bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












সুন্দর ফন্টের জন্য SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন...


বোকা বাবা ও ভবঘুরের গল্প
দিলরুবা শাহানা


এক ছিল বাবা। বাবা ছিল বোকা। বাবার বিত্ত-সম্পদ তেমন কিছু ছিল না। তবে চিত্তে ছিল তার অফুরন্ত আনন্দ, অহমিকা-ঈর্ষা, ক্রোধ-বিরক্তি তার ছিল অজানা। বেশ ক'টি সন্তানাদি ছিল বাবার। তবে গর্ব করে বলার মতো তেমন বিষয় এটা নয়। সেই সময়ে ওই রকম সন্তান সব বাবাদেরই থাকতো। সন্তান-সংখ্যা এক জোড়া, এক হালি কদাচিৎ দেখা যেতো। বাড়ি বাড়ি আধা ডজন, এক ডজন ছেলেমেয়ের ছড়াছড়ি। তো বাবারও নিজের ছিল আধা ডজনের বেশী ছেলেপিলে, আর মাঝে মাঝেই থাকতো এসে বাবার ভাগনা, ভাইপো আর ভাইজি। আরও কত আত্মীয় অনাত্মীয়। বাবার বাড়িতে কেউ আসলেই তাকে আরাম-আয়েস, স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া যেতোনা তেমন তবে আন্তরিকতা ও স্বস্তি মিলতো পরিমাণে একটু বেশীই। বিশেষ করে বাবার দিক থেকে।

এইসব ফালতু আন্তরিক আচরণের জন্য বাবার সুনাম কেউ করতো না। উল্টো বরং বাবার স্বচ্ছল বন্ধুরা ও গোছানো পরিপাটি জীবন-যাপনকারী ভাইবোনেরা ঠাট্টাতামাশা করতো বাবাকে নিয়ে। কেউ কেউ রুক্ষভাবে তাচ্ছিল্য ভরে বলতো ‘নিজের নাই ঠাঁই, শংকরাকে ডাক’।

কেউ ঢাকায় চাকরী খুঁজতে এসে আশ্রয় নিতো, কেউ ডাক্তার দেখাতে এসে উঠতো। একবার এক অনাত্মীয় ভবঘুরে গ্রাম থেকে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকায় বাবার কাছে এসে আব্দার জুড়লো ‘আমাকে একটা দপ্তরির চাকরী দেন, চাকরী পেয়ে গেলে ঘুরাঘুরি বাদ দিব, বিয়ে করবো, ঘরসংসার পাতবো মামা’ ‘তুইতো নামও সই করতে পারিস না, কি চাকরি করবি অ্যাঁ!’

‘কথাটা ঠিক; বেতন তুলতে গেলে নাম সইতো করতে হবে, সই আপনি শিখিয়ে দেন মামা, আপনার স্কুলেই দপ্তরির চাকরিটা দেন’। কথা শেষ করেই ঘুরাঘুরিতে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ভবঘুরেটি সামনে থালা ভর্তি ভাত চেটেপুটে খেয়ে সিমেন্টের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

দুইদিন বাবার অনাত্মীয় আপনজন ভবঘুরেটি বাবার সাথে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাজারে গেল। সওদাপাতি কিনে ছালা বোঝাই করে রিক্সায় তুলে ফিরলো।
‘চাকরী না হলেও চলবে, রিক্সা জোগাড় করে দেন রিক্সা চালাবো। এইকাজে তো নামসই লাগবে না ‘
‘রিক্সা চালাতে পারিস?’
উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিল
‘রিক্সাতো দূরের কথা, জীবনে কোনদিন সাইকেলে হাত দেওয়ার সুযোগ হয় নাই ‘
‘তাইলে?’
পরদিন বাবার এক বোন আসবেন নরসিংদী না নারায়ণগঞ্জ থেকে। এখানে দুপুরে খেয়ে বিকালের মাঝেই পাবনা না যশোর রওয়ানা দেবেন।
বাবার কাজে ব্যস্ততা তাই সকালে বাবা মায়ের হাতে মুরগি, কলিজী, পোলাওয়ের চাল ও ঘি আনার জন্য পয়সা দিয়ে বললেন ভবঘুরেকে বাজারে পাঠাতে। ভবঘুরে তখন বললো
‘একটা টুকরি কিনতে পারলে সওদাগুলি আনতে সুবিধা হতো আর পরে ঐ টুকরিটা নিয়ে বাজারে মোট বওয়ার কাজ করতে বসে যাব, রোজগারপাতি কিছু হবে’
ভবঘুরের কর্ম স্পৃহা দেখে বোকা বাবা বিস্মিত। প্রথমে দপ্তরি তারপরে রিক্সাওয়ালা, এবার সে মোট বইতেও রাজী! বাবা রীতিমত মুগ্ধ। মাকে বললেন
‘আমার কাছে আর পয়সা নাই, তুমি পারলে ওই ছোড়াকে টুকরি কেনার পয়সা দিও, আমি পরে দিয়ে দিব’ ।
ভবঘুরেকে বাজারে পাঠিয়ে মা এদিকে আদা-পেয়াজ-রশুন বাটিয়ে রাখলেন। মেহমানকে মাছ ও ভাল কোন সবজী দেওয়ার কথা ভাবলেন মা। ভবঘুরে ততোক্ষণে চলে গেছে বাজারে। ঘরে কাঁচকলা ছিল তাই দিয়ে সুরাধুনী মা মজাদার টিকিয়া ভেজে ফেললেন। সময় যাচ্ছে বাজার আর আসে না। বাবার বোন আসার সময় ঘনিয়ে আসছে। উপায় কি এখন। আবার কাউকে বাজারে পাঠাবেন সেই পয়সা ও সময় কোনটাই নাই। মা নিরুপায় হয়ে পাশের বাড়ীর প্রতিবেশিনী আপাকে সমস্যাটা বললেন। তখনকার সময়ে মানুষের মাঝে সহমর্মিতা ছিল অসাধারণ। একজন আরেকজনকে সহজেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো। মায়ের কথা শুনেই ওই মহিলা বললেন
‘চিন্তার কারন নাই। আমার রান্না হয়ে গেছে আমি আপনার মেহমানের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি’ ;
লাজুক হেসে যোগ করলেন
‘আমারও আজ ভাল কিছু পদ রান্না হয়েছে’।
পাশের বাড়ীর আপা বাটিতে করে থরে থরে সযত্নে সাজিয়ে মেহমানের জন্য সব পদ পাঠালেন। ভাত, ইলিশ মাছের পাতুরী আর খাসীর কালিয়া। এদিকে বাবার বোন একটু দেরীতে পৌঁছলেন। তাড়াহুড়া করে খেয়েই বের হতে হবে তাকে। সময় কম। উনি জিজ্ঞেসও করলেন না যে তোমরা খাবে কি না। বা উনি হয়তো ভেবেছেন এই বাড়ীর সবার এতক্ষণে নিশ্চয় খাওয়াদাওয়া শেষ। নামীদামী দোকানের বেশ বড়সড় এক হাড়ি মিষ্টি ও বিশাল এক নিমকির ঠোঙ্গা বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবার বোন বিদায় নিলেন। সেই দিন বাড়ীর ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলো মহা ফুর্তিতে ফুপুর আনা নিমকি ও মিষ্টি দিয়ে পেট-পূর্তি করলো। মা অনেক নিমকি ও মিষ্টি পাশের বাড়ী পাঠালেন
বাবা ফিরলে সবাই একসাথে খেতে বসলো। আলু ভাজি, ডাল চচ্চড়ি, কাঁচকলার টিকিয়া আর পাশের বাড়ীর অল্প খাসীর কালিয়া। বাবা জানতে চাইলেন
‘কলিজী, মুরগী কিছুই আনে নি?’
‘কে আনবে? সেই আলসের বাদশাহ ভবঘুরে নিজেই ফিরে আসে নি’
‘বল কি!’
‘যতো সব আলতু ফালতু মানুষের জন্য দরদ! আপনার ভাইদের ধারেকাছে যাওয়ারও সাহস পায়না এরা। এই জন্যই ভাইবোনরা আপনাকে বোকা বলে!’ মায়ের কণ্ঠে ক্ষোভ।
বাবা নীরিহ গলায় বললেন ‘আহা এমনতো হতে পারে ওই হাদা পথ হারিয়ে ফেলেছে বা তার কোন বিপদ হয়েছে’।
মা বললেন ‘আচ্ছা মানলাম এর বিপদ হয়েছে। আরেক ভাগনা যে তিনমাস থেকে বাড়ীর খেয়ে, না জানিয়ে একগাদা দোকান বাকী রেখে চলে গেল, দোকানদার দরজায় এসে অপমান করার পর জানলাম!’
‘সেই দোকান-বাকীতো আমি শোধ করেছি। ঠিক তো?’
‘হ্যাঁ জানি, সে দোকানী পরে আপনার কাছে মাপ চেয়েছে আর এখন আপনাকে খুব সম্মান করে’।
এই ধরনের আরও নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত হাসিমুখে মোকাবিলা করেই বাবার জীবন শেষ হল। ভাগ্য বাবার ভালই বলা যায় সন্তানগুলো সুমানুষ হিসাবে গড়ে উঠেছে। সবাই বিরাট হোমড়াচোমড়া না হলেও শিষ্ট ও সৎ মানুষ তারা। তাদের কেউই ভবঘুরে, বাটপার বা ধান্ধাবাজ নয়।
বাবার এক ছেলে যিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। একবার দুবাই এসেছে। এক আন্তর্জাতিক সেমিনার না কনফারেন্সে অংশ নিতে। অসাধারণ চাকচিক্য ও পারিপাট্য চারদিকে। শেষদিন বিকালে কাজের শেষে হোটেলের লাউঞ্জে বসে লোকজনের যাতায়াত দেখছে সে। হঠাৎ রিসেপ্শন থেকে একজন এসে আরবি একসেণ্টে ইংরেজিতে বললো
‘তুমি বাংলাদেশের তো? তোমার খোঁজে একজন এসেছে’।
দেখা গেল ওই লোকের পিছন পিছন আরবদের মত লেবাস-ধারী একজন। লম্বা তেমন নয় তবে ফর্সা ও সুন্দর দাড়িসহ সুফি মত তার বদন। পরনের পোশাক ও মাথার স্কার্ফ খুব মূল্যবান। রিসেপ্শনকর্মী খুব তমিজের সাথে আগন্তুককে হাত তুলে দেখালো। সঙ্গে সঙ্গে সেই লোক দু'হাত বাড়িয়ে তার একটি হাত তুলে নিল ও বাংলাভাষায় বলে উঠলো
‘আস্ সালামালেকুম ভাই, আমাকে চিনার কথা নয় আর মনে থাকলেও তা খুব লজ্জার বিষয়’!
বোকা বাবার পদস্থ ছেলে বিস্ময় নিয়ে ধনাঢ্য বাংলাভাষী শেখের দিকে মনোযোগ সহ চাইলো, চিনতে পারলো না। সময় দেওয়ার পরও যখন পরিচিত লাগলো না তখন সেই শেখ বললো
‘মনে আছে একদিন আপনাদের বাড়ীতে আপনার ফুপু আসবেন, মামা মানে আপনার বাবা তাকে আমি মামা ডাকতাম আমাকে বাজারে পাঠালেন। বড় ভাল মানুষ ছিলেন। আমি আর বাজার নিয়ে ফিরতে পারি নাই’
‘কি হয়েছিল কোন বিপদআপদ...’
‘না না কোন বিপদ হয়নি। বাজারে এক ভিনদেশী লোক ম্যাজিক নাকি যাদু দেখাচ্ছিল তাতে এমন মজা লাগলো যে ছুটলাম তার পিছন পিছন। বাজার করা ভুললাম, বাড়ী ফিরার রাস্তার হদিস হারালাম। আছি যাদুকরের সাথে সাথে। একদিন যাদুকরের সাথেই জাহাজে উঠলাম। অনেকদিন লাগিয়ে অনেক দেশ ঘুরে বাহরাইনে নামলাম। তা ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরতো পার হয়ে গেছে আরবদের মাঝে।’
‘আমার খবর পেলেন কি ভাবে?’
‘কিভাবে পেয়েছি? সে আরেক বিরাট ঘটনা পরে বলবো। কি সমস্যায় মামা-মামীকে ফেলে এসেছিলাম সেদিন!’
‘আমার বাবা ভেবেছিলেন আপনি কোন বিপদে পড়লেন কি না!’
‘ভাল মানুষ ছিলেনতো তাই খারাপ কিছু ভাবেন নি; আপনার জন্য কি করতে পারি?’
‘কিচ্ছু না, আজ শেষরাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরে যাব, বাবা মা বেঁচে থাকলে আপনর গল্প করতাম তারা খুশী হতেন’
সেদিনের ভবঘুরে আজকের সুফি ধনাঢ্য শেখ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো
‘আহারে উনারা নাই!’
অস্থির তৎপরতায় নিজের জোব্বার পকেট থেকে দু'টো মখমলের পুটুলি বের করে উপুড় করে লাউঞ্জের সোফাতে ঢেলে দিল
‘আমার দিন যখন ফিরলো তখন থেকেই ওই দুইজন বড় আত্মার মানুষের জন্য কিছু উপহার জোগাড় করে রেখেছি! হায় রে হায়!’
সোফাতে আলো ছড়াচ্ছে একটি গজমতির তসবীহ্ ও সোনার কারুকার্যখচিত ওই গজমতিরই বালা।
‘হাতীর দাঁতের তসবীহ্ সারাসময় হাতে নিয়ে জপা যায় হাত একটুও ঘামে না’ গজমতির তসবীহ্ হাতে নিয়ে সে বললো।
এবার সে খুব নম্র ও খুব বিনীত স্বরে বললো
‘দুটি কথা আমার রাখতে হবে প্রথমত: আপনার বাবা ও মার জন্য হজ করার অনুমতি আমি চাই আর এই জিনিসগুলি আপনি নিন, আমি খুব, খুউব খুশী হব।’
‘আশ্চর্যতো এসব আমি কেন...’
‘শুনেন আমার দাদা বহুদিন আগে হজ করার জন্য কিছু টাকা মামার কাছ থেকে নিয়েছিলেন তা ফেরত দেওয়া হয়নি কোনদিন। মামা তখন মাত্র চাকরি শুরু করেছেন, বিয়েশাদী করেননি। এই সাহায্য করার কথা আপনার মা জানতেন কি?’
বোকা বাবার ছেলের মনে পড়লো বাবার মুখে বহুবার শুনা একটি বাক্য। বাবা বলতেন ‘কাউকে ডানহাতে যদি কিছু দিয়ে থাক তোমার বা হাতও যেন তা না জানে।’

বোকা বাবার ছেলে ও ভবঘুরেটি পরস্পরের দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো।



দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ণ






Share on Facebook               Home Page             Published on: 26-Jan-2015

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far