‘মেয়েটি আমার আদর ঢালা...’ দিলরুবা শাহানা মনে হবে কেউ হয়তো আপন আত্মজার কথা বলতে চাইছেন। আসলে এই মেয়েটি কোন একজনের আদরিনী কন্যা নয়। এটি আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী যে কোন বাংলাভাষীর আদরের ধন বাংলা ভাষা। একজন মানুষের নানা পরিচিতি থাকে। ভৌগোলিক পরিচয় যেমন এশীয়, আফ্রো, ইউরোপীয়। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পরিচিতি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান। মুখের ভাষাও মানুষকে পরিচিতি দেয় যেমন আরব, ইংরেজ, বাঙ্গালী। মানুষ নানা তাগিদে নিজের ভৌগোলিক বলয়, আপন স্বদেশ ভূমি ছেড়ে দূর দূরান্তে বিদেশ বিভূঁইয়ে ছড়িয়ে যায়। সঙ্গে থাকে তার ভাষা ও কিছু আচার-অভ্যাস। যেমন খাদ্যাভ্যাস, ধর্মাচার ইত্যাদি। ভাষাটা যত্ন করে মানুষ ধরে রাখতে চায়। আত্মপরিচয়ের অংশ ভাষা তাই ভাষা হারিয়ে ঐতিহ্য হারানোর দুঃখবোধ ও হীনমন্যতায় ভুগতে মানুষ নারাজ। বিদেশে বাংলা ভাষায় কি এমন কাজ হয় যে একে এতো যত্নে লালন দরকার? কেউ বা অবজ্ঞা করে বলেন এই দূরদেশে বাংলা জেনে কি লাভ? ঐ শ্রেণীভুক্তরা অবশ্য লাভ ছাড়া কিছু বুঝেন না। লাভের আশায় নয় শুধুমাত্র ভালবাসায় বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর নানা মহাদেশে নানা কোনে বাংলাভাষীরা তৎপর। বাংলাভাষার ভাণ্ডার বাংলাভাষার শক্তি মর্যাদার দাবীদার। রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই তারপরও আরও লেখক সাহিত্যিক শুধুমাত্র বাংলাভাষায় আজীবন নিবেদিত থেকেও দেশবিদেশে পন্ডিত-সজ্জনদের নজর কেড়েছেন, প্রশংসা কুড়িয়েছেন। নিজ ভাষা বাংলার শক্তি বিষয়ে অজ্ঞাত কেউ থাকতেই পারে এতে দোষের কিছু নাই। সবাই সবজান্তা পণ্ডিতও হয়না। পণ্ডিত হওয়ার দরকারই বা কি? তবে বাংলাভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, অকেজো ভাবা বালখিল্যতার নামান্তর। এক চালিয়াত বিদেশী বাংলাভাষার বিরাট বিশাল ভাণ্ডার দেখে একেবারে লা- জবাব । ঘটনাটা বলেছিলেন তুখোড় ও বুদ্ধিতে শানানো রসিকতায় কুপোকাত করতে পারদর্শী মেলবোর্ন-বাসী স্থপতি শাহেদ ভাই। অফিসে দুপুরের খাবার বিরতিতে উনি গুগল সার্চ করছিলেন। তার বস যেতে যেতে জানতে চাইলো কি খুঁজছেন উনি। উত্তর ছিল -বাংলাভাষার এক কবির বিষয়ে কিছু তথ্য খুঁজছি। খাওয়া দাওয়া শেষে ফিরে এসে বস দেখে তখনও বাংলাদেশের লোকটি তথ্য খুঁজে ব্যস্ত। সে বসে গেল তার নিজের ভাষার এক লেখক বিষয়ে তথ্য জানতে। লোকটি হয়তো ভেবেছিল বাংলাদেশী লোক বাংলাভাষী লেখক বিষয়ে কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা। তথ্য থাকলে এতো সময় কেন লাগবে? কিছুক্ষণ পরই সে এসে সানন্দে বাংলাদেশী ভাইকে বললো -দেখ দেখ আমার ভাষার লেখক সম্বন্ধে নয় শ' এন্ট্রি রয়েছে! শাহেদভাই কপট উদাসীনতার ভান করে ধীর-স্থির শান্ত কণ্ঠে জানালেন -আর আমার লেখক রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে একটা সাইটেই উনিশ হাজার এন্ট্রি দেখতে পাচ্ছি। বিদেশী ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে কথা না বাড়িয়ে ঝটপট নিজের আসনে ফিরে গিয়েছিলেন। আমাদের দেশের লেখক সেলিনা হোসেন, সেলিম আলদীন বাংলা ভাষায়ই লিখেছেন। তাদের সৃষ্টিকর্ম অত্যন্ত গুরুত্ব সহ দেশ-বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হচ্ছে। এছাড়াও আরও অনেকে শুধু বাংলায় লিখেই পরিচিত ও সম্মানিত। এসবই বাংলাভাষার শক্তির ইঙ্গিত দেয়। একটি বাংলা স্কুল চালানো, একটি বাংলা সাংস্কৃতিক সংঘ গড়ে তোলা, সবার উপর বাংলায় একটি প্রকাশনার চেষ্টা সব উদ্যোগে ইন্ধন যোগায় ঐ মেয়েটি, যার কথা সুরে সুরে বলা হয়েছে ‘মেয়েটি আমার আদর ঢালা সাধের বাংলা ভাষা’।
|