দিলরুবা শাহানা'র ১০ টি অনুগল্প
আগের অংশ
আকাশের প্রাণ কাঁদে...
সন্ধ্যা নামছে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে। বিচিত্র এই জনপদে শেষ চক্কর দিচ্ছে আকাশ। আজ মাঝরাতে প্লেন ধরবে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে। চাচাতো বোনের কাছে এক সপ্তাহ কাটাতে ভালই লাগলো। বিদেশে মানুষ বড় ব্যস্ত, সময় কারো নাই। বোন-দুলাভাইও ব্যস্ত তবে মনটা ওদের স্নেহ-সিক্ত। স্পোর্টস রিপোর্টার যাচ্ছে ব্রাজিলে বিশ্বকাপের রিপোর্ট করতে। পথে আমেরিকায় আতিথ্য-লাভ ওর জন্য বিরাট বিলাসিতা। খেলার সখ ছিল তবে মধ্যবিত্তের জন্য সখটা বড় বেমানান। স্কুল, পাড়ার ক্লাব সবখানে ভালই খেলেছে। যখন ফুটবলেই জীবন পণ করবে ভাবছে তখন বাপ বললেন -খেল্, খেলাতে প্রশিক্ষণও নিতে পারিস সাধ্য অনুযায়ী তবে পেশাদার খেলুড়ে হতে পারবি না। লেখাপড়া করে পেশা একটা বেছে নিতে হবে। নিজের উদ্যোগে ফুটবল খেলার ট্রেনিংই শুধু নেয়নি, এই বিষয়ে এন্তার পড়াশুনা করে তথ্যও সংগ্রহ করছিল। বাপ বললেন -লিখ, খেলার নিয়ম ও ভাল ট্রেনিং কৌশল কি। লেখা ও খেলা তার কপাল খুলে দিল। কোচ হিসাবে বিভিন্ন স্কুলে ও পাড়ার ক্লাবে কাজের ডাক পেল। থিওরি ও প্র্যাকটিস দুটোতেই সমান পারঙ্গম তাই বড়লোকের বাচ্চাদের স্কুলও কোচ হিসাবে ডাকছিল। রোজগারও মন্দ হচ্ছিল না। এর মাঝে জার্নালিজমএ ডিগ্রীও করে ফেললো। এবার বাপের ভাষণ -চাকরী খোঁজ, এইদেশে ফুটবলে লাথি দিয়ে সখ মিটবে পেট ভরবে না বুঝছিস? বাপের কথা শুনেছিল বলেই আজ সখ মিটিয়ে ব্রাজিলে বসে ফুটবলে লাথি মারা দেখবে আর লিখবে। সাবওয়ে কিনতে যেয়ে কিশোর ছেলেটিকে দেখে চেনা লাগলো। ওর হাতে খাবারের প্যাকেট দিতে দিতে ছেলেটি বলে উঠলো -হাই কোচ হাউ আর ইউ? -রেহান! -মনে রেখেছ? -হাই গোরজেস তুমি এখানে? আকাশের মনে পড়লো বছর নয় আগে বিত্তবান দাদা ছোট্ট আদরের রেহানকে নিয়ে বিশ্বকাপ দেখতে গেলেন। খেলার সাথী বাচ্চারা শুনে মন খারাপ করেছিল খুব। বিত্তশালী পরিবারের রেহান নিউইয়র্কের অতি সাধারণ পারার ফাস্টফুড শপ সাবওয়েতে কাজ করছে দেখে অবাক। রেহানের জীবনের গল্প শুনে আকাশের প্রাণ হু হু করে উঠলো। ঘরভাঙ্গা বাবামায়ের সন্তান। দাদা-দাদীর কাছেই ছিল মূলত:। মেধাবী শিক্ষিকা মা আমেরিকাতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরীও পেল একজন সাদা সঙ্গীও জুটলো। স্কুলে ধনবানদের আমোদ নেশায় জড়িয়ে পড়ে রেহান। দাদা-দাদীর কাছে রেহানকে বাঁচানোর চেয়েও মানসম্মান বাঁচানো জরুরী ছিল। তাই রেহানকে মায়ের কাছে আমেরিকা পাঠিয়ে দেন। সেই থেকে নিজেকে বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছে। বাপের অনাদৃত, মায়ের কাছেও অনাহুত রেহান। বিশ্বকাপ ফুটবল তার সাধ্যের মাঝে নাই এখন। -কোচ তুমি ওখান থেকে ব্রাজিলের একটা জার্সি নিয়ে এসো; সস্তা হবে। আকাশ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখা ‘ব্রাজিলের জার্সি’ গল্পটা পড়ে মন খারাপ করেছিল এক সময়ে। আজও ঐ জার্সিই তার মন খারাপ করালো আবার।
ইন রাশা এ টিচার, ইন আমেরিকা এ ক্লিনার
প্যাথলজিতে ঢুকে ব্যস্তভাবে স্পেসিমেনটা মহিলার হাতে দিল আমিরা। ঢোলা এ্যাপ্রোনের ভেতর ঝিরঝিরে শরীরের রোগাটে চেহারার মহিলা কাগজে চোখ বুলিয়েই বললো -হয়নি, এই টেস্টের জন্য দু’ভাবে স্পেসিমেন দিতে হবে -মানে -ওয়ান ইন আইস, এখনি কন্টেইনার ও আইসপ্যাক দিয়ে দিচ্ছি -জিপিতো বলেনি -বোধহয় লিখতে ভুলে গেছে। দাড়াও আমিও নিশ্চিত করছি সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারে বসে কি যেন দেখে ভাঙ্গা গাল আর ক্লান্ত চোখে দৃঢ় প্রত্যয় ফুটিয়ে বললো -হ্যাঁ ঠিক তাই। আমিরা হতভম্ব। কোন প্যাথলজীকর্মি এতো দক্ষ হয় কি? হয় ভারত, শ্রীলংকা বা ফিজি থেকে এসেছে। আমিরার সাথে তার জেনারেল ফিজিশিয়ানের বন্ধুত্ব ভাল। সহানুভূতিশীল, ইতিবাচক জিপি মারিয়া পাইভা খুব জনপ্রিয়। গল্প অনেক হয়েছে। বলেছে তার একুশ বছরের মেয়ে খুবই মেধাবী তবে দুঃখজনক হল চব্বিশ বছরের ছেলের বুদ্ধি আট বছরের বাচ্চার মতো। তারপরও মহিলার হাসি অফুরান, বিরক্তি নাই এতোটুকু। প্যাথলজীকর্মি সম্পর্কে আমিরা জিপি পাইভাকে একদিন জিজ্ঞেস করলো। ঐ মহিলার দক্ষতা দেখে সে যে বিস্মিত তাও বলতে ভুললো না। জিপি তখন বললো -বুঝেছি কমল means Lotus এর কথা বলছো। জান ওর দেশে সে একজন ভাল ডাক্তার ছিল। এখানে এসে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেওয়ার মত ধৈর্য, মানসিক শক্তি কোনটাই ছিলনা। এখন মেডিকেল টেকনিশিয়ানের কাজ করছে। এই কাজে সে ভীষণ ভাল। আমি ইমিগ্রান্ট আমি জানি ইমিগ্রান্টদের অনেক ক্ষতি মেনে নিতে হয়, দুঃখ সহ্য করতে হয়। এখানে ও সুযোগ পেলে ডাক্তার হিসাবে নাম করতো। সবই ভাগ্য। আমিরার একটা সিনেমার কথা মনে পড়লো। বাচ্চাদের সিনেমা ‘পলি’তে পলি নামের টিয়াপাখির সাথে আমেরিকার কোন এক গবেষণাগারের সাফাই কর্মীর গল্প চলে। লোকটি নিজদেশ রাশিয়াতে শিক্ষক ছিল এখানে ময়লা সাফ করে। সে বলেছিল In Russia I was a teacher, in America I am a cleaner. বাস্তবে এমন কিছু দেখবে স্বপ্নেও ভাবেনি আমিরা।
আগের অংশ
দিলরুবা শাহানা, মেলবোর্ণ
|