bangla-sydney












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



‘কুশারী’ পদবী থেকে ‘ঠাকুর পরিবার’ হয়ে ওঠা
চাষী সিরাজুল ইসলাম



পঁচিশে বৈশাখ পালিত হয়ে গেলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী। বরাবরের মতো বিপুল উৎসাহ ও আনন্দঘন পরিবেশে বিশ্বব্যাপী পালিত হলো কবির জন্মবার্ষিকী। তাইতো তিনি কবি বিশ্বকবি। আমাদের প্রাণের কবি।

১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেলে বিশ্বসাহিত্যে বাংলাভাষা পায় গৌরবের মর্যাদা ও সম্মান। স্বকীয় নান্দনিক ভাবনায় তিনি চিত্রকলাকেও করেছেন সমৃদ্ধ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত 'জনগণ-মন-অধিনায়ক জয় হে' তাঁরই রচনা। রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্ভার বিপুল ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। সাহিত্যের সব শাখায় ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত ও শিশুতোষ রচনা, চিঠিপত্র বাংলা সাহিত্যে অমর সংযোজন।
রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’, ‘বিশ্বকবি’ ও ‘কবিগুরু’ অভিধায় অভিহিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য-সংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ‘গীতবিতান’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত এবং গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্র-সাহিত্য ১৯ খণ্ডে ‘চিঠিপত্র’ সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রায় দু’হাজার ছবিও এঁকেছিলেন। তাঁর রচনা আজ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে ও হচ্ছে।

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার এক ধনাঢ্য সংস্কৃতিবান পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। বাল্যে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণে তিনি অসম্মত হয়েছিলেন। তাই গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মাত্র আট বছর বয়সে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন তিনি। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ছিল ‘অভিলাষ’। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। এখানেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নী বিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথই এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি প্রদান করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন। এই সংস্থা গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করে। ১৯২৩ সালে শান্তিনিকেতনেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। দীর্ঘজীবনে বহুবার বিদেশ-ভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রচার করেছিলেন সৌভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার বাণী। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পত্নী সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার শুধু ব্রাহ্ম আদি-ধর্ম মতবাদের প্রবক্তাই ছিল না, বরং সেযুগের কলকাতার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সংস্কৃতিবান পরিবার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে জানার আগ্রহ থেকে বিভিন্ন ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে জানতে পারি রবীন্দ্রনাথরা আদিতে ছিলেন কুশারী পদবিভূক্ত। কুশারী থেকেই তাঁরা এক সময় ঠাকুর পদবিতে উত্তীর্ণ হন। এখন সে কথাই বলবো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথা জনপ্রিয় ঠাকুর পরিবারের ঠাকুর পদবিটি বহুযুগ আগে ছিল কুশারী। ইংরেজ আমলে এই কুশারী পদবীর ক্রমবিবর্তন ঘটে হয়েছে 'ঠাকুর'। ঠাকুর পরিবার কলকাতার একটি খ্যাতনামা পরিবার। এই পরিবারের ইতিহাস প্রায় তিনশো বছরের। বাংলার নবজাগরণে এই পরিবারের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এই পরিবারের সদস্যেরা অনেকেই বাণিজ্য, সমাজ সংস্কার, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংগীতের জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

শুরুতেই বলেছি পূর্বে পরিবারটির পদবি ছিল কুশারী। যারা বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে আগত। পঞ্চানন ও শুকদেব নামে দু’জন কুশারী গোবিন্দপুরে এসে বসতি গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত কলকাতা শহরের একটি গ্রাম। কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সূতানটি এই তিনটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠে আজকের শুরুর কলকাতা। সে যাই হোক কুশারীরা জাহাজ ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েন। ব্রাহ্মণ হবার কারণে প্রতিবেশীরা তাদের ঠাকুরমশাই বলে ডাকতেন। ব্রিটিশরা দেশের ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর “ঠাকুর” তাদের পারিবারিক পদবীতে রূপান্তরিত হয়। ইংরেজদের সুবিধার্থে তা ‘Tagore’ বা ‘ট্যাগোর’ এ রূপান্তরিত হয়। এই ঠাকুর পরিবার কিভাবে কুশারী থেকে ঠাকুর হয়ে ওঠেন এখন সে কথাই বলবো।

ঠাকুরদের আদি পুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুর (১৭৩১-১৭৯১), পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তিনি টাকা ঋণ দিয়ে মুনাফা লাভ করেন এবং উপার্জনের সাথে সমান তালে খরচ করতে থাকেন। দর্পনারায়ণের সাথে তার ভাই নীলমণি ঠাকুরের বিতণ্ডা হলে নীলমণি পরিবার নিয়ে মেছুয়াবাজারে চলে যান, যা পরবর্তীতে জোড়াসাঁকো নামে পরিচিতি পায়। এর ধারাবাহিকতায় পরিবারের আরো কিছু শাখা পাথুরিয়াঘাট, কাইলাহাটা ও চোরবাগানে চলে আসে। এই এলাকাগুলো ছিল নবগঠিত কলকাতা মহানগরীর অঞ্চল, বিশেষ করে যখন ব্রিটিশরা গোবিন্দ পুরকে নতুন ফোর্ট উইলিয়াম হিসেবে গড়ে তোলে।

একসময় এখনকার বিহার রাজ্যের নাম ছিল কান্যকুব্জ। এই কান্যকুব্জ দু'টি ভাগ ছিল। মূল কনৌজ এবং কোলাঞ্চ। কোলাঞ্চের অধিষ্ঠান ছিল এখনকার উত্তর প্রদেশে। কনৌজের রাজা আদিশূরের সময়ে কোলাঞ্চের রাজা ছিলেন চন্দ্রদেবের ভাই বীরসিংহ। এই কোলাঞ্চ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক এসেছিলেন বঙ্গদেশে। সরযুনদী পার হয়ে তারা বাংলায় এসেছিলেন বলে এই ব্রাহ্মণদের বলা হতো সরযুপারী ব্রাহ্মণ। রাজা আদিশূর পঞ্চ-ব্রাহ্মণের বসবাসের জন্য তদানীন্তন বাংলায় জমিদারি দিলেন। এই পাঁচ-ব্রাহ্মণ বারেন্দ্র এবং রাঢ়ি গোত্র হিসেবে অভিহিত হতো।

তারপর অমোঘ নিয়মে ঝগড়া হলো সবার মধ্যে। পাঁচজন চলে গেলেন উত্তরবঙ্গের দিকে। মূলত রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর পাবনার দিকে। এই স্থানগুলো বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত। সুতরাং এরা বারেন্দ্র নামে পরিচিতি লাভ করলেন। বাকীরা রাঢ়ভূমি পদ্মার এই পারে থেকে গেলেন। বারেন্দ্রর ক্ষিতিশ/নারায়ণের ছেলে হলেন দীননাথ। ইনি বর্ধমান জেলার 'কুশ' নামের একটা গ্রামের জমিদারী পেয়েছিলেন। সেই থেকে ওনার নাম হয় দীননাথ কুশারী। দীননাথের অষ্টম বা দশম পুরুষ হলেন জগন্নাথ কুশারী। জগন্নাথ কুশারীরা হলেন রাঢ়ী। যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগণার গুড়-বংশীয় জমিদার দক্ষিণারঞ্জন রায়চৌধুরীর চার পুত্র কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। প্রথম দু'জন মুসলমান হয়ে জান। রতি ও শুকদেব নিজ হিন্দুধর্মেই থেকে যান। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ খুলনা জেলার পিঠাভোগের জমিদার 'জগন্নাথ কুশারী' সপ্তম শতাব্দীর শেষ প্রান্তে পিঠাভোগ থেকে কলকাতায় চলে আসেন। এই জগন্নাথ কুশারীর পাঁচ পুত্রের দ্বিতীয় পুত্র পুরুষোত্তম-এর বংশ থেকেই ঠাকুর বংশের ধারা চলে আসছে। অপর তিন পুত্রের ধারা প্রায় লুপ্ত। পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র রামানন্দের দুই পুত্র 'পঞ্চানন' ও 'শুকদেবে'র মাধ্যমেই কলকাতায় ঠাকুর গোষ্ঠীর সর্বপ্রথম বসবাস শুরু হয়। পঞ্চানন ও শুকদেব কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে গোবিন্দপুরে আদি গঙ্গার তীরে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে মৎস্য ব্যবসায়ী, জেলে, মালো, কৈবর্ত জাতির বাস। ইংরেজদের জাহাজ গোবিন্দপুরের গঙ্গায় এসে নোঙর করত। পঞ্চানন কুশারী ইংরেজদের মালপত্র জাহাজে ওঠানো নামানো এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানীয় ও খাদ্য সংগ্রহের কাজের জন্য সেখানকার স্থানীয় সকল নিচু শ্রেণির লোকদের সাহায্য নিতেন। হিন্দু নিচু শ্রেণির লোকরা ভদ্রলোক ব্রাহ্মণ পঞ্চাননকে নাম ধরে না ডেকে 'ঠাকুর মশাই' বলে ডাকতেন। জাহাজের নাবিকরাও তাকে 'পঞ্চানন ঠাকুর' বলে ডাকা শুরু করে। ইংরেজরা তাদের নথিপত্রে 'কুশারী' নামটি পাল্টে ঠাকুর লেখা শুরু করে। এই পঞ্চানন ঠাকুর থেকেই কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো, কয়লাঘাটার ঠাকুর গোষ্ঠির উদ্ভব এবং শুকদেব থেকে চোরাবাগানের ঠাকুরগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটে। এই হলো সংক্ষিপ্তভাবে কুশারী থেকে ঠাকুর পরিবারে উত্তরণের ইতিহাস।


তথ্যঋণ :
১. চাপড় ঘন্ট- রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্যানাল
২. বাংলা কবিতা-কবিতা ও কবিতার ওয়েবসাইট
৩. ঠাকুর পরিবার-উইকিপিডিয়া
৪. ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র



চাষী সিরাজুল ইসলাম, ঢাকা থেকে





Share on Facebook               Home Page             Published on: 19-May-2017

Coming Events: