রমতা যোগীর পদাবলী (৪) ডালিয়া নিলুফার
সাধুরা সবকিছু দেখে শুনেও কেন জানি চুপ করে থাকে। থাকতে পারে। দুনিয়া জুড়ে মানুষের যত বড় সফলতাই হোক তা নিয়ে যেমন উল্লাস করেনা, ব্যর্থতা নিয়েও তেমন উদ্বিগ্ন হয়না। স্নায়ুতন্ত্রকে স্পর্শ করার মত এ জীবনে এতকিছু ঘটে তবু কোনকিছুই তাদের উদ্বেলিত করেনা। জরা মৃত্যুর বাইরে কে আছে? তারপরেও মৃত্যু নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। শঙ্কাও না। নির্লিপ্ত, নির্বিকার । যেন যা হবার, তাইতো হয়েছে। তাদের নির্জীব কায় কারবার দেখে সাধারণ লোকের সন্দেহ হয় । সেটা এই কারণে যে, কেন জানি রহস্য একটা তারা তৈরি করেই রাখে। এদের মধ্যে আরও আছে মৌন-সাধু। যাদের অন্য নাম পাগলা মৌনী। শুনেছি এরা কোন কথাই বলেনা। কেবল শোনে।
সাধু সন্ন্যাসীর ভাবচরিত্র বলতেই আলাদা। তারা বাহুল্যবর্জিত, আয়োজন বিহীন। ত্যাগী এবং কম কথার মানুষ। সাধারণ জনজীবনের সাথে তাদের ওঠা-বসাও কম। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই, খাওয়া পরা নিয়ে পার্থক্য থাকলেও সাধারণ মানুষের সাথে তাদের কেন জানি অমিলের চেয়ে মিলই বেশী। দৃষ্টির বাইরে থাকা, পারিপাট্যহীন এই জীবনের মধ্যেই আছে মানব সন্তানের চিরাচরিত স্বভাব। লোভ, হিংসে ক্ষোভ, খুনোখুনিতে, এমনকি ধর্ষণেও তাদের স্বভাব চরিত্র আর দশটা মানুষের মতই। হেরফের কোথায়? কেউ ছুরি চালালে অন্যজন বড়জোর মন্ত্র পড়ে কাজ হাসিল করে। করেতো খুনই।
তবে তান্ত্রিক সাধু বোধহয় জগতের এক বিরল চরিত্র। হিন্দু মুসলমান বলে এদের কোন জাত ভেদ আছে বলেও মনে হয়না। গলায় রুপো নয়ত রুদ্রাক্ষের মালা। লম্বা খোলা চুল। পরনে লাল আর গেরুয়া রঙের পোশাক। তবে বেসবাস যেমনই হোক, ঘুরেফিরে তাদের কাজকর্ম সবই এক।
শুদ্ধ মানুষ হবার জন্যে মানুষের চেষ্টা কতখানি তা সঠিক বলা যায়না। কিন্তু তান্ত্রিক সাধুদের সিদ্ধ পুরুষ হবার চেষ্টা দেখার মত। তান্ত্রিক জ্ঞান মানেই হলো গুরুমুখিয়া বিদ্যা। পাঁচ বছরের শিশুর সারল্য, প্রখর জ্ঞান, পৈশাচিকতা এবং উন্মাদনা- এই চার গুন তান্ত্রিক সাধুর থাকতেই হবে। আর এই বিদ্যা যখন তারা আয়ত্ত করে তখন অমাবস্যায় মরণ, উচাটন, বশীকরণ কোনটাই কি বাদ যায় তাদের? যায়না। মানুষ ভেবে পুতুলের উপর যখন তীর চালিয়ে তাকে মারে তখন লোকে বিশ্বাস করে। না করে পারেনা। যে অবিশ্বাস্য দুর্ভোগের কথা অভিযোগের মত করেই বলে মানুষ।
কতখানি কাজের কথা জানিনা। তবে এই সিদ্ধ পুরুষ হতে ‘আড়বন্ধ’- নামের যে নেংটি তারা কষে বাধেন শুনেছি তার একটাই উদ্দেশ্য - শারীরিক কামনার উগ্রতাকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া। নয়ত মেরে ফেলা। যেন ইচ্ছেরা স্বপ্নেও না আসে আর। বয়সের তানাভানা আর ইন্দ্রিয়ের মার ঠেকাতে শুনেছি সময়ে যোগাসনেও বসেন। নয়ত জপতপ করেন।
তবে সাধুদের সমস্ত কাজের পিছনেই থাকে আত্মার শুদ্ধির কথা। আগে পায়ে হেটে আর এখন সভা ডেকে, লোক জড়ো করে আত্মশুদ্ধির কথা বলেন তারা। যার নাম ধর্ম প্রচার। তবে জেনে না জেনে করা পাপের কিছু না কিছু প্রায়শ্চিত্ত তাদেরও করতে।
ধুপ-ধুনো, কল্কে, চিমটের সাথে জড়িয়ে যে জীবন, সে জীবন বিচ্ছিন্নতার। সম্পর্কহীনতার । দেখে মনে হয়, দুঃখ-বিরহ, শোক-সন্তাপ, এমনকি স্মৃতিও টানেনা তাদের। তবু অমনই ভালোবাসে সাধুরা। মানুষের সংস্পর্শ থেকে এই দূরে থাকার কারনটা পরিষ্কার করে বোঝা যায়না। সভ্যতার সমস্ত নির্মাণ, সমস্ত আভিজাত্য, আয়েস বিলাস সব গুড়িয়ে দিয়ে এক আশ্চর্য জীবন যাপন করে এই মানুষগুলি। যেন জগতে একা আসার এবং একা যাওয়ার যে জীবন সেখানে লোকজনের সাথে অনর্থক জড়িয়ে থাকার কোন মানেই হয়না।
চলবে----
|