রমতা যোগীর পদাবলী (২) ডালিয়া নিলুফার আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সাধুদের অনেক কিছুই জানা যায়। শুধু কীজন্য তাদের সাধু হতে ইচ্ছা করে, এই কথাটাই পরিষ্কার করে জানা যায়না। সমাজ সংসারের সাথে তাদের এই ছাড়াছাড়িটা কেন হয়, সেই জীবন থেকে তারা ফিরেই বা আসেনা কেন,তাই এক বিরাট জিজ্ঞাসা হয়ে থেকে যায়। কোন কোন সময় মনে হয় যেন সংসার জীবনের খাপ খুলে তারা একবারই বেরিয়ে আসে। এরপর সংসার আর তাদের টানেনা। একটা কিছুর সন্ধানে তারা এই জীবনের সাথে নাছোড়বান্দার মত মিশে থাকে। ঘরের বাইরের সেই ঘর যে কেন তাদের এত আপন হয় কেজানে! ত্যাগ, ধৈর্য, নিষ্ঠা এমন করে কে যে তাদের শেখায়, তাও বোঝা যায়না। আধ্যাত্মিক জীবনের শক্তি কতখানি হয় জানিনা। তবে তার যে সম্মোহন শক্তি আছে তা নিয়ে কোন সন্দেহই হয়না।
মাঝে মাঝে ভাবি যে জীবনে অভাবকে অভাব বলে মনে হয়না, আয় উন্নতিও অবান্তর ঠেকে, সেই জীবনও কি জীবন? জীবনে দৌড়ঝাঁপ থাকবেনা, তাও কি হয়? জীবন কি অত ধীর স্থির হতে পারে? অমন শীতলতা ভালো লাগে কারো? পোষায়? মারামারি- গলাগলি, হৈ হল্লা , ভুলভ্রান্তি, আয়েস বিলাস, ভোগ-দূর্ভোগ মোটকথা সাংসারিক জীবনের রেওয়াজইতো এই। এ না হলে চলে? অন্তত মানুষের ?
সাধুদের চালচলন আর ক্ষমতা নিয়ে এ যাবত বহু গল্পই তৈরি হয়েছে। তার কিছু সত্যি। কিছু বানানো। বংশালের সেই সাধুরও একটা-গল্প আছে। শোনা গল্প। তবু বলি।
পুরনো বিশাল সেই বাড়ীর নীচতলায় ছিল বোর্ডিং ঘর। তাতে বেশীর ভাগই ছিল ছাত্র। বাকীরা চাকুরীজীবী। একবার সেই বোর্ডিংয়ের এক ছাত্রকে অবাক করে দিয়ে সাধু তার ঘরে ঢুকে গেলেন। ছাত্রের পরদিন পরীক্ষা। সাধুর সাথে কথা বলার সময় নেই। তিনিও কোন কথা বললেননা। শুধু চুপচাপ যেয়ে তার হাত থেকে বইটা নিলেন আর নির্দিষ্ট একটা পাতার উপর বারবার হাত রাখলেন। মনে হলো যেন কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন তিনি । পরদিন ছাত্রটি দেখল, আগের রাতে সাধু যে পাতাটির উপর বারবার তার হাত রাখছিলেন,ঠিক তাই-ই এসেছে পরীক্ষায় । অবশ্য তিনি যে ওরকম অন্য ছাত্রদের বেলাতেও করেছেন, তা হয়ত না। শুনিনি সেরকম কিছু। বোধহয় ঐ একবারই। আগেই বলেছি, চোখে দেখিনি, শুনেছি সাধুদের অলৌকিক কিছু ক্ষমতা থাকে। মানুষ তাদের ক্ষমতাবান বলে মনেও করে। তার ছিল কিনা জানিনা। হয়ত ছিল। হয়ত ছিলনা। আমার শুধু মনে হয়েছে এই সাধু হয়ত কোন এক সময় শিক্ষক ছিলেন।
তারাপীঠ মন্দিরের বামা ক্ষ্যাপার কাহিনী শুনেছিলাম। মন্দিরের দেখাশোনা করত এই বামা। সরল, গ্রাম্য যুবক। প্রাণান্ত পরিশ্রম করত। করতে পারত। শুধু খিদে ছিল তার সহ্যের বাইরে। শোনা যায় মন্দিরে একবার তারা-দেবী’র ভোগ তার সামনে দেবার আগেই বামা সেই ভোগ তড়িঘড়ি খেয়ে ফেলেছিল। ওই বেসামাল খিদেই হলো তার কাল। মন্দিরের পুরোহিত এই নির্লজ্জ অনাচার কোন মতে সহ্য করলেননা। সকলের সামনে বামাকে মেরে বেহুশ করে ফেললেন। নিষ্ঠুর সেই মারের চোটে বামার পিঠ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। মন্দির থেকেও তাড়িয়ে দেয়া হলো। সেই রাতে তারা-দেবী নাটোরের রানীকে (যিনি মন্দিরের মালিক ছিলেন) স্বপ্নে সাক্ষাত দিলেন। ভক্ত বামার গায়ের সমস্ত ক্ষতগুলি তিনি নিজ শরীরে নিয়েছেন। রানীকে দেখালেন এই সেই ক্ষত- বিক্ষত, রক্তাক্ত পিঠ। অসন্তুষ্ট তারা-দেবী বললেন- “ তোমরা আমার প্রিয় পুত্রকে তাড়িয়ে দিয়েছ। তাই আমিও এই তারাপীঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি আর ভোগ গ্রহণ করবোনা।” পরদিন সকালে যথারীতি আবারও দেবীর ভোগের আয়োজন চলছে। কিন্তু কোনভাবেই আর আগুন ধরানো যাচ্ছেনা। রানীকে ঘটনার কথা জানানো হলো। রানী ব্যাপার বুঝলেন। সকলকে ডেকে বললেন -“বামা যা খুশী করুক, কেউ বাধা দিওনা।” লেখাপড়া না জানা এই সাধারণ গ্রাম্য যুবক দেবীর মন ছুঁয়েছিল নেহাতই সরল ভক্তিতে।
তবে সাধু হবার পিছনেও থাকে বিস্তর ইতিহাস। শুধু যে সিদ্ধিলাভের আশায় মানুষ সাধু হতে চায়, তা না। খুনি, চোর- বদমায়েশ লোকেরও সাধু হবার ইচ্ছে হয়েছে। সেটা নেহাতই উপায় না পেয়ে। তাড়া খাওয়া জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে। মানুষ যেমন গুরু খুঁজতে যায়, তেমনি যায় আশ্রয় পেতেও। আগের জীবনে অপরাধী ধরনের মানুষও সব ছেড়েছুড়ে আশ্রয় নিয়েছে সাধুর আশ্রমে। দীক্ষা নিয়েছে । একবার সাধু হয়ে গেলে দুনিয়ায় তাদের আর কেউ খোঁজও করেনা।
সাধুর ভণ্ডামি সেও দেখার মত। কি বলব, তাদের কিছু কিছু অবিশ্বাস্য নারকীয় কিত্তীকর্ম চোখে না দেখলে বিশ্বাসও হয়না। তারাপীঠের সাধুদের মধ্যে থেকে আসল সাধু বের করা যে কি রকম কঠিন! সাধারণ মানুষের মত তাদেরও আছে নিখুঁত হিপোক্র্যাসি । জোচ্চুরি তারও কম বোঝেনা। কোন কোন মানুষ যেমন ভৈরবী ছুরির মত, যার দু’ধারে মাথা আর দু’ধারেই কাটে, ঐরকম । সেই কারনেই কিনা কেজানে,সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে তাদের নিয়ে ভয় ভক্তি যেমন আছে; তেমনি আছে কিছু অকথ্য কথার প্রচলনও। বলে তারা। কিছু রঙ্গ রসিকতা করে। হাসি টিটকিরিও কম করেনা। সাধুদের চরস, পাত্তি, হাতল, চিলম এইসব জড়িয়ে কত গল্পও যে লোকে বোনে!
|