বoy ভoy নoy দিলরুবা শাহানা অদ্ভুতুড়ে শিরোনাম। চমকে যাওয়ার কথা। সত্যি তো! ইংরেজি বাংলা অক্ষর সাজিয়ে বা মিলিয়ে কি কথা বলার বা ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা এখানে হচ্ছে? ফেব্রুয়ারি মাসে নিবেদন তো মাতৃভাষায়ই হওয়া উচিত। তা এই লেখাতে এমন জগাখিচুড়ি বানিয়ে কিছু বলার চেষ্টা কেন? তাইতো ফেব্রুয়ারি মাসে তো ভাষা-দিবস, আর ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার ও আরও নাম না জানা কত নিঃস্বার্থ মানুষ।
এই আত্মবিসর্জন-কারী শহীদদের স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের রফিকুল ইসলামের অক্লান্ত উদ্যমের সাথে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় প্রচেষ্টার কারনেই ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯সাল থেকে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা-দিবস। এই ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য ভালবাসা ও মমত্ব প্রকাশ হবে যথার্থ কাজ।
ভাষার ‘মার্কেট ভ্যালু’ বা বাণিজ্যিক মূল্য নিয়ে বৈষয়িক মানুষ যারা তারা মাথা ঘামাক, ভাষাকে ভালবাসে যারা তারা মাথা ঘামাবে নিজ ভাষার সৌন্দর্য ও ওই ভাষার শক্তি, ঐশ্বর্য নিয়ে। যেমন শতবর্ষ আগে ‘যখন বঙ্গভাষা(বাংলাভাষা) রাজভাষা নহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মান লাভের ভাষা নহে, অর্থোপার্জনের ভাষা নহে কেবল মাত্র মাতৃভাষা’* জেনেও মাথা ঘামিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মাতৃভাষাকে ভালবেসে তাকে ঐশ্বর্যময় করেছেন, বিশ্ব-সভায় পরিচিত করে সম্মাননা অর্জন করেছেন, বাংলাভাষীদের গর্বিত করেছেন তিনি। অতুল প্রসাদ তখন লিখলেন -
‘এই ভাষাতে বাজিয়ে বিনে আনলো রবি জগৎ ছিনে’ (উৎসঃ ‘মোদের গরব মোদের আশা')
আমরা বাংলাভাষীরা আবেগে খ্যাপাটে ধরনের কিছুটা। আমরা ভাষার জন্য অনেক কিছু করতে পারি এটি একটি প্রমাণিত সত্য, প্রাণও দিয়েছি তার সাক্ষ্য বহন করেই ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা-দিবস। ফেব্রুয়ারির ২১ আমাদের চেতনায় প্রজ্বলিত করে মাতৃভাষার আলো ছড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রদীপ, ২১শে ফেব্রুয়ারি জোগায় নিজ মাতৃভাষায় বিকশিত হওয়ার অন্তহীন অনুপ্রেরণা ও আশা।
বিদেশে যারা থাকেন সেই বাঙ্গালীরা এই আগ্রহ ও ভালবাসা থেকে বাংলা স্কুল খুলেন, বাংলা সাহিত্য সভা করেন, বাংলা পত্রিকা চালান, বাংলা সংস্কৃতি চর্চা করেন, এছাড়াও এখন পৃথিবীর নানা দেশে বাংলাভাষায় ওয়েবসাইটও আছে। তবে কাজটা ততো সোজা নয়। স্কুলের জন্য ছাত্র চাই, সাহিত্যসভার জন্য সাহিত্য-পিয়াসী মানুষ চাই, পত্রিকা পড়ার জন্য পাঠক চাই। এতো উদ্যম উৎসাহের পর আরও একটি জিনিস চাই তা হল সমালোচনা সহ্য করার শক্তি। বাংলা ভাষা বা যে কোন মাতৃভাষাকে বিদেশে বাস করে অনবরত চর্চা করে যাওয়া ও শেখানোর চেষ্টা করা সোজা বিষয় নয়। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা সব জায়গায়ই সচেতন মা-বাবা চেষ্টা করেন ঘরে নিজ ভাষার চর্চা করতে, উল্লিখিত দেশগুলোর বাংলা স্কুলগুলোতেও চেষ্টা করা হয়। এধরনের সব কর্ম খুব সফল বা খুব ব্যর্থ বলা যাবে না।
ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়তে শিখবে এতোটা আশা মা-বাবা বা বাংলা স্কুলের শিক্ষক করেন কি না জানা নেই। বাংলায় পণ্ডিত না হউক অক্ষরগুলো চিনবে ও বাংলা ভাষায় কোথাও কিছু লেখা থাকলে গড়গড়িয়ে পড়তে না পারলেও অক্ষর দেখে বুঝতে পারবে এটি বাংলায় লিখা এইটুকু আশা করা যায় অন্ততঃ। বাংলা স্কুলের অনুষ্ঠান দেখে কেউ কেউ হতাশ হয়ে বলেন ‘ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা দেখে দেখে বাচ্চারা সব পড়ছে বা করছে দেখলাম, স্কুল কি শেখায় বুঝতে পারলাম না’। আরেকজনকে বিরক্তি নিয়ে বলতে শুনলাম ‘বাংলাতে পুরস্কার পাওয়া শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করে চিঠি লিখেছে তাও ইংরেজিতে, কি আশ্চর্য!’ এসব পর্যবেক্ষণ বানানো নয়, ভান নয়, মিথ্যা নয়। বাচ্চারা কিছুটা শেখে, সব হয়তো ভিনদেশে বাস করে শেখানো সম্ভব হয়না।
বহুভাষাবিদ ও ভাষা-বিশেষজ্ঞ অস্ট্রেলিয়ার প্রফেসর এমেরিটাজ মাইকেল ক্লাইন বলেছিলেন একটার বেশী ভাষা বাচ্চাকে শেখালে তার (Cognitive ও Academic) বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ভাল হয়। আরেকজন ভাষা-বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন বাচ্চাদের সামনে ইংরেজি(ইংরেজিভাষার দেশে যাদের বাস) বইপত্রের পাশাপাশি নিজ ভাষার বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে তার চোখেও পড়বে, কৌতূহলী হবে। কৌতূহল জাগলে, প্রশ্ন করবে এতে সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণলব্ধ মতামত সত্যিই বলা যায়। গত সপ্তাহে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ২০১৫র প্রথম সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার টিভির কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স প্রোগ্রামে একটি চমকপ্রদ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তথ্যটি দ্বিভাষিক মানুষকে ভাবাবে, ভাষা বিষয়ে উৎসাহিত করবে। মেলবোর্নের বিখ্যাত স্কুল মেলবোর্ন বয়েজ হাই এ ভর্তি হতে সফল হয় যারা তাদের ৮৩% জন ছাত্রের ইংরেজি হচ্ছে দ্বিতীয় ভাষা। সিডনীর নামকরা সিডনী জেমস রুজ হাই স্কুলে ভর্তি হতে সফলদের ৯৭% শিক্ষার্থী হচ্ছেন বাইলিংগুয়াল বা দ্বিভাষিক। ইংরেজি এদের দ্বিতীয় ভাষা। মাইকেল ক্লাইনের বক্তব্যের সত্যতা এখানেই কিছুটা ধরা যাচ্ছে।
নিজ ভাষা বাংলার প্রতি আগ্রহ জাগানোর জন্য এক মা প্রতিনিয়ত তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা বই, পত্রিকা নিজে পড়েন, বাচ্চাদেরও পড়ে শুনান, পড়তে বলেন। তেমনি এক বই পড়তে গিয়ে কৌতূহলী ছেলে মাকে প্রায় বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। খাওয়ার টেবিলে পড়েছিল কয়েকটি বই। এটা মায়ের একটি সুচিন্তিত কৌশল বা পদ্ধতি। কায়দাটা কার্যকর হল একসময়ে। ওখান থেকে একটি বই হাতে নিয়ে স্কুল যাওয়া ছেলেটি বললো ‘মা এই বইয়ের author আবু জাফর ওবাদুল্লাহ’ লেখকের নাম পড়তে পেরে ছেলেটির আত্মবিশ্বাস একটু যেন বাড়লো। তার মা সাথে সাথে বললেন ‘ঠিক মতো হয়নি; নামটার শেষটুকু ওবায়দুল্লাহ হবে। তুমি ‘য়’ উচ্চারণ করনি’ ‘ঠিক আছে ওই Alphabet উচ্চারণটা কি হবে তা তুমি ইংলিশে লিখে রাখবে, এটা আজ তোমার হোম ওয়ার্ক’ মাকে হোম-ওয়ার্ক বুঝিয়ে দিয়ে ছেলে স্কুলে চলে গেল। মায়ের হল সমস্যা। ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ভাষাবিদ নন তিনি। শিক্ষিকাও নন। ছেলের কৌতূহল সমাধান না করলে বাংলাভাষা শিখতে সে আগ্রহ হারাবে। ইংরেজী-বাংলা ডিকশনারি নিয়ে বসে ঘাটতে ঘাটতে তার সমস্যার সমাধান মনে হল খুঁজে পেলেন। ইংরেজি শব্দ Boy, Toy, Joy বাংলায় উচ্চারণগুলোও লেখা ছিল ডিকশনারিতে বয়, টয়, জয়। তখনি মা লিখে রাখলেন ‘য়’ = (oy)। মায়ের ভাল লাগলো যে ছেলের মনে এমন কৌতূহল বা প্রশ্ন জেগেছে বলেই মা নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে উপায় বের করতে পেরেছেন।
*বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে বিশ্ব কবির এক ভাষ্যটি উদ্ধৃত করেছেন।
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ণ
|