bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













করোনা কালের কাহন (২)
বাদল ও হিমেল
দিলরুবা শাহানা



বাদল ঢাকার মতিঝিলের ছোট্ট এক ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে। করোনা প্রকোপে কাজকর্ম বন্ধ। মেসও বন্ধ। ভয় নিয়ে টাঙ্গাইলে বাড়ী ফেরার আয়োজন। এলাকার অনেক মানুষ তাকে দেখলে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফালা ফালা করবে তা সে নিশ্চিত জানে। সুদিন দেখবে বলে ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের বদান্যতায় ছোটভাই হিমেলকে আমেরিকা পাঠিয়েছে। প্রায় ১৫ থেকে ২০লক্ষ টাকা খরচ করেছে তাতে। সব টাকা শোধ করতে পারেনি। তাই এই এজেন্সিতে রক্ত মুখে তুলে কাজ করে যাচ্ছে বাদল। মালিকটা খারাপ লোক নয়। বিমানের টিকেট বেঁচাই মূল কাজ এই অফিসের। তবে কর্মী ভিসা জোগাড় করতে পারলে মাঝে সাঝে দু’একজনকে আরব দেশেও পাঠায়।

বাদলের ভাই অবশ্য লেনদেনের বিনিময়ে মালিকের আত্মীয় এক কূটনীতিকের ‘হোম হেলপার’ হিসাবে গেছে। কথা হয়েছে কূটনীতিকের বাসায় কাজের পাশাপাশি রন্ধন শৈলী ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে ক্লাসও করবে সে। কূটনীতিকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিরাট। চাকরী শেষে হিমেলকে নিয়ে আমেরিকাতে একটা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খোলার ইচ্ছা। হিমেল খুব কাজের ছেলে। সেই মতো হিমেলও আমেরিকার বিদ্যা-শিক্ষায় নিজেকে তৈরি করে নিতে প্রস্তুত। তা রন্ধনই হোক বা যাই খুশী তাই হোক।

ভাইকে আমেরিকা পাঠানোর সুবাদে নিজ এলাকায় বাদলের অবস্থান প্রায় বীরের মতো হয়ে গেল। অনেকেই তার কাছে আসা যাওয়া শুরু করে। উদ্দেশ্য আমেরিকা যাওয়ার ফন্দি ফিকির জানা। পরিচিত জনদের আবদার শুনে শুনে একদিন অফিসের মালিককে কথার ছলে বিষয়টা জানালো বাদল। একটু চিন্তা করে মালিক বললো -
-আমার এক চাইনিজ বন্ধু থাকে আমেরিকায় তার সাথে কথা বলে দেখি কিছু লোককে পাঠানো যায় কিনা।
বাদল চাইনিজ টাইনীজ শুনে ভয় পেল। যারা তার কাছে আসে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পেতে চায় তারা ধনী নয়, সরল মানুষ এদের কোন বিপদ হোক তা বাদল চায় না।
একদিন মালিক জানালো কিছু লোককে স্টুডেন্ট ভিসায় হয়তো পাঠানো যেতে পারে তবে খরচ অনেক। বাদল বললো -
-স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়ার মতো যোগ্যতা ও ক্ষমতা এদের কারো নাই
-শোন, নামেই ভিসাটা স্টুডেন্ট, আসলে কাজ করবে তো ওই চাইনিজের ফ্যাক্টরিতে। মজুরের কাজ।
-ধরা পড়লে কি উপায় হবে?
-ধরা পড়বেই না, ওদেরকে দিনে বেইজমেন্টে লুকিয়ে রাখবে আর রাত্রে কাজ করাবে; কাকপক্ষীও জানবে না ওদের কথা।
ব্যথিত বাদলের বিস্মিত জিজ্ঞাসা -
-শ্রমিক না শ্রম-দাস হয়ে থাকতে হবে?
-তাই থাকতে হবে; ওরাতো হোয়াইট হাউসে গিয়ে উঠতে পারবে না।
নিজের ভাইয়ের বিদেশ যাওয়াতেই বাদল শঙ্কিত। কত কাজ ভাইটাকে করতে হয়। কি খায়. পড়াশুনাই বা কখন করে এসব ভেবে বাদলের মন কেমন করে উঠে। তাও ভাল যে বাংলাদেশের একজনের সাথে আছে। ভাত তো খেতে পায়। ইদানীং টাকা পয়সাও পাঠাতে শুরু করেছে। মা-বাবা খুশী, আত্মীয়স্বজনও খুশী। পাড়াপড়শিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাদলদের ভাগ্য দেখে। বাদল জানে কি কষ্ট ওর ভাই করছে ওখানে। তবে এইটুকুই শান্তি যে বেআইনি ভাবে যায়নি যে ওকে বের কর দেবে বা পুলিশে ধরবে।

সবার আবদার আকুতিতে দিশেহারা হয়ে এজেন্সির মালিককে আবার বললো বাদল। মালিক লোকটি খারাপ না সে বললো যে যারা ২০/২৫লাখ টাকা খরচ করতে পারবে তাদেরকে সব সত্যি খোলাখুলি বলবে। সত্যি শোনার পরও যদি তারা রাজী হয় তবেই কাজ শুরু করা যাবে। বাদল গোপনে বসে জনাকতক আগ্রহী লোককে ‘আমেরিকা অভিযানের’ বিষয়ে ভালমন্দ সব বুঝিয়ে বললো। সব শুনেও তাদের মাঝে কয় জন যাওয়ার জন্য মরিয়া। শুধু প্রশ্ন ছিল, তারা যে ওই চাইনিজের জন্য কাজ করবে বেতন টেতন পাবে তো? আর বেতন পেলে তা দেশে কিভাবে পাঠাবে?

বাদল দেখলো গরীব মানুষগুলো কি কঠিন পরিবেশে প্রায় বন্দী থেকে কাজ করবে তা নিয়ে ভয় পাচ্ছে না মোটেই। তাদের চিন্তা দেশে স্বজনদের কি ভাবে টাকা পাঠাবে। গরীবরাই তাদের বিদেশের কামাই অনবরত দেশে পাঠায় এটা শুনেছে এখন তা দেখছেও বাদল।

মালিক জানালো টাকা পাঠাতে পারবে এবং এই ট্রাভেল এজেন্সিই দায়িত্ব নিয়ে তাদের টাকা পয়সা বাড়ী বাড়ী পাঠিয়ে দেবে। কথা হল, প্রথমত: তারা তিন লাখ টাকা করে জমা দেবে। ট্রাভেল এজেন্সির প্যাডে তাদের রশিদও দেওয়া হবে। কোন কারণে যাওয়া বাতিল হলে টাকা তাদের ফেরত দেওয়া হবে।

মালিকের উপর আস্থা ও বাদলের আশ্বাসে ১২ জন মানুষ একে একে ৩লাখ করে টাকা দিয়ে গেল। মালিক আমেরিকা বাসী চাইনিজের সাথে মাঝে মাঝেই কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। এরমাঝে শুরু হল পৃথিবী জুড়ে করোনার ত্রাস। আমেরিকা যাওয়াটা বোধহয় স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে ভাবছে ওই বারো জন মানুষ। তখনই আরেক আতংকের খবর। লিবিয়াতে ত্রিশ জন মানুষকে এক আদম বেপারী গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের মাঝে ছাব্বিশজন হতভাগাই হচ্ছে বাংলাদেশী। এরা বিদেশে যাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা আদম বেপারীদের দিয়েছিল। খবর শুনে বারোজন মানুষই বিদেশ যাওয়া বাদ দিয়ে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য দেন দরবার শুরু করলো।

এর মাঝে জ্বর কাশি নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সির মালিক অফিস চালাতে পারছিল না আর। করোনার কারণে এরোপ্লেন চলাচল বন্ধ। অগত্যা অফিস বন্ধ করতে হল।
বাদলও বিপদে। অফিসের চাবির গোছা বাদলের কাছে। মালিকের করোনা হয়েছে কিনা ভেবে বাদল চিন্তিত ও ভীত। হঠাৎ বাদলের মনে হল মালিককে চাবিটা দিয়ে যেতেই হবে। ফোন করে বাসার ঠিকানা চাইতেই দুর্বল গলায় মালিক বললো
-না, না, তোমায় আসতে হবে না বাদল। তুমি একটা কাজ কর আয়রন সেফ খুলে তাতে ছয়টা কাপড়ের পুটুলি আছে তা তুমি বাড়ী নিয়ে যাও। তাতে কি আছে তুমি জান।
-আমি এগুলো নিয়ে কি করবো?
-কি করতে হবে তুমিই ঠিক করো। আমি করোনায় মরতে বসেছি আর বেশী কিছু বলতে পারবো না। শোন আমি বড় কোন অন্যায় জীবনে কখনোই করিনি আর করতেও চাইনা।
বলেই লোকটি লাইন কেটে দিল।

বাদল অফিসে এসে পুটুলিগুলি পেল। খুব সাবধানে সেগুলো সামলে নিয়ে সে বাড়ীর পথ ধরলো। এখন যত তাড়াতাড়ি বাড়ী পৌঁছাতে পারবে ততই মঙ্গল। কি করবে টাকাগুলো? তার রুজি রোজগারহীন এই দুঃসময়ে নিজেই রেখে দেবে নাকি ওই বারো জন যারা বড় আশা করে বসে আছে; তাদের অনেক কষ্টের ধন তাদের হাতে তুলে দেবে? বুঝতে পারছে না বাদল কি করলে ভাল লাগবে, মনে শান্তি পাবে।
রাস্তাঘাটে বাস গাড়ী নাইই প্রায়। স্কুটার ভাড়া করে রওয়ানা হল। লুঙ্গি গেঞ্জির বেশবাসে বাদলকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না যে সে লক্ষ লক্ষ টাকা পুরানো শান্তিনিকেতনী ঝুলিতে নিয়ে বাড়ী যাচ্ছে।
স্কুটারে বসে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হল যখন তখনি অন্ধকারে কান্না জড়িত ভাইয়ের গলা সে শুনলো
-আমার শরীরটা ভাল না ভাই।
-কি হয়েছে রে
-জানি না, ডাক্তারের কাছেও যেতে পারছি না, দোয়া কর, দোয়া কর ভাই।
তন্দ্রা টুটে গেল। চলন্ত স্কুটারে বসে বাদল অসহায় ভাবে টাকার থলে আঁকড়ে ধরে ভাবছে, ভাবছে আর ভাবছে। টাকাগুলো সে মানুষদের হাতে তুলে দিতে পারবে তো, তার ভাই হিমেল আমেরিকা থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পারবে তো?





দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 5-Oct-2020

Coming Events:

Nomination Form is available at the end of the notice