খ্রীস্টমাস ইভ দিলরুবা শাহানা
খ্রীস্টমাস ইভ। মানে ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ। এইদিনে আচার-অনুষ্ঠান পালনের তেমন কোন নমুনা-নিশানা খুব একটা দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা হল মানুষের ঘরে ফেরার তাড়া। যানবাহনে পথঘাট সয়লাব। আর সব ধরনের যানবাহনও মানুষ আর মানুষে সয়লাব। উপচে পড়া ভিড় আরকি। কারণ একটাই ঘরে ফিরতে হবে বা প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পৌঁছ্তে হবে। পরদিন ২৫শে ডিসেম্বর বড়দিন। বড়দিনের সকালে আপনজনদের সঙ্গে মিলেমিশে নাস্তা খাওয়া আর খ্রীস্টমাস ট্রির নীচে স্তূপ হওয়া উপহার খোলার আনন্দটাই হচ্ছে মূল আকর্ষণ।
আরমিন এমনি এক ২৪শে ডিসেম্বরে বাসে উঠলো। তিনদিন বেড়ানোর পর ঘরে ফেরা। সঙ্গে রয়েছে বন্ধুরা। আলেক্স, রিউবেন, অভি। বড়দিন আরমিন অভির জন্য বড় কোন বিষয় নয়। তবে চারপাশের সবাই এই উৎসব উদযাপনে এতো মাতোয়ারা হয়ে উঠে যে তার কিছুটা ওদেরও কোনও না কোনভাবে ছুঁয়ে যায়। চারজনের প্রত্যেকেই যার যার মত কিছু ভাবছিল। রিউবেন ভাবছিল অভির কথা। মাছমাংস ছাড়া এই ছেলের শরীর স্বাস্থ্য এতো ভালভাবে টিকে আছে কিভাবে? বিস্ময় লাগে বিষয়টা। এই তিনদিনই সে ঘর থেকে আনা ছোলা ও চাপাতি রুটি খেয়ে কাটিয়ে দিল। এই খাবারটা ওর মা নাকি নিজহাতে বানিয়ে দিয়েছে। দোকান থেকে কেনা রুটি-মাখন, পনির, ফল সে খেয়েছে বাস আর কিছু নয়। রিউবেনেরও কিছু মানামান্তি আছে তবে ভেজেটেরিয়ানদের মত সারাজীবন খাবার বাছাবাছির মানতি তার নাই। আরমিনকেও খেয়াল করে দেখেছে সে। খেতে ভালবাসে ছেলেটা। তবে বড় কষ্টে শুয়োরের মাংস খাওয়া থেকে নিজেকে সংযত রেখেছে। রিউবেন মনে মনে খুশি হয়েছে ওরা না খাওয়াতে। আলেক্স ভাবছে অন্যকথা। এই তিনদিনে যা খরচ হবে চারজনে সমান ভাগে বহন করবে কথা এমনি। এর মাঝে একজন খায়না মাছ-মাংস অন্যজন মদের ব্যাপারে সাবধানী। আলেক্স স্বাস্থ্য-সচেতন হওয়াতে পোয়াবারো হয়েছে ভোজন-রসিক কিপ্টা রিউবেনের। আরমিন ভাবছিল রিউবেন অভির ভেজেটেবল্ খাওয়া নিয়ে কিছু একটা কটাক্ষ করাতে আলেক্স কিভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, ‘চুপ কর, তুইতো মানিস সপ্তাহে একদিন কিছু কেনা যাবে না। সেটাই কি এমন ভাল? মনে আছে ইউরোপে গিয়ে সপ্তাহের সেদিনগুলোতে আমার খাবার সাবাড় করেছিস বেটা ঘাগু।’ মিনমিন স্বরে রিউবেন বলেছিল ‘কি করবো বল ধর্মের মানা।’ আরমিন দেখেছিল রিউবেনের দিকে চেয়ে কি রকম তাচ্ছিল্যের হাসি আলেক্স হেসেছিল। হঠাৎ এক উচ্চকন্ঠী মহিলা বাসে সবার মনোযোগ কাড়লো। বাসের দরজার কাছে সামনের আসনে বড়জোর বছর দশের একটি ছেলেকে বসিয়ে মহিলা তর্জনী নেড়ে কিছু বলছে। ছেলেটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে ‘না না মা আমি ক্রিস্টমাসে তোমার কাছে থাকবো বাবার কাছে যাবোনা’ গর্জে উঠে উচ্চকন্ঠী ‘না ক্রিস্টমাসে বাবা তোমার দেখভাল করার কথা’ ‘মা শোন প্লিজ, আই মিস ইউ এ লট মম্’ ‘জানি কিন্তু কিছু করার নাই’ বলেই মহিলা যেই ড্রাইভারকে কিছু বলার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে অমনি ছেলেটি চট্ করে বাস থেকে পিছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়লো। ব্যাপারটা নজরে আসতেই মহিলাও ছেলেকে ধরার জন্য বাস থেকে ছটফট করে নেমে গেলো। এরমাঝে আরমিনের কানে এলো সামনের আসনে বসা মেয়েটির টেলিফোনের আলাপ। তাকিয়ে দেখলো দুটি ছেলে-মেয়ে কখন যেন এসে বসেছে। বয়স পনেরো কি ষোল হবে হয়তো। কান পেতে শুনলো পুরো আলাপচারিতা। এখানেও মায়ের সাথেই কথা চলছিল। একেতো ওই ছোট ছেলেটির জন্য কি রকম এক অজানা মন খারাপ করা ঘনিয়ে উঠছিলো। এবার মায়ের কাছে কিশোরী মেয়েটির আকুতি শুনে আরও, আরও মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজের মায়ের মুখটা মনে পড়লো। মায়ের জন্য বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। আশ্চর্য আসার আগের দিনই মায়ের সাথে খিটখিটে মেজাজে কথা বলেছে। এই মেয়েটি বার বার মাকে বলছে ‘মা আমি মেলবোর্ন সেন্ট্রালে নামবো, বুঝেছো মা। এ্যান্ডিও আছে আমার সাথে। আমরা তোমার কাছে চার-পাঁচদিন থাকবো... কি? কি? হবে না কে... ‘------’ ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে সরি মা তোমাকে খুব দেখতে মন চাইছিল তাই না জানিয়ে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ... ‘------’ ‘ঠিক আছে দু’দিনই ঠিক, তোমার বন্ধুরা আসার আগেই আমরা তোমার বাড়ী ছেড়ে চলে আসবো। নাহ্ পয়সা নেই আমার। ফেরার গাড়ী ভাড়াটুকু আছে মাত্র।’ কথা শেষ করেই মেয়েটি এ্যান্ডির কাঁধ ধরে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বললো ‘মা থাকতে দেবে দু’দিন।’ আরমিন অবাক হল, দুঃখিত হল। কিশোরী মেয়েটিকে মা নিজ থেকে কাছেও ডাকেনি। অনাহুত মেয়েটি মাকে দেখবে বলে ৭/৮ঘণ্টা বাসে চড়ে মায়ের কাছে যাচ্ছে অথচ মা তাকে দু’দিনের বেশী থাকতে দিতেও রাজী নয়। আরমিনের মনে হল বাড়ী ফিরেই দেখবে তার কাপড়চোপড় ধোয়া, ঘর ঝকঝকে পরিষ্কার আর তার অপেক্ষায় উৎন্ঠিত রাগ-দুঃখহীন মায়াময়ী মায়ের মুখ। বাসে বসেই ভাবলো মায়ের কাছে মাপ চাইবে, সরি বলবে। যদিও ইচ্ছে করছে বলতে ‘মা তোমাকে খুব ভালবাসি খুউব!’ লজ্জা লাগছে। থাক কথাটা সে মনে মনেই বলবে।
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন
|