উল্টোবাজি (পর্ব ১) ডালিয়া নিলুফার
এক
মাঝেমাঝে খুব বড়লোক হতে ইচ্ছা করে। হয়ে দেখব এর মজাটা কোথায়। বড়লোকদের কি কি করতে ইচ্ছা করে। কেমন খায়, কেমন ঘুমায়। কাকে শত্রু গণ্য করে আর মিত্রইবা ভাবে কাকে? গরীব আত্মীয় আমলে নেয় কিনা। আপন পর মানে কেমন। সঞ্চিত সম্পদ, চাকর বাকর, দারোয়ান, ড্রাইভার, বাবুর্চি সব মিলিয়ে কেমন পেরে ওঠে, তাও। মোটকথা এ জীবনে তাদের লড়াইটা কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বড়লোক মানুষের কি প্রাণের দোসর বলে কিছু থাকে? কেমন তাদের সহবত? অগাধ সচ্ছলতার সেই জীবন কি নির্ভুল অঙ্কের মত? হাসিঠাট্টার জীবন? দুঃখ কি, বেদনা কেমনতর, বোঝে কি আর দশটা মানুষের মতই ? জীবনে কেবল উত্থান আসা এইসব মানুষের সংস্পর্শে আমি খুব একটা আসিনি। হয়ত সেই কারণে।
তাদের সম্পর্কে ধারনা যা হবার তা তো বেশীর ভাগই নাটক সিনেমা দেখে হয়েছে। এ সংসারে তাদের নিয়ে রটনা অনেক। এমনকি বড়লোকের মেয়েগুলোও পাঁচজনের কাছে হক, নাহক কথা শোনে। ‘বড়লোকের বেটি’ বলে মুখচলতি গালি নাহলে খোঁচা’, একটাতো আছেই।
অথচ মানুষের জীবন মজবুত কবে? বুঝদার মানুষের কথাও তাই। ‘আজ মরলে, কাল দু’দিন’ “দুই দিনের দুনিয়া’ এসব কথা তারাও বলে। এরকম করেই বোঝে এবং বোঝায়। তারপরেও তো দেখি একখণ্ড মাটি আর সামান্য ক’টা টাকার জন্যে তুলকালাম বাঁধায়। একখানা চেয়ারের জন্যে না করে কি! অনুতাপ হয় কি না হয়, ‘বালাই ষাট’ বলে আবার শুরু করে। ভাবের দুনিয়া! ‘শেষ পাপ’ বলে সত্যি কি কিছু আছে?
দেখেছি টাকা হলেই যার সব হয় এমন মানুষের আসলে আর কিছু হওয়ারও থাকেনা। জগতের কোন কিছু নিয়েই বিস্ময়বোধ জন্মেনা তার মধ্যে। ফোলানো ফাঁপানো টাকা তার ভিতর এমন করে এঁটে বসে যে উপলব্ধির আর কোন জায়গাই সেখানে থাকেনা। এবং আরও যেটা ভয়ের কথা, এতে তাদের কিছু এসেও যায়না। কি বলব সংসারী মানুষের কাছে টাকার নেশা, জন্মের নেশা।
দুই
কাজে বেরিয়েছি। বাইরে এমন রোদ! ধান তো ধান, তাজা মানুষও বেশীক্ষণ রাখলে শুকিয়ে খড় হয়ে যাবে। যেমন তেজ, তেমনি ঝাঁঝ। রাস্তা ভরে ব্যস্ত মানুষজন। হাঁটছে। দৌড়াচ্ছে। যত্রতত্র ফেরী করছে। নির্বিকার থু ফেলছে। ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছে। ওভার লোডেড বাস মেয়াদ ফুরানোর দশ বছর পরেও মেজাজে সার্ভিস দিচ্ছে। দেদারসে লোক ওঠাচ্ছে, নামাচ্ছে।
বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছি। চোখে পড়ল পাশে কবরস্থান। দেখি কবরের উপরে ফ্যান ঘুরছে। গাছের ডালের সংগে বেশ কায়দা করে বাধা সেই ফ্যান। কোন মানুষ চোখে পড়লনা। বাতাস যে কার গায়ে লাগছে বুঝতে পারলামনা। বায়ু সর্বত্রই বহমান। ছোটবেলা থেকে জানি। কিন্তু তাই বলে ফ্যানের এই বাতাস মাটি ফুটো করে দেহান্তরী প্রাপকের গায়ে লাগবে কিনা এবং বাতাসের সেই সাধ্যও আছে কিনা কেজানে। মানুষের হাড় যা মাটির সাথে মিশে যেতে লাগে মাত্র কয়েক দিন। আয়োজনকারী সেই খবর রাখেননি বোধহয়। রক্ত মাংস মাটিতে নিঃশেষিত হবার পর যা থাকে তাই অস্থি। তথা হাড়। ছোটবেলায় শুনেছি হাড় জুড়ানোর কথা। এও কি তাই নাকি?। শীতের দিনে কি এই কবরের উপরে লেপ দিয়ে দেবে? যাহোক, দেখে আর কি বলব। এই হলো আবেগ। এই হলো বিশ্বাস। যার মধ্যে অন্ধত্ব থাকে। প্রশ্রয় থাকে। কাজেই এনিয়ে বেশী কিছু বলা যাবেনা। দুনিয়া জুড়ে এত বাতাস! তার কতটুকু যায় মাটির তলায় জানিনা। মানুষ কেমন করে যে এতকিছু নিয়ে নিশ্চিত হয়, কে বলবে! তারা বোধহয় কখনও আশাহত হতে চায়না।
ডালিয়া নিলুফার, ঢাকা থেকে, dals66@hotmail.com
|