চেখে দেখ সয়ে যাবে, না চাখ্লে বয়ে যাবে (২) ডালিয়া নিলুফার
আগের পর্ব পরের পর্ব
‘তুই’- কি যে অদ্ভুত শব্দ একটা! গলাগলি ধরার সময় যেমন ‘তুই’- বলে, গলা ধাক্কা দেবার সময়ও তেমনি ‘তুই’ ই বলে। একই সাথে অভদ্রতা এবং ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে এর চেয়ে উপযুক্ত শব্দ আর বোধহয় একটিও নেই। তিতে হোক, মিঠে হোক, সবটাতেই লাগসই। আর বলার সময় মানুষ বলেও এমন আবেগ দিয়ে! এমনিতে ‘তুই’ শুনতে খারাপ লাগেনা। শুধু গলা চড়ে গেলে তখন একটা যা তা অবস্থা হয়, এই যা।
আগে হোতনা কিংবা হোতও কিনা কেজানে, প্রেম ভালোবাসা করার সময় মানুষ ‘আপনি’ থেকে খুব নরম হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ‘তুমি’তে এসে দাঁড়াত। এরপর সেখান থেকে তারা আর নড়তনা। অন্ততঃ ক্ষ্যাপা মেজাজ নাহলে না। এখন বন্ধুবান্ধবতো বটেই প্রেমিক প্রেমিকারাও আজকাল এত বেশী তুইতোকারী করেন যে, বোঝাই যায়না কে প্রেমিক, আর কে বন্ধু। মনে হয় সম্পর্কটা গাঢ় কিনা সেটা বোঝাতেই তারা এমন করে।
এখন গান বাজনার মধ্যেও দেখি তুইতোকারীর খুব চল। সিনেমার গানে তো বটেই, অন্যান্য আধুনিক গানেও। কারণটা ঠিক বুঝতে পারিনা। তবে মন মানসিকতার পরিবর্তন যে একটা হয়েছে, সেটা বুঝি। আগেও হোত। শিশু, মা, মাটি কিংবা দেশ, এইসব নিয়ে কিছু একটা লেখা হলে তখন ‘তুই’ শব্দটা থাকত। যেটা খুব স্বাভাবিক। অতি আপন ভাবলে তখন তুই বলে। আর শত্রু ভাবলে তো কথাই নাই।
ছোটবেলায় বন্ধুদের তুই বলতাম। তুই না বললে বন্ধুত্ব যেন জমতই না। এখনও বলি। এদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ তুমি করে ডাকলে পরিষ্কার বুঝি বন্ধুত্ব ফিকে হয়ে গেছে। আর গলাগলি নেই। সময়ের ফের হলে যা হয়।
সেদিন শুনি, আমার অফিসের এক সহকর্মী কাকে যেন ফোনে বাজারের ফরমায়েশ দিচ্ছেন- " শোন, চিচিংগা ভালো দেখে নিবি। আর বেগুনে পোকা আছে কিনা একটু দেখে নিস।" প্রথমে বুঝতে পারিনি। ভাবলাম কাজের লোক। একটু পরে মনে হোল, ছোট ভাইও হতে পারে। কিছুক্ষণ পর আমাকে অলমোস্ট তাক লাগিয়ে দিয়ে বললেন ‘আমার হাজব্যান্ড’। হাসলাম। বললাম "ও আচ্ছা"। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কি মনে হয়েছিল জানিনা। সাথে সাথেই বললেন-" বিয়ের আগে আমরা সহপাঠী ছিলাম। তখন তুইতোকারী হতো। পরে আর পাল্টাইনি। "বুঝলাম আগাগোড়া তারা সমানই রয়ে গেছেন। আমার মনে হয় ঝগড়াঝাটি ছাড়া স্বামী স্ত্রীরা ‘তুই’- শব্দটা খুব সহজে বলেনা।
তবে গরীব মানুষের কথা আলাদা। তারা তুমি বোঝেনা। বোঝে ‘আপনি’। নয়তো সোজাসুজি ‘তুই’। মনে হয় তুমির মধ্যে তারা একটা ‘পর পর’ গন্ধ পায়। এবং মেয়েদের তারা সচরাচর তুই-ই বলে। মা, বোন, এমনকি প্রেমিকা হলেও। তাদের অভ্যাসই এই। দু’ এক সময় তাদের কথাবার্তা কানে আসে। খুবই সাধারণ কথা। চটপটির প্লেট হাতে নিয়ে গুম ধরে বসে থাকা প্রেমিকাকে নির্দ্বিধায় প্রেমিক ধমক দিয়ে বলে ওঠে -"কি অইল, খাস্না ক্যান?" এই হলো অভ্যাস। গরীব মানুষের এমনিতেই ফর্মালিটি কম। কাজেই রাগ, ভালোবাসা দেখানোর জন্য তারা অনর্থক আলাদা আলাদা সম্বোধন করবে, প্রশ্নই আসেনা। তাদের আবেগে যা, অভ্যাসেও তাই।
আগের পর্ব পরের পর্ব
ডালিয়া নিলুফার, ঢাকা থেকে
|