বেগম রোকেয়ার বিজ্ঞান-ভাবনা দিলরুবা শাহানা
ছবিটা দেখে মন ভরে গেল আনন্দে। ছোট্ট একটি মেয়ে ‘ড্রেস এ্যাজ ইউ লাইক’ বা ‘যেমন খুশী সাজো’ পর্বে লম্বা হাতা বা ফুল স্লিভ ব্লাউজ পরে সাদা শাড়ীর আঁচল মাথায় দিয়ে চোখে চশমা এতে বেগম রোকেয়া সেজেছে। চশমাটাই যা ওর আধুনিক হয়ে গেছে। রোকেয়ার চশমা ছিল গোলাকৃতি। ছোট্ট মেয়ের চশমাটি চারকোণা। ছবিটা দেখে ভাবলাম ঐ মেয়েটি কখনো রোকেয়ার নাম শুনেছে কি? তাঁর সম্বন্ধে কিছু কি জানে সে?
বাংলাদেশে ফোন করতেই বেগম রোকেয়াই রিসিভার তুললেন। তারপর কলস্বরে হাজার কথা।
‘কেমন আছ--ছো, কি করছ--ছো’
‘শোন শোন তোমার মায়ের পাঠানো ছবি পেয়ে...’
আমার কথা শেষ হল না আবার প্রশ্ন
‘কোনটা বলতো?’
‘সাদা শাড়ী আর চশমা পরা তুমি’
‘ওহ হো যাতে আমি বেগম রোকেয়া সেজেছিলাম, ঠিক না?
‘বেগম রোকেয়াকে চেন তুমি?’
‘হ্যাঁ, চিনিতো
‘কি জান তুমি তাঁর...’
তড়িঘড়ি উত্তর
‘উনি মেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন’
‘রোকেয়ার কথা কে বলেছে তোমাকে?’
‘মা, মা’ইতো বলেছে, ধর এখন মা’র সাথে কথা বল।’
যাক এইটুকু মেয়েও জানে রোকেয়া কি করেছিলেন। বড় হলে ও আরো জানবে বাঙ্গালি মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর যুদ্ধে নেমে রোকেয়া কত কষ্ট, কত অপবাদ সহ্য করেছিলেন। গোঁড়ামিতে টইটুম্বুর সমাজে নিন্দুকেরা বলেছিল ‘বিধবা যুবতী যৌবনের বিজ্ঞাপনে নেমেছে’। কোথায় সে অপদার্থ নিন্দুকরা আজ?
অপবাদ ও নিন্দায় ভেঙ্গে পড়ে রোকেয়া রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছপা হন নি। আমৃত্যু যোদ্ধা রোকেয়া নিন্দুকের মুখে কালি মাখিয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন। ভাল লাগলো ভেবে যে শুধু ইতিহাসের পাতায় নয় ঐ ছোট্ট মেয়ের মনে, তার মায়ের মনেও রোকেয়া আছেন, আর রোকেয়া থাকবেনও।
বেগম রোকেয়া মেয়েদের শিক্ষা, মেয়েদের মুক্তি, মেয়েদের অগ্রগতির জন্য যা করেছেন তা বহুল স্বীকৃত সত্য। এমন কি আধুনিক নারীবাদী মনীষারাও রোকেয়ার চিন্তা চেতনার ব্যাখ্যাবিশ্লেষণে ও নানামুখী বিতর্কে এগিয়ে এসেছেন।
রোকেয়া মেয়েদের কথাই বলেছেন মূলতঃ। তাঁর লেখাতে ‘অবরোধবাসিনী’ মেয়েদের কঠোর বাস্তবতা যেমন বিবৃত হয়েছে তেমনি মেয়েদের ‘নারীস্থান’ তৈরির কথা পর্যন্ত চিত্রিত রয়েছে। নিজের সময়ের চেয়ে ঢের অগ্রবর্তী রোকেয়া মানস চোখে দেখেছেন কাজকে সহজসাধ্য করার জন্য মেয়েরা নিজেরাই প্রকৃতির সম্পদ সূর্যতাপ ব্যবহারেও পারঙ্গম। অসাধারণ কল্পনা যা তাকে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা করে তুলেছে।
আমাদের ছোটবেলায়ই ঢাকা শহরে মায়েরা কেরোসিন ষ্টোভকে বিদায় করে গ্যাসের চুলাতে রান্না শুরু করেন। তখন মাকে বলতে শুনেছি, ‘গ্যাসের চুলা আসাতে কষ্ট কমেছে, এখন যদি সূর্যতাপ ধরে রাখার উপায় পাওয়া যায় তবে বাদলা দিনে কাপড় শুকানোর কাজে লাগানো যেতো।’
আমার মায়ের এই ইচ্ছা ব্যক্ত করার বহু আগেই রোকেয়া কল্পনায় দেখেছেন যে মেয়েরা কিভাবে সূর্যতাপকে কব্জা করে দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগিয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন তাই তার মানস চোখে এমন দৃশ্য ধরা পড়েছে।
রোকেয়া যখন তাঁর উপন্যাসে সৌরশক্তি ব্যবহারে সক্ষম নারীদের ছবি এঁকেছেন ঠিক সেই সময়েই আরও একজন বিখ্যাত পাশ্চাত্য লেখক সৌরশক্তি করায়ত্ত করে অসাধারণ কর্মসাধনের স্বপ্ন দেখেছেন।
প্রকৃতির অকৃপণ দান সৌরশক্তিকে মানুষের উপকারে ব্যবহারের বিষয়ে পাশ্চাত্যের লেখক এইচ জি ওয়েলস্ ও বেগম রোকেয়ার চিন্তাভাবনার মিলের বিষয়ে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের মেধাবী সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবাসী সৌরশক্তি বিশেষজ্ঞ পরিবেশবাদী সাজেদ কামাল। সাজেদ কামাল BANGLABESH ENVIRONMENT NETWORK) এর সম্মানিত সদস্য ও কবি সুফিয়া কামালের পুত্র। সাজেদ কামালের ইংরেজিতে লিখিত দীর্ঘ প্রবন্ধের এক জায়গায় এইচ জি ওয়েলস্ ও রোকেয়ার সৌরশক্তির বিষয়ে চিন্তার কথা বলেছেন।
রোকেয়া(১৮৮০-১৯৩২) ও এইচ জি ওয়েলস্ (১৮৬৬-১৯৪৬) দু'জনে প্রায় একই সময়ে মানুষের কল্যাণে সৌরশক্তি করায়ত্ত করে ব্যবহারের স্বপ্ন দেখেছেন, ভেবেছেন। প্রত্যাশা এই ধন-মুখী উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থাৎ শুধু সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সৌরশক্তি ব্যবহার নয়, সৌরশক্তির ব্যবহার হবে গণমুখী অর্থাৎ ব্যাপক মানুষের মঙ্গল সাধনে।
ছোট্ট মেয়ের মুখে রোকেয়ার কথা শুনে আশা জাগে অনেক মেয়ে একদিন রোকেয়ার স্বপ্নের পথে হেঁটে নিজ মেধা আর শ্রম দিয়ে সূর্য্যতাপকে মানুষের ও সর্বোপরি মেয়েদের কল্যাণে ব্যবহারের নব নব কৌশল খুঁজে পাবে, তারই অগ্রদূত হবে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাতে একজন স্প্যানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ইজাবেল হারগোয়েরার সাক্ষাৎকার দেখলাম। চমকপ্রদ তথ্য হল ওই চলচ্চিত্র নির্মাতা বেশ কয় বছর(২০১২তে) আগে দিল্লীতে এসে কোন এক শিল্প প্রদর্শনীতে বেগম রোকেয়ার লেখা “সুলতানা'স ড্রিম” বইটি পেয়ে যান। বইটি তার এতো ভাল লাগে যে বইটি তিনি চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। জানা গেল তার নির্মিত চলচ্চিত্র বা সিনেমাটি পাশ্চাত্যের নানান চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে। রোকেয়ার জন্মের ১৪৩ বছর পেরিয়ে এখনো রোকেয়া প্রাসঙ্গিক, স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে রোকেয়ার প্রজ্ঞা কাজে লাগানো হবে এই প্রত্যাশা।
 দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
|