর পালা। এবার যেন স্পর্শের মাঝে রুক্ষতা। মনে পড়লো দেশের লিভিং ডলের মাহমুদার চুল ধুয়ানোর কাজে অন্তরের যত্ন থাকে।
সবশেষে টিপসটা নিল ঠিকই কিন্তু ধন্যবাদের বালাই নাই। মাথাটা ঠাণ্ডা হল ঠিকই কিন্তু মনটা খচখচ করছিল। ভাবী শুনে বললেন -
পয়সা দিয়ে কেন বিরক্তি কিনতে গেছ। ওই লালঠোঁট টিয়াপাখির কাছে সহজে কেউ যায় না এমন নচ্ছার সে।
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|