চেখে দেখ সয়ে যাবে, না চাখলে বয়ে যাবে (৪) ডালিয়া নিলুফার
আগের পর্ব
(সুরের রাজ্যে যিনি আমাদের কাছে রাজার মত সেই প্রিয় সালেকীন ভাইয়ের জন্য এই লেখাটি নিবেদন করছি। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় যিনি সঙ্গীতে তার অবদানের জন্যে পুরস্কৃত হয়েছেন। তার এই সম্মান আমাদের সকলের সম্মান। অভিনন্দন জানাই তাকে।)
এক.
মানুষের উন্নতিটা বেশ টের পাই। লোকজন আজকাল আর প্রতিবেশীর সাথে গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করেনা। রাগ দেখানোর জন্য একজন আরেকজনের বাড়ী মুখী করে অযথা ঝাড়–, জুতো ঝুলিয়ে রাখেনা। মুখোমুখি জানলা চিরকালের মত বন্ধ করেও রাখেনা কেউ। রাস্তায় একা পেয়ে চড় থাপ্পড় লাগাবে, তাও না। চিৎকার চ্যাঁচামেচির দিন গেছে। শত্রুতার জবাব দিতে এসব ছিঁচকে কাজের ধার তারা ধারেনা। এ সবই এখন ছোটলোকি ব্যাপার। সেদিক থেকে চিন্তা করলে লোকজন আগের চেয়ে ঢের বেশী সভ্য হয়েছে। শত্রুতা বেড়ে গেলে তারা বড়জোর সেই শত্রু তরতাজা গুম করে ফেলে। ঠেসে বস্তায় ভরে। নয়ত অসহ্য হয়ে লাশ ফেলে রাখে নদীনালায়। আর তা না হলে টুকরো টুকরো করে শহর ভরে ছিটিয়ে দেয়। এইভাবে জন্মের মত ঝনঝাট বিদেয় করে তারা নিশ্চিন্ত হয়। সত্যি কথা কি বলব, এরপর গা ঝাড়া দিয়ে তারা আবার চলতে শুরু করে। এবং আগের চেয়ে ঢের বেশী শক্তি নিয়ে! যেন কিছুই হয়নি। সব আছে ঠিকঠাক। বিনদাস! তার উপরে জান-বুঝদার মানুষ এখন ইন্টারনেটের তীর আর ইউটিউবের গদা দিয়ে জন্মের মত এমন শিক্ষা দেয় যে, উঠে দাঁড়াবার শক্তি বলতে থাকেনা। কি বলব, মহাভারতের ভীম আর অর্জুনও এমন পারত কিনা সন্দেহ। এখন নদী ভরা লাশ। খাল ভরা অস্ত্র। খালী আছে যুদ্ধবাজী। আছে বন্দুকবাজের দল। কার যে কোন মতলব বোঝা যায়না। অথচ এই মানুষের থাকে ‘মা’ বলে এক পরম সম্পদ। তার আশ্রয়। তার প্রশ্রয়। তার সব পাওয়ার এক দুনিয়া। যার স্নেহময় হাতে খেয়ে, যার আশ্চর্য নরম-মায়াভরা কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে, রূপকথা শুনে তারা বড় হয়। আর বড় হয়ে তারাই শেখে কিনা যুদ্ধবাজী! কে শেখায়, কেজানে!
দুই.
দেখি দুনিয়ার বুক ক্ষতবিক্ষত করে এবার আকাশ ধরেছে মানুষ। ছুঁড়ে দিচ্ছে একটার পর একটা ধারালো অস্ত্রপাতি। লক্ষ্যভেদ করে যাচ্ছে তাই। কোথাও না কোথাও বিদ্ধ হচ্ছে সেই মরনাস্ত্র। তার ক’টাইবা দেখা যায়! এইভাবে ধারালো অস্ত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে এক রাজা অন্য রাজারে কেবল ভয় দেখায়। ওদিকে তারচেয়ে ভয়ে কোণঠাসা হয়ে যায় দেশভরা প্রজা। কারণ তাদের থাকে এক সরল নিপাট সংসার। তাই ছিন্নভিন্ন হওয়ার আশংকা করে দিনরাত! অথচ ঐ এক আকাশের দিকে তাকিয়েওতো ভুলে থাকা যায় কত কষ্ট! নরম মেঘের মাঝখানে গ্রহ নক্ষত্রের কি বিশাল রাজ্যপাট! স্রষ্টার আরশ ঐখানেইতো!
এখন চোখ খুলে আকাশ দেখতে ভয় করে। আহা কি নিদান চারপাশে! হাজার কোটি খরচ করে তবে মানুষ মারা কল তৈরি হয়েছে দুনিয়ায়! কি তার তেজ! কি তার শক্তি ! তাকালেই দেখি আকাশ ফুটো করে ধারালো বল্লমের মত উড়ে যাচ্ছে মিসাইল। ভয়ে ভয়ে চোখ বুজি। কোথায় যেয়ে পড়বে সেই ভয়! কার বুকের ধন কেড়ে নেবে, কার জমি জিরেত চূর্ণ চূর্ণ করে দেবে সেই আতঙ্ক। কোন ষড়যন্ত্র নিয়ে অমন ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটে যাচ্ছে এই মহাঘাতক কেজানে! এই কি অদৃষ্ট মাটির মানুষের? দু এক সময় মনে হয়, মানুষের এই না নরম জান, তা মারতেও লাগে অমন শক্ত কলকব্জা! রাজা গজা তারজন্যেই ঢালে বেশুমার টাকাকড়ি? কোন জেদের ভূতে পেল মানুষকে? এ কেমনতর খুনের নেশা? যোদ্ধা হতে হতে মানুষ কখন এত উদ্ধত খুনি হয়ে গেল? এমন হিংস্র হয়ে গেল?
দেখি রাজার লাই পেয়ে তার পোষা অনুচর পিঠে বয় বারুদের ঝুলি। বারো মাস। পরম আনুগত্যে নাক ঘষে মাটি ছোঁয়। আর হুকুম জারি হওয়া মাত্রই ভয়ে সিটিয়ে থাকা সভ্যতার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে নুইয়ে দিয়ে করে দুনিয়ার এস্পার ওস্পার। প্রগতি, না কি যেন, তার গালে বসায় কষে দুই থাপ্পড়! আর উন্নতির বাপের নাম ভুলিয়ে দেয় জন্মের মত। না রাখে আড়াল, না রাখে ভব্যতা। মানবতা বোধের মগজে সোজা তাক করে চালায় ঝাঁক ঝাঁক গুলি। আর গলা উঁচিয়ে ধমকে, গর্জে বলে ““রে দুনিয়া, দেখ! আমরাই না উচ্চতর! আপাদমস্তক শ্রেষ্ঠ!”“ কি বলব! তবুতো দেখি রাজা রাজাই। খুনে রাজা কে কয় তারে? কেউ কি বলে ““চাইনা তোমায়”“? দোষী রাজার দোষ ধরতে যাবে কে, এক রাজদ্রোহী ছাড়া?
সমাপ্ত
আগের পর্ব
ডালিয়া নিলুফার, ঢাকা থেকে
|