সেই পুরাতনে... ডালিয়া নিলুফার (মানুষকে দুর্ভাবনায় ফেলা যত সহজ, ভাবনায় ফেলা অতটা না। সকালে পত্রিকা নিয়ে বসেছি। প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রিয় পুত্র নুহাশ হুমায়ুনের লেখা বেরিয়েছে। তাই পড়ছি। মনে হয় এই তার প্রথম লেখা। পিতার জন্মদিন উপলক্ষে তাকে যতখানি সম্ভব মনে করতে চেষ্টা করেছে। আনন্দ এবং বেদনার স্মৃতিকথা। পড়তে পড়তে মনে হলো, এই তরুণের লেখা আমাকে ভাবনায়তো বটেই, আরও ফেলে দিল পরপর কয়েকটা প্রশ্নের মধ্যে। তার সহজ কথাগুলি, যাকে আমি ঠিক লেখা বলে মনেই করতে পারলাম না। শুধু মনে হলো কতগুলি সত্যকে সে নির্দ্বিধায় সামনের উপর যত্ন করে রাখল। এবং সেই সত্য যা উন্মোচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শ করল আমার মত অসংখ্য মানুষের মন। কিছু কিছু কথা কেন জানি মনের মধ্যে এক অদ্ভুত বেদনার্ত অবস্থা তৈরি করে। যা আমার কাছে আরও ভয়াবহ। কিছুইনা, কেবল পড়ার পর টের পেলাম ভিতর থেকে কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। কোন কোন লেখা মানুষের উপলব্ধিকে এত পরিষ্কার করে দেয়! আমরা কি এরকম কিছু শোনার অপেক্ষাতেই ছিলাম? সম্ভবত:।)
লড়াইয়ের যে ময়দানে বার বার হেরে যেয়েও মানুষ হাসিমুখে বলে ‘ভালো আছি’- তার নাম সংসার। সময়ে মসিবতের জিন্দেগী। ছাইভস্ম। নয়ত বড় জোর দড়ির উপর হাটা। হলোই বা। তবু কি কেউ বলে- “বেরিয়ে এস। নিপাত যাক সংসার?”
সংসারী মানুষ হলো শিকড় ছড়িয়ে থাকা গাছের মত। গাছ যেমন মাটি আঁকড়ে ধরে থাকে, অমন। এর শিকড় যে কত গভীরে! এর শক্তি যে কত বিস্তৃত, সংসারী মানুষ মাত্রেই তা বোঝেন। বুকভরা উদ্বেল ভালোবাসা নিয়ে তারা একে অন্যকে জড়িয়ে বাঁচে। এক অদ্ভুত নৈকট্য মানুষগুলিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সংসারের সেই ছায়ায় থেকে সন্তান সন্ততিও কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় এই ঘর, এই বন্ধন, তাদের নিশ্চিন্তের আশ্রয়। নির্ভাবনার ঠাই। সংসারের দুঃখকষ্টগুলির চেহারাও কেন জানি বড় সরল। মায়াভরা।
মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে জন্মানো মানুষ। বিচ্ছেদ তারজন্য অবধারিত। তবু দেখি বেঁচে থেকেও মানুষ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়। ছেড়ে যাওয়ার সাহস করে। একবার। দু'বার। বহুবার। কেন যে! তবে মানুষ সংসার ছেড়ে গেলেও সংসার কেন জানি মানুষকে ছাড়েনা। নতুন করে চার দেয়ালের মাঝখানে রেখে পুরনো কাহিনী বলিয়ে নেয়াই যেন তার কাজ।
কিন্তু ছেড়ে যেয়েও কি মানুষ ভোলে? সেই পুরনো মুখ, সেই পুরনো শূন্যতা কি তার ফুরায়? নাকি সেই শূন্যতা চাইলেও কেউ ভরে দিতে পারে? সংসারে কেউ কি কারও জায়গা নিতে পারে? সেই বন্ধন, সেই একাত্মতা চাইলেও কি মুছে দিতে পারে কেউ? ভরসা করার মত পুরনো সেই জায়গাটা কি মানুষ সত্যি ফিরে পেতে চায়না? সংসারের সেই পুরনো ছবিটা ঘুরে ফিরে কি আবারও সামনে আসেনা? মায়াভরা চোখে মানুষ কি তাকায়না তার দিকে? ভালোবাসার কাছে মানুষের অসহায়ত্বের কথা কি বলব!
চিরকাল যে জীবনে মানুষকে ধরে রাখাই সম্ভব হয়না, সাধ্যও থাকেনা, সেই জীবনে তাকে দখলে রাখারও কিছু নেই। কে পারে? এ হলো মানুষের আত্মতুষ্টি। যা সে মনে মনে তৈরি করে। করতে ভালোবাসে।
ওদিকে স্মৃতি মানেই হলো -এক মস্ত জাদুকর। স্মৃতির মত সম্ভবত: আর কিছু নেই যা মানুষকে এত সহজে বশে আনতে পারে। কি থাকে মানুষের স্মৃতিতে! ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা আর নিজের অসহায়ত্বকে সাথে করে মানুষ ঘর ছাড়ে ঠিকই, ভাবে সব ফেলে গেলাম। নির্ভার হয়ে গেলাম। অথচ যাওয়ার সময় ঠিকই মনের মধ্যে খুঁটে খুঁটে নিয়ে যায় চায়ের মগ’টা, পছন্দের সেই দু’একখানা গান, পুরনো ছবি, চিঠিপত্র, যা ছিল সব। ফেলে রাখা ছাতাটা। দরজার ধুলোভরা পাপোশ। এমনকি দেয়ালে টানানো পুরনো ক্যালেন্ডারটা পর্যন্ত। বুক ভরে নিয়ে যায় হাসি তামাশার মুহূর্তগুলি, একান্তের মান অভিমান, যা সে ভালোবাসতো। ভুল করে হলেও নিয়ে যায় সেই পুরনো কথা কাটাকাটিগুলি, যা সে কোনদিনও ভালোবাসেনি। সব। কষ্টের কথা হলো এই, মানুষ আসলে ভারমুক্ত হয়ইনা কোনদিন।
চলে যাওয়ার মধ্যে একধরনের স্বার্থপরতা থাকে সত্যি। তবে বিনা কারণে মানুষ যে ঘর ছাড়ে, তাওনা। পুরনো সেই ঘর দরজা, উঠোন, আগাছা আর ধুলোবালির মধ্যেও এমন মায়া মিশে থাকে! কে চায় উঠে আসতে? সহজে ছেড়ে যেতে? সংসারে না পাওয়ার কষ্ট আর অতৃপ্তির সাথে ক্ষোভের আস্তর জমে গেলে ছেড়ে যাওয়ার জেদ বোধহয় আপনা আপনিই তৈরি হয়ে যায়। ন্যায় অন্যায় কেইবা বোঝে তখন? মনে হয় সেই ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যায় মানুষের।
সংসার ছেড়ে যাওয়ার কারণও জনে জনে ভিন্ন, বুঝি। তবে কারণ যত ভিন্নই হোক, সবার লক্ষ্য একটাই। সুখী হওয়া। জানিনা সুখ খুঁজে পাওয়ার জিনিষ কিনা আর সুখ খুঁজলেই পাওয়া যায় কিনা। তবে আশ্চর্যের কথা হলো, সুখের মত দুষ্প্রাপ্য একটি জিনিষ পাওয়ার জন্যে মানুষকে কেন জানি অন্যের কাছেই হাত পাততে হয়। আর মানুষ করেও তাই। একে যে ঠিক কি বলব!
পরে কি ভাবে জানিনা। সংসার ছেড়ে এসে প্রথমেই ভাবে, আহা! এইতো চেয়েছিলাম!” আসলে মানুষ নতুন করে করেনা কিছুই। উঠে যেয়ে তারা সেই ঘরটাই বাঁধে যা ছিল আগেও। যার বলতেই চারটা দেয়াল। একটা ছাদ। তার তলায় তৈরি হওয়া সেই পুরনো সাংসারিক কাহিনী। নতুন শরীর। পুরনো চরিত্র। শরীরের নতুনত্বই বা কিসে? সেইতো জ্বলে ওঠা আর নিভে যাওয়া। চিরকাল একইতো। একইসাথে জন্মদান এবং মৃত্যুশোক। মাঝখানে যা আছে গতানুগতিক। সেইতো দেখি, বাজার সদাই। লালন পালন। স্বার্থের টানাটানি। তথা শরিকি ঝামেলা। পুরনো দোষা-দুষি। ক্ষ্যামা ক্ষান্ত। অভিমান। বিস্তর ক্ষোভ আর কোত্থেকে উড়ে আসা সন্দেহ। অতঃপর আবারও ঘুরেফিরে একা হয়ে যাওয়া। নিঃসঙ্গতার চাপা কষ্টে ভোগা। দু’টি সংসারে কেবল মানুষগুলি ছাড়া নতুন করে মানুষ আদৌ কি পায় কিছু? অন্তত: এমন কিছু যা সে জীবনে দেখেনি? সত্যি বলতে কি, প্রতিপক্ষ নামের অনায়াসে তৈরি হওয়া সেই ছায়া শত্রুর সাথে মানুষ তার আজীবনের যুদ্ধটা একরকম পাকাপাকিই করে ফেলে। সময় যে কিসের প্রতিশোধ নেয়, কেজানে!
মানুষের চরিত্র বলতেই ভিন্ন। কিন্তু সংসারের চরিত্রতো একটাই। এর না আছে ক্ষয়, না আছে বদল। সংসার যা বোঝার তা একবারই বোঝে। তার চাওয়াও সোজা-সাপটা। কাছের মানুষকে জড়িয়ে আপন হয়ে থাক। সংসার সবকিছু গ্রহণ করেনা। মেনে নেয় মাত্র।
পাওয়া না পাওয়ার এই জীবনে কেন জানি - না পাওয়ার হিসেবটাই মানুষ আগে করে। যদি বলি - কি দিয়েছ সংসারে? হেসে বলবে -“যথাসাধ্য”। আর যদি জানতে চাই - “সংসার কি দিল”? তখন বেশীর ভাগই শ্বাস ফেলে মনমরা উত্তর দেয়- “কি আর-----!” এই নিঃশব্দ শ্বাস পতনে বোঝা যায়, এ জীবনে না পাওয়ার ইতিহাস মোটামুটি কারোরই কম না।
অনেক সময় সংসারে তার দাম বাড়ল কি কমল, তার উপর কড়া নজরদারী করে মানুষ। যা না করলেই ভালো ছিল। কেননা নিজের দরদাম নিয়ে কোনমতে সন্তুষ্ট হয়না মানুষ। হওয়ার কথাও না। ফলে অবিশ্বাস, উপেক্ষা আর বিতৃষ্ণা জড়িয়ে জট যা বাঁধার তা বাঁধে। এবং শেষপর্যন্ত এতকাল ঘরের কোনে লুকিয়ে থাকা ’অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাব’ নামের সেই অদৃশ্য শত্রুকে তারা সামনে টেনে আনে। এরপর যে কি হয়! দেখি সেই ক্ষোভের নিষ্পত্তি হতে না হতেই মোহভঙ্গ মানুষ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। যেন খেলা শেষ। তাই উঠে যায়। পড়ে থাকে পুরনো ঘর গেরস্থালী। স্তূপ করা স্মৃতির তলায় আঁটকে থাকে সন্তান সন্ততি। পরিবার। যেন ভাঙ্গা পুতুল। হতভম্ব, বিপর্যস্ত। তারচে বেশী - দিশেহারা। যেন কেউ তাদের দণ্ড দিয়েছে। যাবজ্জীবন প্রশ্নবিদ্ধ হবার দণ্ড। যেন ভরা ফসলের খেত। অসময়ে মরে গেল। অথচ আশ্চর্য এই যে, তারা ঠিক বেঁচেও থাকেনা আবার মরেও যায়না। যাদের শ্বাস এবং দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে বলতে গেলে কোন তফাৎই থাকেনা আর। চারপাশ থেকে কেবল উঠে আসা বিষাদময় অন্ধকারের মত ছি-ছিতকার দেখে মানুষগুলি প্রায়ই ভাবে, তারা কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছিল?
সংসার প্রতিভার কদর করলেও অল্পবুদ্ধির মানুষ নিয়ে মাথা ঘামায়না। উদ্বিগ্নও হয়না। যতটা উদ্বিগ্ন হয় মানুষের দায়িত্ব হীনতা আর নির্মম স্বার্থপরতা দেখে। সংসার মেধার চেয়ে সহস্র গুন বেশী কদর করে মানুষের সহনশীলতাকে, বিবেকবোধকে। সংসারের ধর্মই তাই। তবু যেন মানুষ বুঝতেই পারেনা। কি আছে মানুষের জীবনে মনে রাখার মত, এক ভালোবাসা ছাড়া? মানুষেরতো সম্বল বলতেই এই। তবে সংসারে বিশ্বাসভঙ্গের কষ্ট যত তীব্রই হোক, অসম্মানিত হবার লজ্জা আর অপমানের ইতিহাস যত দীর্ঘই হোক, সম্পর্কের কাছে, দাবীর কাছে, সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। জলের কাছে শক্ত মাটি যেমন ভিজে নরম হয়ে যায়, অমন।
তারপরেও যখন কোন কিছুই আর পেরে ওঠেনা, তখন বাকী থাকে - চলে যাওয়া অর্থাৎ -‘মৃত্যু’। আর মৃত্যুই মনে হয় জীবনের শেষ আশ্চর্য নাটকীয় ঘটনা যা মানুষকে মুহূর্তেই একত্রিত করে। সমস্ত ক্ষোভ আর দূরত্বের বিনদাস অবসান ঘটায়। মৃত্যু মানুষকে সতর্ক কতখানি করে জানিনা তবে তার উপলব্ধিকে সহজ করে দেয় অনেকখানি। জীবিতের সাথে মৃতের এই একাত্মতা শুধু এটুকুই প্রমাণ করে সংসারে প্রত্যেকেরই থাকে নিজস্ব জায়গা। থাকে চিরকালের বন্ধন। যে একাত্মতা বারবারই বলে দেয় -“আমি ছিলাম। আমি আছি”। |