চেখে দেখ সয়ে যাবে, না চাখ্লে বয়ে যাবে (১) ডালিয়া নিলুফার
(এই লেখাটি আমার প্রিয় কবি দম্পতি জেনিস মাহমুন এবং নাসরীন মাহমুনের জন্যে। কোন কারণ ছাড়াই যারা মানুষকে নিঃস্বার্থে ভালোবাসতে পারেন এবং আপন ভাবতে পারেন। এ তাদের অসাধারণ এক গুন।)
পরের পর্ব
ঢাকা শহরের পাবলিক বাস মানে হলো চলমান ভবের সংসার। কি না হয় এখানে! ধাক্কাধাক্কি থেকে শুরু করে টং-মেজাজের গালাগালি। চুটিয়ে পকেট মারা। সব। ড্রাইভারের জলদিবাজী তোয়াক্কা না করেই উঠে পড়ে হকার, উঠে পড়ে দীনদুঃখী মানুষও। তখন বিক্রি-বাট্টা, দান খয়রাত সব একসাথে চলে। হৈ হট্টগোল আর চূড়ান্ত ধুলোবালির মধ্যে বসে এইভাবে আমার দিনের অন্ততঃ দুই ঘণ্টা কাটে । এরমধ্যেই একদিন শুনি- “অহনে সরকারের আইন কররা!” বলে বা হাতের তালুর উপর ডান হাতের আঙ্গুল জোরে ঠুকে দিয়ে হাল আমলের কড়া আইনের কথা পরিষ্কার ঘোষণা করছেন জনৈকা বৃদ্ধা। বয়স কেটেকুটে পঁয়ষট্টি। বাসে, আমি তার পাশে বসা। হা করে শুনছি। শোনার মত কথা। আজকাল শোনার মত কথা কমই শোনা যায়। বলার মত কথাই বা ক’জন বলে? তবে কথাটা যেমনই হোক, তারমধ্যে একটা সত্যতা ছিল। সেটা হলো কড়া আইনের উপর মানুষের ভরসা বরাবরই বেশী।
যাহোক খুব বেশীদিন হয়নি, পত্রিকায় বেরিয়েছিল কোন এক ‘অসীম বাবুর কাহিনী’। ঘটনাক্রমে যিনি মামলার আসামী হয়েছেন এবং যার একটি পা নেই। এদেশের লক্ষ মানুষ তার সাক্ষীও ছিল। আসামীর সত্যি সত্যি এক পা কাটা। অতএব সেই এক পায়ে তার পক্ষে দৌড়ে পালানোতো দুর, এক কদম হাটারই সাধ্য নাই এই মানুষের। কিন্তু সরকারী পেয়াদার বুঝ অন্যরকম। তার সোজাকথা- ‘পা না থাকলে নাই, হাত আছে, হাতকড়া পর। আমি কি পা-কড়া এনেছি, যে গাইগুই করছ? তা’বলে আইন ভঙ্গ করা চলবেনা বাপু। এর নাম রাজ আজ্ঞা। অতএব ভালো চাও তো পালন কর।’ ধনুকের ছিলার মত কথা। অতএব অমান্য করে কার সাধ্য?
মানুষের দুঃখকষ্ট কোনদিন ভালো করে বুঝিনি। কিন্তু যার একটা পা নেই, সেই মানুষের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে হাটতে বললে তার দুর্ভাগ্য যে কোন চরমে ওঠে তা বুঝতে কষ্ট হয়না কাররই। যাহোক, সেই অসীম বাবু থানায় শেষ পর্যন্ত কি করে পৌঁছেছিলেন, জানা যায়নি।
তারও আগে খবর পেয়েছিলাম, সাজা পেয়ে জনৈক সন্ত্রাসী নাকি চৌদ্দ বছরের কারাবন্দী হয়েছেন। অথচ বাড়ীতে তার চার বছরের সন্তান। অন্যের নয়। নিজেরই। খায়দায়, দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। অতএব বোঝাই যায় কারাবন্দী ভদ্রলোকগনের ছেলেপুলে হওয়াও আজকাল আর কোন ব্যাপার নয়। পরিষ্কার বুঝি, শাস্তি-দণ্ড যা কিছু ঘটেছে, তা কাগজে কলমে মাত্র। নয়ত এই অসাধ্য সাধন কার পক্ষেই বা সম্ভব? দিন যতই আধুনিক হোক আর কাণ্ডকারখানা যতই ডিজিটাল হোক, তা’বলে জেলখানার কপাট খোলা না থাকলে, অনলাইনে কি আর ছেলেপুলে হওয়া সম্ভব?
আইন আর কমনসেন্স দুটো দুই জিনিষ কিনা কেজানে। আইনের সাথে এর ওঠাবসাই বা কতখানি, তাও ঠিক করে বলা মুশকিল। তবে সময়মত খাটাতে পারলে দেখেছি দুটোই কাজে লাগে। কমনসেন্স ঠিক থাকলে কথায় কথায় আইনের দরজায় যেয়ে দাড়াতেও হয়না। তখন কমনসেন্সই যথেষ্ট হয়। আর সাধারণ মানুষজনও বোধহয় এটাই চায়।
আইন কড়া হলে সাধারণ জনগণের কোন অসুবিধা হবার কথা না। হয়ও না। দণ্ড, শাসন, বিচার এই শব্দগুলির উপর তাদের আস্থা এবং ভক্তি এখনও চরম। তবে সেইসাথে ‘দণ্ডদাতা’, ‘শাসনকর্তা’ এবং ‘বিচারক’ এই শব্দগুলির উপরেও তাদের ভয় এবং ভক্তি যাতে আগের মতই থাকে, নষ্ট না হয়ে যায়, সেই চিন্তাও করা দরকার। তাহলে আস্থাবান সেই বৃদ্ধার মত দেশের সমস্ত আমজনতাও চিল্লিয়ে বলবে “অহনে সরকারের আইন আসলেই কররা!”
পরের পর্ব
ডালিয়া নিলুফার, ঢাকা থেকে
|