আমি ও আমার সহযোদ্ধারাআত্মহত্যা ডালিয়া নিলুফার
কি বলব, মানুষের যা জীবন তাতে এমনিতেই দিনের মধ্যে চোদ্দবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কি হবে না হবে সেই ভাবা-ভাবি পরে। মরে যাবার চিন্তাটা স্রেফ এমনই। তবে কাজটা যত না ক্ষোভের, তার’চে অনেক বেশী অভিমানের। যেন এ জীবনে যা দেখার তাতো দেখেই ফেলেছে তারা। বাকি আছেই বা কি?
পরিণত বয়সে আত্মহত্যা ঘটানোর সাহস দেখিয়েছেন এমন নারী পুরুষও চোখে পড়েছে। যন্ত্রণা-বিদ্ধ মানুষ। বিধ্বস্ত এবং উপায়ন্তর না দেখা মানুষ তারা। এনিয়ে বেশী কিছু বলার নেই। ক্লান্তিকর এই জীবনের অসহ্য ভার যখন সত্যিকার অর্থে আর কারো উপর দেয়া যায়না, তখনই বোধহয় মৃত্যুর কথাটা ভাবে মানুষ। তার শেষ আশ্রয় বলে মনে করে। সেই তার মুক্তি। সেই তার পরিত্রাণ। জগতের সমস্ত কিছুর উপর থেকে মন উঠে গেলে যা হয়। মমতাও বোধহয় কমে যায় মানুষের। আর চলে যাবার এই দুরারোগ্য চিন্তা যার পেয়ে বসে তারে ঠেকাবে কে? তবে অনাদরের কষ্ট থেকে মানুষ মুক্তি কি কেবল পেতেই চায়? দিতেও কি চায়না? আমাদের দূরাত্মীয় একটি ছেলেকে দেখেছিলাম। রোগে ভোগা। সারা বছর অসুস্থ। তার কি অসুখ ছিল, মনে নেই। শুধু জানতাম তার বেশী খাওয়া নিষেধ ছিল। আর সেই মানুষটার ছিল ভারী খাওয়ার শখ। নেশার মত। এমনকি মরে যাওয়ার মত ভয়ও তার খাওয়া আটকাতে পারতোনা। ঘরে। বাইরে। সামনে। লুকিয়ে। চেয়ে চিন্তে। এমনকি দু’এক সময় চুরি করে। যেভাবে পারত, খেত। তার যে কি হয়েছিল! ঘরের মানুষজন তাকে চোখে চোখে রাখত। যতটা পারত। তার চিকিৎসার পিছনে বিস্তর খরচও হচ্ছিল। তারা বড়লোক কিছু নয়। অভাবী মানুষ। অত টানাও সম্ভব ছিলনা। কাজেই পাহারা দিয়ে দিয়ে যতটা পারত ঠেকাত। কিন্তু খিদের কাছে কতক্ষণ? আমাদের বাড়ীতেও সে এসেছিল। তখন তাকে দেখেছি। কি বলব, প্রত্যেকবার সে এমন তৃপ্তি করে খেত! আমি এমন তৃপ্তির সাথে কোনদিন কাউকে খেতে দেখিনি। আহারের ঐ সময়টুকুতে ভাত-মাছ, তরিতরকারির সাথে কি যে একটা স্নেহময় অবস্থা তৈরি করে ফেলত সে! শুধু মুশকিল ছিল খিদের কাছে সে হেরে যেত। কোনমতে সামলাতে পারতোনা সেই মরণ খিদে। শুনেছি, শেষ পর্যন্ত সে ঘরের ঘটিবাটি বিক্রি করা শুরু করেছিল। সেই সর্বনাশা খিদের জন্যে ঘরের মানুষগুলির কাছেও দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠেছিল সেই হতভাগা। তাই খাওয়ার খোটা, বেহিসেবী অপমান এবং বেধড়ক মার, সব জুটেছিল তার কপালে। মাঝেমাঝে মানুষের কথা আর বিষের মধ্যে কোন তফাৎ থাকেনা। হয়ত ভাতের দলার সাথে সাথে সেই কথাগুলি বিষ হয়েই মিশে গেছিল তার। একদিন শুনলাম নিজের খাবার খেয়ে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই ভাইয়ের জন্যে তুলে রাখা খাবারটাও সে না বলেই খেতে বসেছিল। আর ঠিক তখনই ঘটল অঘটনটা। খিদেয় বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল সেই ভাইয়েরও। তাই কনুই-কব্জি মুচড়ে দেয়া থেকে শুরু করে উড়ো লাথি, ঘুষি কোনটাই বাদ গেলনা। সব লুফে নিল তার ক্ষীণজীবী শরীর। ঘরের মধ্যে দুই ক্ষুধার্তের লড়াইয়ে দুনিয়া ওলট পালট হয়ে গেল। শেষমেশ তার গলার মধ্যে উপুড় করে বাকী ভাত তরকারী ঠেসে ধরেছিল সেই ভাই। তার নির্লজ্জ অসুখের শেষ দেখে ছেড়েছিল সে। ছেলেটি হয়ত তক্ষুনি মরে যেত শ্বাস আটকে। কিন্তু কিভাবে যেন আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকল। এবং নিষ্ঠুর সেই মার খেতে খেতে মুহূর্তেই চিনে নিল খাদ্য অখাদ্যের দুনিয়া। মান অপমানের দুনিয়া । আপন পরের দুনিয়া। নিরুত্তর মার খেয়ে পড়ে থাকার সেটাই ছিল কারণ। এও বুঝল, অসহ্য ব্যাধি, নির্লজ্জ খাওয়া তার সব পর করে দিয়েছে। সেই অবিশ্বাস্য মারের চোটে সে ভাত তরকারী সুদ্ধ মেঝেতেই পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। জ্ঞান আছে, কি নেই তা বোঝার মত শক্তিও তার ছিলনা। বেসামাল মারে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল তার। সম্ভবতঃ সেই ছিল তার শেষ বাঁচা। এরপর আর বেশিদূর যায়নি। ঐদিন সন্ধ্যাবেলা ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়েছিল। রোগে ভোগা যন্ত্রণা-বিদ্ধ শরীরের ভার সে আর কোন আপনজনকে দেয়ার সাহসই পায়নি। সামান্য একগাছি দড়ি কেবল এই আশ্রিতকে বহন করেছিল সারারাত। (চলবে)
ডালিয়া নিলুফার, ঢাকা থেকে
|