দিলরুবা শাহানা'র ১০ টি অনুগল্প
রুমির রবীন্দ্রে বিরাগ
মানুষ রবীন্দ্র অনুরাগী হয়। রুমির ক্ষেত্রে কথাটা খাটে না। ওর রাগ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের উপর। বহুমুখী প্রতিভা নাকি ভদ্রলোকের। শুনেছে মানবিক সব অনুভূতি ও চরিত্রের সব দিক তার লেখনীতে নাকি প্রকাশিত হয়েছে। রুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত যত শুনেছে রবীন্দ্রসাহিত্য ততো পড়েনি। স্কুলে পাঠ্য ছিল বলে ‘ছুটি’ গল্পটি পড়া। মামাবাড়িতে আশ্রিত পিতৃহীন ছোট্ট ফটিক অনাদরে অবহেলায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ফটিকের জন্য খুব দুঃখ হয়েছিল আর ফটিকের মামীর উপর ভীষণ রাগ।
এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শুধু আশ্রিত জনের দুঃখকষ্ট দেখেছেন। তাই সেই চিত্র এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার মত দুঃখী আশ্রয়দাতার সমস্যা, অপমান, বিড়ম্বনার কথাওতো একটু লিখতে পারতেন? কই লিখেন নিতো। কবির সময়ে ওই রকম লাঞ্ছিত, কুণ্ঠিত মামা ও তার বিচ্ছু ভাগ্নি কি ছিল না?
বোন ক্যান্সারে মারা গেল। তখন কিশোরী মেয়েটি মা হারানোর দুঃখে বিষাদগ্রস্ত, রাগত:। আদর, উপহারে ওর মন খুশী রাখার চেষ্টা চলছিল। তখনই মেয়েটির বাবার অনুরোধে ও নিজেরও স্নেহের তাগিদে রুমি ওকে বিদেশে আনালো।
রুমির বউ ইতালীয়। সে ভাষ্কর্যশিল্পী। শিল্পশিক্ষানিকেতনে ভাষ্কর্য শেখায়। বউয়েরও সায় ছিল এতে। এসে মামার সাদামাটা বাসস্থান ভাগ্নির মনে ধরলো না। ওর ঠোঁট উল্টানো মন্তব্য শুনে রুমি বলেছিল
-শুন মা, বিদেশে সবার বাড়িঘর রানী এলিজাবেথ আর মাইকেল জ্যাকসনের প্রাসাদের মত নয়।
মেয়েটি সিনেমা-সেলিব্রেটি, জৌলুস সন্ধানী। কোন কাজ তার ধাতে সয়না। নিজে খেয়ে কাপ পিরিচ, বাসনকোসন ফেলে রেখে যেতো। এইদেশে কাজের মানুষ নাই নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। বলে বলে অভ্যাস করাতে হচ্ছে।
শপিংএ গিয়ে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বলা হলো। টয়লেট্রিজ থেকে শুরু করে জুতা যেটাই হাতে নিল সব নামীদামী ব্রান্ডের। স্যুয়েটার কেনার আগেই রুমির একপক্ষের বেতনের টাকা খতম। মা মরা ভাগ্নিকে বিবেচনা করে চলার কথা বলতেও সংকোচ হল।
ভোলাভালা শিল্পী বউ অতো কিছু খেয়াল করলো না। ভাগ্নিকে জন্মদিনে রেস্তোরাতে নিয়ে গেল। ভাগ্নি দামী খাবার শুধু নয় নানান পদও অর্ডার দিল। খেলো সামান্যই। যখন থালা-কাপ ধুয়নি, বাথরুম পানিতে ভাসিয়ে প্লামার ডাকতে বাধ্য করলো তখন নয়, আজ রুমি দেখলো বউয়ের চোখে বিস্ময়ের চাহনি। ভিনদেশী না হয়ে নিজদেশী মামী হলে এতদিনে ভাগ্নির খবর হয়ে যেতো।
পর্যুদস্ত মামাটি অবিবেচক মাতৃহীন ভাগ্নিকে দেখছে আর রবীন্দ্রনাথের উপর তার রাগ বাড়ছে,...
আকাশের অলিন্দে রবি
চাঁদ ছিল আর ছিল নীল নীলিমায় সাদা মেঘের উড়াউড়ি। এখন শীত তবুও জানলার কাঁচের ওপারে আকাশের অপার যাদু হাতছানি দিল। মনটা ভাল না। এক লেখার কারণে মানুষের বর্ষিত বাক্যে পুরস্কার তিরস্কার দু’টোই জুটেছে। তবে আসল কথাটা কেউ বলে নি, মন খারাপ তাই। মেঘগুলো থিতু হয়ে বসেছে। হঠাৎ দেখি মেঘের বাড়ীর অলিন্দে বরাভয় জাগানো রবির আবির্ভাব। নিষ্পাপ চেহারার কিশোর রবি, অপূর্বদর্শন তরুণ রবি নন আমাকে ভুলিয়েছে দীর্ঘ চুলদাড়িঅলা ঋষি রবি আর তার বানী। তার মানে কম বয়সের কোন কথা বা লেখা কি আমাকে টানে না। আসলে ঐ ঋষি তার মনে বাস করতো বরাবরই। ঐ ঋষিই বলিয়েছে সবকথা। তাঁর সঙ্গে শুরু করি গল্প। -মন ভাল নেই! -কেন? এমন আবছা চাঁদের আলোতে অজানা আনন্দে মন ভেসে যাওয়ার কথা তাই না? -আপনি কবি আপনার সবটাতে আনন্দ ও সবটাতে দুঃখ খুঁজে পান, আমার মন খারাপের কারণ আপনি -ওমা কেন? -ঐ যে হতচ্ছাড়া রুমি বলেছিল রবীন্দ্রনাথ তার মতো আশ্রয়দাতার কষ্ট, অপমান-হেনস্তার কথা লিখেন নি, লিখেছেন আশ্রিত ফটিকের দুঃখকষ্টের কথা। -আমিই সব কিছু বলে ফেললে অন্য সবাই কি করতো তখন? এমন কি আমি নিজেও অন্যকে বলেছি কোন কোন বিষয়ে লিখতে। -তাইতো; আপনি কথাটা ঠিক বলেছেন। একটা বইয়ে পড়লাম কবি বন্দে আলি মিয়াকে আপনার জমিদারীর একঘর মুসলমান প্রজার কথা লিখেছিলেন তাকে বলেছিলেন তাদের জীবনযাপন উনি নিয়ে লিখলে ভাল হতো। রুমির কথা লিখে প্রশংসা-নিন্দা দুইই শুনছি... -কি রকম -যেমন কেউ বলেছে ‘বাহবা! রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে গেছে এমন বিষয় নিয়ে লিখেছ দারুণ হয়েছে’ আবার কেউ বলছে ‘সাহসতো কম না রবীন্দ্রনাথ দেখেন নি বা দেখতে ভুলে গেছেন এই কথা বলা!’ তবে... -তবে কি? খুলে বলতো -আসল কথাটাই কেউ বলতে পারলো না -আসল কথাটা কি শুনি? -একবারও কেউ এতোটুকু ভাবলোনা, ভেবে বলতে পারলো না যে ‘আহা! রুমির গল্প যদি রবীন্দ্রনাথ শোনাতেন কি অপূর্বই না হতো বা ফটিকের কষ্টতো শুধু মামাবাড়ির অনাদর-অবহেলা নয়, ওর ফেলে আসা বন্ধনহীন সরল গ্রামের জীবনের জন্যও ছিল অন্তহীন আর্তি’। মৃদু হাসির রেখা ফুটলো কবির মুখে সাথে সাথে মেঘের রাজ্যে অদৃশ্যমান হলেন রবি।
বেচুবাবু
বাজেট এয়ারলাইন্সের লাউঞ্জে বসে ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। চা-কফি নাই। ভেন্ডিং মেশিন দুটোতে আছে চিপস্ আর ড্রিংক। লম্বা ঘরটার এক দেয়ালের বা দিকে একটা দরজা অন্য দেয়ালে ডানদিকে আরেকটা দরজা। যাত্রীদের আসা যাওয়াতে অটোম্যাটিক দরজা খুলছে আর হুড়মুড় করে ঠাণ্ডা হাওয়াও ঢুকছে।
হাওয়ার সাথেই সেও ঢুকলো। পরনে স্যুট। দীর্ঘদেহী শক্তসমর্থ এক তরুণ। তার চোখে চোখ পড়লো। পরিচিত হাসি ছড়ালো। ভেন্ডিং মেশিন থেকে জুস কিনে ওর পাশে এসে বসলো।
প্রায় বারো তেরো বছর আগে ছেলেটিকে দেখেছিল। সদ্য কৈশোর পেরনো। তখনও তার শৈশবের ননী মাখানো অবয়ব ছিল আদর কাড়া । তবে বসার ভঙ্গিতে উদ্ধ্যত্ত আর অবজ্ঞা। এমন ভঙ্গি যেন চারফুট দশ ইঞ্চি''র কালোপনা মেয়ে জানেই বা কি। সরাসরি তাকিয়ে নয় তবে নিচু গলায় যা বললো ওর কানে ঠিকই পৌঁছেছিল। গভীর কালো চোখের মেয়ে ভাষাটা ধরতে পারলো ঠিকই। মেয়েটি তার ভাষা শুধু বই পড়ে পড়ে শিখেনি। সে মানুষের মুখে শুনা শ্লীল-অশ্লীল শব্দের এক খাতা বানিয়েছে। ডিকশনারি আর বই থেকে ভাষা শিখে ভাব প্রকাশ করা গেলেও মানুষের অন্তরের অভিব্যক্তি ধরা কঠিন। সেও গলা উঁচু করে দৃঢ় ভাবে বললো -I will understand your four letters expression, cough it out please, cough it out ওর ভাষা ও বলার ভঙ্গিতে ছেলেটি থতমত খেয়েছিল। তারপর সে সহজ ভাবে তার কাছে এসে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য জেনে নিয়েছিল। নেপাল, ভারত, বাংলাদেশে যাচ্ছে মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে। হিমালয় পর্বত থেকে গারো পাহাড়ের পদতলে সুবিধা বঞ্চিত আদিবাসী শিশুদের মাঝে কাজ। ছেলেটির স্বপ্ন মানুষের মুখে হাসি ফুটানো ও তাতেই তার আনন্দ। যেখানেই কাজ করেছে হাসির ঝলক দেখেছে। তবে সবার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এমন কাজ একার পক্ষে বেশীদিন চালানো সম্ভব হয়নি। এবার সে বললো -এখন কি করছি জানতে চাও? আমি এখন বেচুবাবু। মানুষের অঙ্গ বেচাকেনা করি। জানতো যুদ্ধ একদলকে করেছে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু আর আরেক দলকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু। গরীব দেশের গরীব মানুষের কিডনি-লিভার এমন কি চোখও ধনী দেশের ধনী মানুষদের কাছে পৌঁছে দেই। দুই দলই খুশী। ওর চোখে বিতৃষ্ণা ও ভীতি দেখে ছেলেটি বললো -দেখ ড্রাগ-আর্মস বেচি না, মেয়ে বা পুরুষ কাউকেই পাচার করি না। যার যে অভাব সে অভাব দূর করে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করছি মাত্র!
রুশোর ডিভোর্স
উকিল পারায় উদ্ভ্রান্তের মত পৌঁছাল রুশো। আজ সকালেই তাকে ঘুমে রেখে বউ চলে গেছে। মেয়েটি ভাল। মায়ের পছন্দের মেয়েকেই রুশো পছন্দ করেছিলো। দু'জন দুই ধাঁচের মানুষ। মা ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ। যেদিন নিরামিষ সেদিন নিরামিষই হতে হবে, মুরগী-মাছ অবশ্যই চলবে না। বউ দেখা গেল মাছের দিনে নিরামিষ বা মুরগীর দিনে মাছ করে ফেললো।
মা হাল্কা গড়নের মানুষ। বউ সামান্য পৃথলা। মা স্নেহময়ী তবে প্রকাশে নীরব। বউ আন্তরিক ও প্রকাশেও সরব।
মা খুব পরিপাটি ও সদা সতর্ক। বউ সামান্য অগোছালো, একটু ভুলো-মনা। রান্না আছে জেনেও কাজ থেকে ফেরার পথে চাইনিজ খাবার কিনে নিয়ে আসলো। ড্রাইভারের বেতন ছয় হাজারের জায়গায় ভুলে খামে সাত হাজার দিয়ে দিল। ড্রাইভারটা ভালমানুষ তাই ফেরত দিয়ে দু’শো টাকা বখশিশ পেল। শাশুড়ি বিরক্তিকর নীরব-দৃষ্টিতে পুড়িয়েছিলেন পুত্রবধূকে। শাশুড়ির নিখুঁত নিটোল গোছানো থাকা দেখতে দেখতে বউ একসময় ত্যক্তবিরক্ত হয়ে এক কাণ্ড করলো। এমন এক ফ্রিজ ম্যাগনেট খুঁজেপেতে কিনে আনলো যাতে লেখা Dull women have immaculate houses । এই বানী শাশুড়ির সদা গোছগাছ, ফিটফাট থাকাকে মাথা-শূন্য কাজ হিসাবে গণ্য করলো। শাশুড়িও ছাড়বার পাত্রী নন। পুত্রবধূর ভোজনে অনিয়ম ও বৈচিত্র্য দেখে বিরক্ত। মেয়েটি বিরক্তি গায়ে না মেখে তার ঢলোঢলো স্বাস্থ্য ও হাসিখুশি মন নিয়ে ভালই দিন কাটাচ্ছিল। শাশুড়ি এক কাণ্ড করলেন। এক সূচীকর্ম করিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে খাবার ঘরে টাঙ্গালেন। যাতে লেখা
By eating less and less women enhance their buautiness
রুশো মহা বিপদে। দু'জনই রুশোকে দারুণ ভালবাসে; রুশোও ঠিক তাই। সমস্যা হল দুই নারীই তাদের বুদ্ধির তরবারি দিয়ে পরস্পরকে খুঁচিয়েই যাচ্ছে। আর বেচারা রুশো দুই নারীর তরবারির ঝলসানিতে ভীত কম্পিত। সে এসেছে এদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সে কাউকে ডিভোর্স দেবে না। সে চায় এরা দুজন যেন রুশোকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়।
পরের অংশ
|