দিলরুবা শাহানা'র ১০ টি অনুগল্প
আগের অংশ পরের অংশ
সংখ্যা ৭০৭...
ট্যাক্সি ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই সিটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ ড্রাইভারের সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম আরে একি কাণ্ড! হঠাৎ কখনও কোন সংখ্যা শঙ্কা জাগায়, ভীত করে আমাকে। এই ভীতি, এই আশংকা একান্তই আমার নিজের। এই সংখ্যা-ভীতি কেন তার রহস্য আমার নিজেরই অজানা। এই শঙ্কা অযথা কিনা তাও জানি না। এখনই এই ট্যাক্সি থেকে নামতে হবে। মুহূর্ত দেরী করা চলবে না। জানলা দিয়ে লাফিয়ে বেরুতে পারলে বের হয়ে যেতাম। চলন্ত যান। তা থেকে লাফিয়ে নামা সম্ভব না। চালককে উঁচু গলায় বললাম
-ট্যাক্সি থামান, একটা জিনিস ভুলে ফেলে এসেছি! -ঘুরে যাই অফিসে? -না না আপনি এখানেই থামান, প্লিজ
তাড়াতাড়ি রাস্তার কিনারে চালক ট্যাক্সি থামালো। আমি হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। দয়ালু চালক দ্রুত নেমে এসে আমাকে তুললো। আমার ভীত অবস্থা দেখে আমাকে ধরে ধরে কয়েক মিটার দূরে ক্যাফেতে ঢুকলো। ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ীটি প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হল। দুজনই দারুণ ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম। সংখ্যা-ভীতিই কি আমাকে বাঁচিয়ে দিল? সপ্তাহ শেষে অফিসিয়াল এক অনুষ্ঠানে যেতে হল। হলে ঢুকছি গেটে দুই স্মার্ট মেয়ে হাতে একটি ছোট্ট টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো keep it, you might win a prize। টিকেট পকেটে রেখে সামনের সারিতে আসন নিলাম। অনুষ্ঠান শেষে ঘোষণা হল এখন র্যাটফল ড্র হবে প্রথম পুরষ্কার বিএমডাব্লু গাড়ী। টিকিট হাতড়ে বের করতে করতে জয়ী নম্বর তোলা হল। আমার নম্বর দেখার আগেই মঞ্চে জয়ী নম্বর ঘোষণা শুরু হল। শুনেই মনে হল এই নম্বর আমার হবেই না। হলে আলো জ্বলে উঠলো। সবাই যে যার টিকেট মেলে নম্বর পড়ছে। আমি অবাক হয়ে দেখি যে সংখ্যা দেখলে আমি শঙ্কিত হই সেই জয়ী হয়েছে। আমার টিকেট সেটি। আমি জিতেছি গাড়ী। রহস্যজনক ভাবে নিমেষে ভয়ভীতি উধাও। আমি নির্বিঘ্নে ঐ গাড়ীই চালাচ্ছি অনেকদিন। সংখ্যা-ভীতির বলয় থেকে আমি এখন মুক্ত, মুক্ত!
বেনীআসহকলা
ক্রিং ক্রিং। -হ্যালো ও রাইয়ত। কি ব্যাপার ভালতো? -হ্যাঁ ভাল, শুন রুবাইয়া ফোন করে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় তোমাকে রাজী করানোর জন্য আমাকে ভীষণ অনুরোধ করেছে, তুমিতো ওকে অনেক উৎসাহ দাও জানি। কি হয়েছে বলতো? -ওর বিজনেস পার্টিতে যাব না বলিনি। তবে পোশাকের বর্ণনা শুনে আমি বললাম আমারতো ঐ সময় ও নকশার কাপড় নাই -তারপর তারপর কি বললো - তুমি কি লেংটা, হো হো -হা হা তারপর - তারপর ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে বললো তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো। -তুমিতো ওর দেশী জিনিস প্রোমোট করার কাজে অনেক উৎসাহ দিয়েছ ঠিক না? জান তুমি একটি রাজহাঁস -মানে -ঐ যে হেসে ওর কথা ঝেরে ফেলে দিয়েছ। -গণ্ডার বললেনা? -গণ্ডার খুঁচা টের পায় অনেক দেরীতে। আর তুমি তার আগেই সব ঝেড়ে ফেল। তোমাকে খুঁচায় সাধ্য কার - কাপড়টা যে সময় আর নকশার হতে হবে... -শুন আমার প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর না শ্রীলংকার এক বুড়ি মহিলা আছেন তার অনেক শাড়ী। নিজে পড়তে পারে না এখন। কেউ পরতে চাইলে খুশী হয়ে ধার দেয়। ওর কাছ থেকে অনেক শাড়ী নিচ্ছি, তোমার জন্য রুবাইয়ার স্পেসিফিকেশন মত শাড়ীও নিয়ে আসবো -কিন্তু ব্লাউজ পাব কি ভাবে? -শুন সাদা কালো ছাড়াও সব মেয়েদের Richard Of York Gave Battle In Vain রং এর ব্লাউজ থাকে তাইনা? -তুমি বোঝাচ্ছো বেনীআসহকলা। তাতো আছেই। -বাহ্ এইতো বুঝে গেছ। সমস্যা মিটে গেল। তুমি গেলে রুবাইয়ার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। - ওর মেধা আর পরিশ্রম ওর সম্পদ। -না না ও আমাকে বলেছে তোমার পরামর্শ শুনে ওর অনেক উপকার হয়েছে। -ওর শ্রম আর বুদ্ধির জোরেই হ্যারডস এর মত নামীদামী দোকানে দেশী পণ্য ঠাই পেয়েছে, এই কারণে কত সাধারণ মানুষ অসাধারণ সব জিনিস হাতে বানানোর সুযোগ পেয়েছে। তাদের রুটিরুজির ব্যবস্থা হয়েছে। যদিও জানি মজুরী খুব কম তবু কাজতো আছে। -আপু তুমি খুব বোঝদার, এই জন্যই রুবাইয়া তোমাকে এতো মর্যাদা দেয়!
অনাহুতের খতি
গাড়ীগুলো সাড়ে সাড়ে আসছে। বিয়ের সেন্টার থেকে বাড়ীমুখী সবাই। সবার আগে বিষয়টা কিশোয়ারেরই চোখে পড়লো। ওর এমনিতে আজ দুঃখী মন। এখন ভয়ে কেঁপে উঠলো। বাড়ীর গেট খোলা। ব্যাপার কি? গাড়ী গেটের ভিতরে ঢুকতে সবার চোখে পড়লো বারান্দার ছোট্ট ঘরটার দরজাও হাট করে খোলা। ঘরে আলোও জ্বালানো। গাড়ীবহর থেকে সবাই দুদ্দাড় নেমে পড়লো। একজন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মূল ঘরের দরজার তালা দেখে চেঁচিয়ে বললো -এই তালা কেউ খুলেনি! এবার সমবেত উচ্চারণ যাক। ঘরে ঢুকেই সবাই যে যার ব্যাগস্যুটকেস খুলে দেখতে ব্যস্ত হল। এবার সবার চেহারায় স্বস্তির ছাপ। অর্থাৎ কারোর কিছু হারায় নি। দুঃখের মাঝেও কিশোয়ারের হাসি পেল। যে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, যাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হল না তাকে সন্দেহ করে জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে কি না পরীক্ষা! -যাক আপদ নিজেই বিদায় নিয়েছে ফুপুশাশুড়ী প্রথম মন্তব্য করলেন। কিশোয়ারের বড় জা বললেন -কিশু তো ছোটকাকাকে বিশবাইশবছর আগে একবারই দেখেছিল, উনার কীর্তিকাহিনী কিছুই জানে না -কিশুর মেয়ের শুভকাজে ও কাউকে দুঃখ দিতে, অসম্মান করতে চায়নি তাইতো ঐ ভবঘুরেকে... -তাওতো সবার ভয়ে বারান্দার ঘরেই থাকতে দিতে বাধ্য হলাম। আর কোন কথা না বলে কিশোয়ার নিজের ঘরে ঢুকলো। ওর একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলেই নিজেদের পূর্বপুরুষের এই বাড়ীতে ফেরা। এই আনন্দ যজ্ঞে অনাহুত একজনের হঠাৎ আগমন। যার অতীত-বর্তমান আত্মীয়পরিজন সবার কাছে ধোঁয়াশাময়। নিখোঁজ থাকেন। আচমকা হঠাৎ কখনও বা উদয় হন। তখনি বাড়ীর মূল্যবান কিছু না কিছু তার সাথেই উধাও হয়। এসব কিশোয়ার নিজে দেখেনি। শুনা কথা। দু'দিনের মাঝে কথা হয়নি তেমন। তবে তিন বেলা ও নিজে বসে থেকে খাইয়েছে। মলিন বেশবাস ফেলে গোসল সেরে কিশোয়ারদের দেওয়া সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবী পরলেন। হাভাতের মত নয় রাজকীয় কেতায় খাবারগুলো খুব তৃপ্তির সাথে খেয়েছিলেন। মেয়ের কথা, অনাহুত অনাদৃত এই আত্মীয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুম নেমেছিল। শীতের সূর্য পর্দার ফাঁক দিয়ে তার আগমনী জানান দিল যখন তখন চোখ খুললো। হঠাৎ চোখ পড়লো গদিআটা মোড়ার নীচে কি একটা বসে আছে। বিড়াল হবে হয়তো। নাহ ওখানে বিড়াল ঢুকা অসম্ভব ব্যাপার। বিছানা থেকে নেমে মোড়া সরাল। খয়েরী রঙ্গা জীর্ণশীর্ণ কাপড়ের ব্যাগ। পথিকের খতি! কিশোয়ারকে খতিটা তুলে রাখতে দিয়েছিলেন । সে কাজের মেয়ে মর্জিনার হাতে দিয়ে বলেছিল -আমার ঘরে রেখে আয় মর্জিনাও মর্যাদা দেয়নি তাই মোড়ার নীচেই ঠাঁই হয়েছে খতির। হাতমুখ ধুয়ে কিশোয়ার ফুপুশাশুড়ীর কাছে গেল। তাকে ঘিরে সবাই বসে। খতিটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো -ছোটকাকা ফেলে গেছেন বিরক্তি নিয়ে হাত দিয়ে খতিটা সরিয়ে বললেন -ফেল ওর ভিক্ষার ঝুলি -দেখি কি আছে এতে বলে বড় জা খতিটা নিলেন। খয়েরীর ভিতরে নীলরঙা কাপড়ের এনভেলপ আকৃতির আরেক খতি। তার ভিতর কয়েকটা কাগজের পুটুলি। প্রথম পুটুলি খুলেই হতবাক। আইভরির উপর সোনার তারের কারুকাজ করা মোটাসোটা এক বালা। ফুপুশাশুড়ী ছোঁ মেরে বালাটা নিলেন -আরে এটাতো আমার দাদীর বাজুবন্ধ, আর কি কি আছে দেখি! ঠিক সেই সময়ে সদর দরজায় হইচই। সবাই ছুটলো সেদিকে। একজন লোক খবর নিয়ে এসেছে। তিন মাইল দূরে রেল স্টেশনের বেঞ্চে এই বাড়ীর বুড়ো অতিথিটি মরে পড়ে আছে।
মিথ্যা না বলার অপরাধে
ঘটনা সত্যি। মিথ্যা বলতে পারে নি বলেই শাস্তিটা পেয়েছে। বড়ই অপদার্থ। সামান্য একটা মিথ্যা মুখে জোগালো না। থাকুক আজীবন দেশছাড়া হয়ে। গল্পটা করছিলেন তেরঙ্গা চুলের দারুণ স্মার্ট মহিলাটি। দশ নখে দশরকম নকশা। হাত নেড়ে কথা বলার কারণে নকশাগুলো মানুষের নজর কাড়ছিলো। -মিথ্যা কেন বলতে হবে কোন ক্রাইমে জড়িয়ে... -ক্রাইম ট্রাইমে জড়াইনি ভাই। -তবে -গাড়ি ড্রাইভ করতে পারি বিদেশ থেকে গেছি বাহাদুরি দেখানোর জন্য মাকে না বলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম -তারপর তারপর কি হল? -ইস্কাটন থেকে রাজারবাগ পুলিশ-লাইনের কাছাকাছি যেতে না যেতেই ধাক্কায় রিকশাওয়ালার কান বেয়ে রক্ত রক্ত! বাসা থেকে বেরনোর পাঁচসাত মিনিটের মাঝে এই বিপদ! -যানজটে পড়েন নি? -আগে এতো ভিড় ছিল না। তবে পুলিশে-মানুষে সয়লাব নিমেষে। মেয়ে-ড্রাইভার এক্সিডেন্ট করেছে দেখে উৎসাহ দ্বিগুণ। বাবার ফোন নম্বর চাইলো পুলিশ। বললাম বাবা বিদেশে মাকে ফোন করুন। ততক্ষণে রিকশাওয়ালাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ডাক্তারের কাছে পাঠালাম। আমার ড্রাইভার্স লাইসেন্স সাথে ছিল না। পুলিশ ধরে নিয়েছে আমি গাড়ীটা চুরি করে এনেছি। -আপনার মাকে ফোন করেছিল পুলিশ? -হ্যাঁ করেছিল। আরেক কাণ্ড -কি কাণ্ড বলুন -পুলিশ জিজ্ঞেস করলো অমুক নাম্বারের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে এটা কি আপনার গাড়ি? মা বললো জানিনা গাড়ীর নম্বরতো মুখস্থ নাই, যে গাড়ীতে আছে তাকে দিন তাইলেই বুঝবো। বলেই লাইন কেটে দিল। -তারপরে কি ঘটলো -তার পরেই আবার মাকে ফোন করে আমাকে কথা বলতে দিল। মা আমাকে বললো থানায় মামার পরিচিত এক চালিয়াত বসে আছে সে যা বলবে আমি যেন মাথা দুলিয়ে সায় দেই তাতেই পুলিশ বাপ বাপ বলে আমাকে ছেড়ে দিবে। থানায় গেলাম। গারফিসের মতো চিকনা, পান খাওয়া লালমুখো সাদা পায়জামা শার্ট পরা একলোক আমাকে দেখে বিরাট এক হাসি দিয়ে বললো আরে ভাগ্নি তুমি কুনখান থন, তা খবর ভালাতো? আমি মাথা উপরনিচ দুলিয়ে বুঝালাম হ্যাঁ। তারপরেই দারোগাবাবুর দিকে ফিরে জিব কেটে বললো স্যার করছেন কি সেতো বরিশালের জনাবের ছাওয়াল তারে আনছেন কিয়ারতে পিনপতনের শব্দ নাই গল্প জমে উঠেছে। তারপর মহিলা ভয়ার্ত স্বরে বললেন - চালিয়াত আমার দিকে ফিরে যা বললো তাতে আক্কেল গুড়ুম তুমি বরিশালের নাসরুল্লাহ চৌধুরীর মাইয়া, মনু তোমাগো কত নুন-নিমক খাইছি ঠিক না? এবার আমি দুইপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম না। মিথ্যাটা বলিনি তাই মা মামার অসংখ্য বকুনিঝকুনি খেয়ে সমস্যা মিটমাট করলাম। তাদের হুকুম আর কখনও দেশ আসবি না।
আগের অংশ পরের অংশ
|