‘মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে’ দিলরুবা শাহানা
আমান কাজ শেষে লন্ডন শহরটা ঘুরতে বের হল। সঙ্গে সদ্য পরিচিত বন্ধু নীরাজ। দু’জনই স্বদেশের বাইরে ভিন আবহে ভিনদেশী ভাষা শিখে বড় হওয়া মানুষ। একজন নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে অনেক দেশ ঘুরে বর্তমানে অষ্ট্রিয়াতে থিতু হয়েছে। আরেকজন আমেরিকাতে প্রায় তিন পুরুষ ধরে আছে। কর্মসূত্রে তারা মাদ্রিদ ও লন্ডনে এসেছিল। বিশ্বায়নের যুগে প্রায় সব বুদ্ধিমান মানুষই দুই তিনটা ভাষা রপ্ত করে নিতে সচেষ্ট। এরা দুজন এই নতুন হাওয়ায় পন্থী। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় যেন গ্লাইড করে যাচ্ছিল আমান আর নীরাজ। নীরাজ জার্মান জানে সে জার্মান ভাষায় বললো -চল টিউবে ঘুরবে নাকি লন্ডন বাসে চড়বে এই নিয়ে টস করে দেখি আমান জার্মান এবং স্প্যানিশ দুটো ভাষাতেই উত্তর দিল -তাই হোক
দেখা গেল টসে উঠেছে বাসে চড়া। আমান ভাবলো দোতলা বাসে বসে ঘুরে ঘুরে শহর দেখা মন্দ হবে না। নীরাজ বললো -বাসই সই, রাস্তায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট দেখলেই নেমে পড়বো আর অনিয়ম ভাজি, তন্দুরি চিকেন, ডাল মাখনী খাব -ওটা কি ডাল মাখ্খানী নয়? -ওহ্ নো; খুব বেশী মাখন ঢেলে ডালটা রান্না হয় তাই একে বলে ডাল মাখনী -তবে পশ্চিমা দেশে ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে ক্রিম ঢেলে রান্না হয় এই ডাল। -বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট আছে নাকি? নীচের ঠোঁট কামড়ে এমন এক ভঙ্গিতে তাকালো আমান যার মানে হচ্ছে ‘দাড়া দেখাচ্ছি তোকে’। বাস চলছে, চলেই যাচ্ছে। চলন্ত বাস থেকে দু’পাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ আমান উঠে দাঁড়ালো। নীরাজ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। আমান ইশারায় বুঝালো সামনের স্টপেজে নামতে হবে।
আমান হাঁটছে নীরাজও তাকেই অনুসরণ করলো। নীরাজ জেনেছে আমানের জীবনের একটা সময় এই লন্ডন শহরেই কেটেছে। ছেলেটি এই শহরের গলিঘুঁজি সব চেনে। ওর পিছু নিলে সঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে। ক্ষুধার্ত নীরাজ ভাবলো এই মুহূর্তে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টই হবে সঠিক গন্তব্য। আবার ভাবলো সঠিক জায়গা যে কোনটা কপালে লেখা আছে তা কেউই কি জানে। ওরা পৌঁছালো ব্রিক লেনে। রাস্তাঘাটে এন্তার বাংলায় লেখা। রাস্তার নামগুলো পর্যন্ত ইংরেজির পরেই বাংলায়ও লেখা।
নীরাজ হতভম্ব হল যখন জানলো সব বাংলায় লেখা। -আরে বাপ! এই এলাকাটাকে বঙ্গাল মুল্লুক বানিয়ে ফেলেছে একেবারে -হু হু এখন বোঝ রেস্টুরেন্ট এখানে কাদের, ঐ দেখ পাপাডাম হাতে সাদা সাহেব। শোন এই এলাকাতে ইংরেজ সাহেব ও ইউরোপিয়ান টুরিস্টরা দলবেঁধে আসে ইন্ডিয়ান ফুড খেতে। -বুঝলাম ভাই সবই, এখন চলতো কিছু খাই গিয়ে।
পাপাডাম মানে পাঁপরভাজা দিয়ে খাওয়া শুরু মাঝখানে তন্দুরি চিকেন হ্যানো ত্যানো খেয়ে শেষ হল গুলাব জামুন দিয়ে। নীরাজ বললো -খুব মজা আমান। কাল এখানে আবার আসবো বাংলাদেশী খাবার খেতে। আমান সিলেটী মালিকের সাথে বাংলাদেশী খাবার কি পেতে পারে জানতো চাইলো। ভদ্রলোক খাঁটি সিলেটীতে শুরু করলেন -ও সাব আফনে চাইলে ইছার শুটকিদি বাইগন করিয়া দিমুনে, আর বাংলাদেশের মজার খুশবুওলা বে প্রন দিয়া ইংলিশ স্পিনাচ। ইটা অইলো গি পালংশাক-প্রনের খুব মজার ডিস; বাট বিট ডিয়ার।
লোকটি চমৎকার ইংরেজিতে কথা গুলো নীরাজকেও বললো। নীরাজ বললো -হউক দামী তবে ইংলিশ স্পিনাচ উইথ ফ্ল্যাভার্ড বে প্রন মনে হচ্ছে খুব মজা আর ড্রাই শ্রিম্প দিয়ে বেগুনও ভাল হবে। আমরা আবার কালকে আসবো ঠিক আছে শেফ। আসতে আসতে নীরাজ বললো -লোকটার ইংরেজী তো খুব চমৎকার। -জান ও একদম লিখতে পড়তে জানে না। তবে ওর গ্র্যান্ডডটার লন্ডনে কোর্টের জাজ আর গ্র্যান্ডসন বিবিসির জন্য ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানায় -ওয়াও! হোয়াট এন এ্যাচিভমেন্ট! ফেরার পথে ওরা টিউবে(পাতাল রেলে) আসবে ঠিক করলো। মেশিনে টিকেট কাটতে গিয়ে আমান স্তব্ধ হয় একটা বিষয় দেখে। একটু বেশী সময়ই বোধহয় সে মেশিনটার দিকে তাকিয়েছিল। নীরাজ পিছনে এসে দাঁড়ালো। মেশিনে চোখ পড়তেই নীরাজ প্রায় চেঁচিয়ে উঠার মত গলায় বলে উঠলো -ওহ নো এখানেও তোমার বাংলা ভাষা!
 -হ্যাঁ নীরাজ এটাকে বলা যায় বাংলাভাষীদের বিরাট এ্যাচিভমেন্ট। ইংল্যান্ডে পাতাল রেলে বাংলাভাষায় ইন্সট্রাকশন লেখা হয়েছে শুধু বাংলাভাষীর জন্য জান। -তুমি কি তোমার বাংলা ভাষাটা জান আমান? আমি ইংলিশ, জার্মান, স্প্যানিশ জানি তবে আমার মায়ের ভাষা জানি না। - মা যখন ছিল আমাকে একটু চেষ্টা করেছিল শিখাতে। তখন আমি বেশ ছোট, ছয় কি সাত বছর আমার বয়স। -স্যরি, তোমার মা এতো তাড়াতাড়ি চলে গেছে!
আমানের চোখে বিষণ্ণতা ঘনালো। কেউ জানে না তার মায়ের কথা। কোথায় গেছে, কেন গেছে কাউকে বলে কিইবা হবে; বিচার তো পাওয়া যাবে না। অসম্ভব সংবেদনশীল, অসাধারণ বুদ্ধিমতী, অপূর্ব সুন্দরী মা ছিল আমানের। সাদাসিধা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তার মা বিয়ে হয়ে আসে বিত্তবান ব্যবসায়ী পরিবারে। যাদের ব্যবসা ছিল মহাদেশ থেকে মহাদেশে ছড়ানো। গ্রামে ফলানো, শহরে বানানো, বিদেশের হাটে বেচানো সবকাজই ছিল আমানদের পরিবারের করায়ত্ত। যত উচ্চপদই হউক চাকুরীজীবী ছিল আমানের নানা। কি পারিবারিক মূল্যবোধ, কি জীবন যাপনের ধারা, আচার আচরণের কায়দাকানুন সব কিছুতেই বাবা-মায়ের ছিল অনেক দূরত্ব। শেষ পর্যন্ত মা চলে যেতে বাধ্য হয়। ছোট আমানের কাছে গোটা বিষয়টা ধোয়াশাময় ছিল। দেশে গিয়েছিল একবার ওরা। কি ভাবে কি ভাবে যেন মাকে ছাড়াই আমান ফিরলো বাবা আর দাদীর সাথে। তখন ওকে বোঝানো হয়েছিল মা ফিরবে পরে। সচ্ছল বাবার বিরাট পরিবারে সবার মাঝে আমান ভালভাবেই মানুষ হয়েছিল। মা কবে আসবে জানতে চাইলে বাবা ও দাদী বলতো -আসবে একদিন, এখন সে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সেই একদিন কখনো আসে নি। আমানের দাদী তাকে খুব ভালোবাসতো। একবারই দাদীর মুখে মায়ের কথা শুনেছিল আমান -তুই ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে খুব ভাল হতো রে -কেন? -তুই দেখতে তোর মায়ের মতই সুন্দর তাই। আরেকবার দাদী ঘর গোছাতে গিয়ে ওর পুরনো বইখাতা সব ফেলে দেবে বলে এক জায়গায় টাল করে রাখছিল। ওর মাঝে ছিল বাংলা বর্ণমালা শিক্ষা ও আরও দু’একটা বাংলা বই, যা আমানের মায়ের ছিল। আট বছরের আমান ফুসে উঠেছিল তার বাংলা বইগুলো ফেলে দেওয়ার স্তূপে দেখে। বইগুলো তুলে বুকে আঁকড়ে ধরে বলেছিল -আমার বই, আমার মায়ের বই কক্ষনো ফেলবে না। দাদী বিরক্ত গলায় ইংরেজিতেই বলেছিল -কি হবে এসব আলতু ফালতু বই জমিয়ে রেখে, কে পড়ে ছাই বাংলা বই। আমান আগুন-রঙ্গা চোখে দাদীকে দেখেছিল মাত্র। বর্ণমালা শেখার বই থেকেই মা আমানকে একে একে অক্ষর, আ-কার, ই-কার শিখিয়েছিল। ওই শেখানো থেকেই আজও কোথাও বাংলাভাষায় কিছু লেখা দেখলেই সে বুঝতে পারে এগুলো তার মায়ের ভাষায় লেখা। মা তার সাথে নেই বহু বহু দিন, এই পৃথিবীতেও মা আর নেই সে জানে। মাঝেই মাঝেই পৃথিবীর কোন শহরে বা বন্দরে দোকানের ও রাস্তার নাম ফলকে বাংলা দেখলেই মাকে মনে পড়ে। যেন যেতে যেতে মা পৃথিবীর নানা জায়গায় গানটা গেছে ফেলে।
 দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
|