তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ ও ক্যান্সার দিলরুবা শাহানা
ডিসেম্বর ২০১২'র এক পড়ন্ত বিকাল। আমি বিষণ্ণ হৃদয়ে অস্থির মস্তিষ্কে রাস্তার দু'পাশের দোকানগুলোতে অনেক আশা নিয়ে তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ খুঁজে মরছি। এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ হচ্ছে এ্যাপ্রিকটের বিচির ভেতরের বাদাম, দেখতে আ্যামন্ড (Almond) এর মতো তবে গড়নটা আরও ছোট। বেশীর ভাগ দোকানীই বিস্মিত হল শুনে। বিটার এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ আছে নাকি? আর থাকলে তা কি দরকারে লাগে ভাবছে তারা। এক অহংকারী আফগানী দোকানী কিছুটা অবজ্ঞা নিয়ে বললো, ‘আজ সকালে এক সাদা অস্ট্রেলিয়ানও এসে ওই তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ খুঁজছিল, কি কাজে এটা লাগে?’ ওর কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করলো না। সে ভাগ্যবান মানুষ তার আপনজনদের কেউ অসুস্থ নয়, তাকে হন্যে হয়ে এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ খুঁজতে হচ্ছে না। আমার বিপন্ন ব্যাকুলতা দেখে সে নিজে থেকে বললো, ‘আমার কাছে অন্যটা আছে, তবে রাস্তার উল্টোদিকে এক দোকানে দেখেছিলাম তেতোটাও আছে, জানতো এটা সহজে পাওয়া যায় না’।
আমিও একদিন আগে মাত্র এই বস্তুর অস্তিত্বের কথা জেনেছি, এটি নাকি ক্যান্সার প্রতিরোধে ও ক্যান্সার নামে মারনব্যাধির আগ্রাসন থামাতে সাহায্য করে। ক্যান্সার এমন এক রোগ ক্ষেত্র বিশেষে বা রোগের ধরন অনুযায়ী কোন চিকিৎসাতেই এর নিরাময় সম্ভব হয়না। তাও মানুষ আমারই মতো হাল ছাড়তে চায়না, ধানদূর্বা বা খড়কুটাকেও গভীর আশা নিয়ে আঁকড়ে ধরে। ওই মুহূর্তে এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ তেমনি এক আশ্বাস। হয়তো এটা পাওয়া গেলে উপকার হবে। মনে হচ্ছে উপকার হবেই। জিনিসটা পেতে হবে আগে। পেলেই হবে না, ঢাকায় পাঠানোরও ব্যবস্থাও করতে হবে। একজন সজ্জন মানুষ কথা দিয়েছেন নিয়ে যাবেন। আজই আমাকে এটা জোগাড় করতে হবে। ভোররাতে খালাতো ভাই লন্ডন থেকে ফোনে বললেন যে হেলথ্ শপে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। উনিও হেলথ শপে দেখবেন পাওয়া গেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। আমি সকালে খুঁজেছি সুপার মার্কেটের হেলথ্ শপগুলোতে, পাইনি। মিডল্ইষ্টার্ন দোকানে দেখেছি নানা ধরনের শুকনো ফল আর বাদাম পাওয়া যায় তাই এখানে এসেছি। পেস্তাবাদাম, আখরোট, আনজির, কিসমিস, আলুবোখারা, জাফরান সবই আছে শুধু নেই তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্।
আফগান দোকানীর পরামর্শ মত রাস্তার অন্যপাশের দোকানে পৌঁছ্লাম। এসে দেখি সত্যি এখানে দু’টো কণ্টেনারে এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ রাখা আছে। দোকানীকে কোনমতে বোঝালাম যে বিটার এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ চাই। সে নিস্পৃহভাবে বললো কোন কণ্টেনারে তেতোটা জানেনা আমিই যেন এক একটা মুখে দিয়ে দেখি কোনটা কি। ওইভাবে চিবিয়ে তেতোটা শেষ পর্যন্ত সনাক্ত করা গেল। এক কেজি তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ কিনে সন্ধ্যা নাগাদ ঘরে ফিরলাম। সে রাতেই ভাল মানুষ মুশফিকভাইয়ের হাতে অর্ধেক কেজি তেতো সেই এ্যাপ্রিকটের বাদাম দিয়ে আসলাম। কেউ একজনকে এক কেজি ধরিয়ে দিতে সংকোচ হচ্ছিল। উনি কিছুটা অবাক হলেন অসুস্থ ভাইয়ের জন্য এতো কম বাদাম দিচ্ছি দেখে। আমি উনাকে জানালাম এটা ওষুধের মতো খেতে হবে। দৈনিক পাঁচ থেকে সাতটার বেশী খাওয়া যাবেনা। আমি নিজে তখনও এবিষয়ে কোন তথ্য তালাশ করিনি। তবুও স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা এতে যেন উপকার হয়।
সে রাতে দেশে ফোন করে এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ পাঠানোর খবর দিতে গিয়ে জানলাম ভাইকে আবার ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। গত কয়েক মাস ওকে ঢাকা-সিংগাপুর, বাসা-ক্লিনিক করতে হয়েছে অনেকবার। ভাল হয়ে অফিসও শুরু করেছিল। আবারও ক্লিনিকে নিতে হয়েছে শুনে বুক কেঁপে উঠলো। এমনিতেই কি এক ঘোরের মাঝে সময় কাটছিল এবারের অনুভূতি প্রকাশের মতো নয়। শুধু মনে হল তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ তো আগামীকালই পৌঁছাবে আমার গভীর আশা... এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ ঠিকই পৌঁছাল কিন্তু ভাই আর তা চেখে দেখার অপেক্ষায় রইলোনা।
তারপর আমার মনে হয়েছে ওই তেতো কের্নেল্ যদি অন্য কারোরও প্রয়োজনে লাগে তাকেই দিতে হবে। যাই হোক কেউ একজন আমারই মতো আশা নিয়ে তেতো বাদাম নিয়ে গেল, কেউ কেউ আস্থাহীনতায় ভুগলো, তাদের মনোভাব এমন যে এত্তো এত্তো দামী ওষুধে যখন কাজ হচ্ছে না আর ওই তেতো বাদাম কীইবা করতে পারে। হঠাৎ মনে পড়লো একদিন এক গ্রীক বা সাইপ্রিয়ট (সাইপ্রাসের মানুষ) মহিলা আমার পাড়ার এ্যাফির সাথে এসে আমার ব্যাকইয়ার্ডের এ্যাপ্রিকট গাছের নীচ থেকে এ্যাপ্রিকটের শুকানো বিচি সব কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তখন গাছে এ্যাপ্রিকট ছিলনা মোটেও। জানতাম না কি দরকারে এগুলো নিচ্ছে, এর ভিতরে বাদাম রয়েছে তাও জানতাম না। এখন মনে হচ্ছে ওই মহিলা জানতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ গুনের কথা।
আজকাল কিছু জানতে চাইলে সহজেই ইন্টারনেট ঘাঁটলে তথ্য মিলবে। তেমনি এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ বিষয়েও নানান তথ্য রয়েছে। তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ সায়ানাইড আছে। বলা হয়েছে এমিগডেলিন (ভিটামিন বি ১৭) আছে এতে তাই এটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করে। অনেকেই ক্যান্সার রোগের ঔষধি বা ভেষজ ওষুধ হিসাবে এটি বেছে নেন। ক্যান্সার ছাড়াও এই তেতো বাদাম মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে বলা আছে। তবে ব্যবহার করতে হবে সাবধানে। একসঙ্গে বেশী পরিমাণে তেতো এই বাদাম খাওয়া ক্ষতিকর। রাশিয়াতে ১৮৪৫ সাল থেকে ক্যান্সার চিকিৎসায় এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ ব্যবহৃত হচ্ছে । আমেরিকাতে একই চিকিৎসাতে এই বাদাম ব্যবহার শুরু হয়েছে ১৯২০ সাল থেকে। যদিও এর ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক চলছেই। আজ অব্দি কোন মীমাংসায় পৌঁছানো যায়নি। কেউ কেউ উপকৃত হয়েছেন এমন ঘটনা যেমন আছে তেমনি খাওয়ার পর পরই অসুস্থ হয়ে হসপিটালে যেতে হয়েছে কয়েক জনকে। তেতো এ্যাপ্রিকট কের্নেল্ খেয়ে কারো মৃত্যু ঘটেছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। তবে দায়িত্বশীল ভাবে সাবধানে খেতে হবে। আস্ত বা গোটা বাদাম গিলে খাওয়া নিষেধ। খেতে হবে চিবিয়ে অথবা গুড়ো করে জুস বা অন্য খাবারের সাথে মিশিয়ে। এবং জরুরী যে বিষয়টি মনে রাখা অত্যাবশ্যকীয় তা হল ৫, ৭ টির বেশী তেতো বাদাম একসঙ্গে খাওয়া যাবেনা। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করে মাত্রা বা পরিমাণ ঠিক করতে হবে। এমন উদাহরণও আছে যে কোন কোন ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ দৈনিক ৩৫টা করে এই তেতো বাদাম বছরের পর বছর খেয়ে যাচ্ছেন এবং ক্যান্সার মুক্ত রয়েছেন। তেমনই একব্যক্তি যার আয়ু অংকলোজিস্টদের মতে বড়জোর পাঁচ বা সর্ব্বোচ্চ সাত বছর সেই পল রেইড কেমোথেরাপিকে বিদায় জানিয়ে দৈনিক ৩০টা করে এ্যাপ্রিকটের তেতো বাদাম খেয়ে ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ১৪বছর যাবত ক্যান্সার মুক্ত জীবন যাপন করছেন। (সূত্র: সানডে মর্নিং হেরাল্ড ৭ মার্চ ২০১০; দি এইজ ২০ নভেম্বর ২০১১)
সূত্র : ইন্টারনেটের সহায়তায়
|