bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



আমি ও আমার সহযোদ্ধারা
চোর
ডালিয়া নিলুফার



সকাল হবার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক আধদিন এরকম হয়। এমনি এমনি ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে জানালার পর্দা সরালাম। বাইরে অন্ধকার কেটে কেবল ফর্সা হচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, পাশের বাড়ীর দেয়ালের উপর দিয়ে কে যেন হেটে যাচ্ছে। এত ভোরে একটা লোক দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটছে কেন, তা চট করে বোঝার কথা না। বুঝিওনি। হঠাৎ শুনি, কে যেন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল ‘চোর চোর’ বলে। কি সর্বনাশ! এ কি চোর নাকি! চোরের পরনে জিন্সের প্যান্ট। ছাপার শার্ট। হাতে কব্জি অবধি ঝোলানো ঘড়ি। এমন ভদ্র পোশাক পরা চোর আমি আগে দেখিনি। এই প্রথম। আর এমন ভদ্র যে, তাকে চোর বলার সাহসই হয়না।

দেখলাম তাকে শায়েস্তা করার জন্য তক্ষুনি সেই বাড়ীর বুড়ো দারোয়ান দৌড়ে এসে একটা আধলা ইট নিয়ে তার পা বরাবর ছুড়ে মারছে। আর হাঁপ ধরা গলায় (ভয়ে কিনা কে জানে) কোন মতে বলছে - “ এ্যাই- অ্যাই শালা, নাম!! ইট গেলনা। দেয়ালের মাথা পর্যন্ত যেয়েই পড়ে গেল। তবু সে বার কয়েক ইট ছুড়েই শত্রু ঘায়েল করতে চাইল। যাহোক তাতে কাজ কিছুই হোলনা। চোর চলে গেল বীরের মত হেটে। ঠাণ্ডা মাথায় এবং তার চেয়ে ঢেড় বেশী সাহস দেখিয়ে।

মনে আছে, ছোটবেলায় পড়েছিলাম ‘একটি চোরের আত্মকাহিনী।’ তার সাথে এই চোরের দেখলাম কোন মিলই নেই। তখন চোর বলতে বুঝতাম, ছেঁড়া লুঙ্গী পরা মাঝবয়সী একটা গরীব মানুষ। কালো। ধুলোবালি মাখা ময়লা, হ্যাংলা শরীর। সর্বাঙ্গে গরীব। যার সারা মুখে ভদ্রতার ছাপ বলতেই থাকবেনা। এবং এই জীবনে খাবারের চেয়ে যে মারই খাবে বেশী। সোজা কথা, কপাল পোড়া একটা মানুষ। আমার কাছে চোরের আসল চেহারা হলো, এই। চোখে না দেখলেও মনে মনে তাদের এইরকম চিন্তাই করেছি এতকাল। আরও যেটা আশ্চর্যের কথা, চোর বলার সাথে সাথেই কেন জানি একটা পুরুষ মানুষের মুখ আগে মনে আসে। যেন চোর তো পুরুষই হয়। মেয়ে চোর বললেও কি সহজে বিশ্বাস হয়? শুনতেও তো বেমানান লাগে। চোরের স্ত্রী লিঙ্গ হয় কিনা তাও জানিনা।

দেখেছি, একবার চোর বলে সাব্যস্ত হলে সেই মানুষ আর মুখ পায়না জগতের কোথাও। কি আপন, কি পর, সব তার একাট্টা। অবশ্য চোর কি আর আপন পর বলে জগতে মানে কিছু? বলা যায়না। যার সর্বস্ব খোয়া যাবার ভয় নেই, জান মালের পরোয়া নেই, পরের জিনিষ যে নিজের বলে ভাবার সাহস দেখায়, তাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করাও কঠিন।

যাহোক চোর তো চোর, কিন্তু “চোরের মার” যে কি জিনিস! একবার দেখেছিলাম। তাও বোধহয় বছর পাঁচেক আগে। সে ছিল মেয়ে চোর। বয়স চল্লিশ না হলেও, তার কাছাকাছি। দেখলাম তাকে মারার জন্যে পাঁচ ছয় জন জওয়ান মিলে ঝটপট তৈরি হয়ে গেল। দু’একজন নেচে নেচে বাতাসের গায়ে ঘুষি বসিয়ে দিল কয়েকটা! এটা বোধহয় শরীরের ওয়ার্ম আপ জাতীয় কিছু হবে। এদিকে, উঠোনে ঠায় দাড়িয়ে থাকা চোর। সুবিধে বুঝে, হুট করে লেঙ্গি মেরে দিল একজন। তাই দেখে শুরু হলো হাসির হুল্লোড়! যাহোক, হাসি থামার সাথে সাথেই কি উৎসাহ নিয়ে যে কাজটা শুরু করল তারা! খোঁচা ধাক্কার পর শুরু হলো হাত খুলে মার! এ মারে। ও মারে। মার আর থামেনা!

এরমধ্যে কে যেন ঠিক সিনেমার নায়কের মত দৌড়ে এসে পিছন থেকে উড়ো লাথি মারল একটা। অমনি সঙ্গে সঙ্গে মেয়েছেলেটা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। কিসের কি! তার প্রায় সাথে সাথেই পাথরের মত ভারী ভারী কয়েকটা ঘুষি পড়ল তার চোখ মুখ বরাবর। বাতাসের আগে এসে চড় পড়ল কয়েকটা। তার মুখ লুকানোর সাধ্য থাকলনা একতিলও। দেখলাম, এত মারের মধ্যে- মুখ না, সে কেবল তার পেটের উপর হাত রেখে পেট বাঁচাতে চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা কিরকম যেন লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারের চোটে তার গায়ের কাপড় এদিক ওদিক হয়ে গেল। এইবার দেখলাম কম করে হলেও মেয়েছেলেটি পাঁচ-ছয় মাসের গর্ভবতী। কত আর ঠেকায়? ইজ্জতই বাঁচেনা, তার পেট!

এরইমধ্যে চোখের পলকে একজন কাঁচি নিয়ে এসে দেখলাম তার চুলগুলো নির্বিবাদে কচকচ করে কেটে ফেলে দিল। ব্যস। বোধহয় এটাই বাকী ছিল। ওদিকে এই নির্দয় মহাসমুদ্রে পড়ে মেয়েছেলেটি বাঁচার জন্যে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কেবল আল্লাহকে ডাকতে থাকল। আর একটু পরপরই তার দোহাই দিতে লাগল। ভারী অবাক হলাম। তার সামনে এত মানুষ! জলজ্যান্ত, সুস্থ-সবল! অথচ সে কোন মানুষকে ডাকলনা। ডাকল এক আল্লাহকে, যাকে সে কোনদিন দেখেইনি। চারপাশে লোকজনের ভিড়। হৈ হুল্লোড়। দৌড়ঝাঁপ। কে কার আগে যেয়ে এই নারকীয় নিষ্ঠুরতা দেখবে তার পাল্লাপাল্লি। মনে হলো তারা আসলে উদ্ধার করতে না ঠিক, এসেছিল তামাশা দেখতে। কি বলব, মানুষ মারার গরজে ডাকার আগে তারা দৌড়ে আসে। প্রথমে মনে হয়েছিল, দু’একটা চড় থাপ্পড়ে বোধহয় শেষ হবে। তা না। অবস্থা দেখে আরও যা মনে হলো, যেন এই উপাদেয় দৃশ্য একেবারে চোখের সামনে থেকে না দেখলে, এর মজাই পাওয়া যাবেনা। তাদের সামনে এ হোল একেবারে নাগালের মধ্যে পাওয়া সাক্ষাত পাপী। অতএব- এর শাস্তি কঠিনতর হওয়া চাইই চাই। আর এই কাজের জন্যে তারাই যথেষ্ট। ব্যস- এই সাব্যস্ত হয় শেষ পর্যন্ত।

কি বলব, চোর পেটানোর দায়িত্ব যারা পেয়ে যান, তাদের যে কি উল্লাস হয় তখন! কোত্থেকে যে তাদের গায়ে অমন অসুরের মত শক্তি আসে! কেমন করে যে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে অমন ভূতের জেদ! তার সাথেই লড়ে দুনিয়ার যত কুস্তি। মারের বেলায় যেন চোরের নারী পুরুষ নেই। আর এই চোর সন্দেহের চোর কিনা তাও জানার দরকার মনে করেনা উল্লসিতরা। পরিষ্কার মনে পড়ে সেই নির্দয় প্রহার! বুকের কাছে দুই হাত জড়ো করে, মুখ নিচু করে থাকা মধ্যবয়সী সেই মেয়ে চোর। মাথায় এলোপাথাড়ি কাটা চুল। ধুলোবালিতে মাখা ময়লা কাপড় তার ভয়ে কাঁপতে থাকা শরীর কোনমতে সামলায়। এরমধ্যে পাকা লাঠির ব্যবস্থা হয়ে গেল। কোত্থেকে কেজানে! চোর পেটানোর উপযুক্ত অস্ত্র পেয়ে উল্লসিতদের উৎসাহ বেড়ে গেল। যেন দুনিয়ার এস্পার ওস্পার না করেই ছাড়বেনা। কে কার আগে বাড়ি দেবে, তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি। শোরগোলে মাথায় খিল ধরে গেল। দেখলাম ফুঁসতে ফুঁসতে তারা ছুটে যাচ্ছে মাটিতে নেতিয়ে থাকা চোরের দিকে। এর বেশী দেখা সম্ভব ছিলনা। নির্ঘাত মরণ দেখে, দৌড়ে নীচে নেমে আসলাম। যা হবার হবে। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে কোনমতে একজনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কে শোনে কার কথা!! ততক্ষণে তার শক্ত মুঠি তৈরি হচ্ছে আরেক ঘাই দেবার জন্যে। এই হিংস্রতা দেখে কি করব বুঝতেই পারলাম না। এরমধ্যে কে যেন গলা উঁচিয়ে ধমকে উঠল। না পেরে, দৌড়ে যেয়ে আরেকজনের হাত চেপে ধরে নিরস্ত হতে অনুরোধ করলাম। আমার কথা শুনে ছেলেটি কি বুঝল কেজানে। দেখলাম, তক্ষুনি সরে যেয়ে অন্যদের থামাতে চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হলো। চোর বসে আছে ফাটা ঠোঁট, কাটা চুল নিয়ে। তার রক্তাক্ত ফোলা মুখ দেখে দণ্ডদাতারা সব হাসতে হাসতে চলে গেল। বুক ফুলিয়ে। বীরের মত। যেন কিছুই হয়নি। বিনদাস! হতভম্বের মত দাড়িয়ে থাকলাম। পারিনি, তবু একবার শুধু চোরা চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়াবহ এই কঠিন দুনিয়াকে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখি, অন্যায্য শাসনে - আইন, মানবতা, বিবেক, সুবিচার সব অসম্মানের কালিঝুলি মেখে ধুলোমাটিতে ছেত্রে পড়ে আছে, সেই চোরের সাথে।

(চলবে)



ডালিয়া নিলুফার, ঢাকা থেকে




Share on Facebook               Home Page             Published on: 19-Jan-2019

Coming Events: