জীবন থেকে জীবনে / নওরোজ খালিদ বর্ণী
আগের অংশ পরের অংশ
আমার জীবনের কিছু স্মৃতির কথা লিখলাম। যারা ধৈর্য নিয়ে পড়তে ভালবাসেন, তারা হয়ত পড়বেন।
....অরূপার ওজন ১১ কেজি ওজন হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে অপলা আধো আধো কথা বলতে শিখে গেল, গুটি পায়ে হাটা শিখে গেল, আর অরূপা কিছুটা পিছিয়ে থাকল। ওকে সেটুকু এগিয়ে নিতে আমাদের চেষ্টার সীমা ছিল না। দিনে দিনে আমিও হয়ে উঠছিলাম আরো মজবুত, বাচ্চার দোহাই দিয়ে আমাদের পারিবারিক- সামাজিক কোন কিছুই বন্ধ রাখিনি। শরীরের অসুস্থতাকে কখনো মনের অসুস্থতা হতে দেইনি, যাতে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে কোন বাধা না আসে। কারণ ওরাতো পরিস্থিতি বোঝে না, আমাদের হাসতে দেখলে ওরা হাসে, কাঁদতে দেখলে কাঁদে। আমরা নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম অবস্থা যাই থাকুক আমাদের ভাল থাকতে হবে। কিন্তু তারপরও কখনো কখনো ছোট ছোট ব্যাপারে মন খারাপ লাগত, বিশেষ করে যখন কোন কাছের মানুষ সব জেনেও আমাদেরকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য অবুঝের মত আচরণ করতো। একদিনের কথা মনে পড়ে- একদিন অরূপার শরীর হঠাৎ খারাপ হওয়ায় ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি, শুভ বাইরে থেকে খাবার কিনলো, এটা দেখে একজন অরূপার প্রতি অনেক ভালোবাসা দেখিয়ে বললেন “বাব্বাহ তোমরা পার কি করে এই অবস্থায় খাওয়ার কথা ভাবতে! আমার গলা দিয়ে তো একটা খাবারও নামবে না।“ আবার ঐ একই মানুষ যখন সমালোচনা করে নাক শিটকাতেন - আমরা বাসি ভাত কেন খাই, প্রতিদিন কেন রান্না করি না, সব কিছু পরিপাটি কেন থাকে না, তখন খুব খারাপ লাগতো। মেলানো কঠিন মানুষের এধরনের ভালবাসার আচরণ, কিন্তু উনার মত মানুষেরা না বুঝলেও আমাদেরকে তো ভাবতে হচ্ছে যে, মনের আর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অরূপাকে সামলাতে হয়, অপলা তখনো বাইরের কোন খাবার তেমন একটা খেতো না, যেটুকু খেতো তাতে ওর পেট ভরতো না। ওর খাওয়া আমার খাওয়ার উপর নির্ভর করে, আমি ক্ষুধার্ত থাকলে অপলার খাওয়া হতো না, ও খিদায় কাঁদতো। যেসব বাচ্চার খাওয়া তাদের মায়ের উপর নির্ভর করে, বাচ্চা খাওয়া না পেলে কেমন লাগে তা শুধু ঐ মা'ই জানে। সব সামলাতে আমাদের এতো লোক দেখানো সৌজন্য শোক করার সুযোগ ছিলো না। ঐ সময় আসলেই আমাদের জীবনে কোন রকম বিলাসিতার অবকাশ ছিল না। যা পেতাম তাই খেতাম, যেমন অবস্থা হতো তেমনি মেনে নিতাম। অরূপার এতো বড় বড় বিষয় সামলাতে আমার একটুও কষ্ট হতো না, কিন্তু কিছু মানুষের এই রকম ব্যবহারগুলো চাবুকের মত গায়ে বিঁধতো আর বোকার মতো কষ্ট পেতাম। যাই হোক এসব উদাহরণের তো আর শেষ নাই।
এভাবে চলতে চলতে একটা সময় হঠাৎ করে অরূপার কিডনির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল, ডাক্তার বললো- “এখনি ট্রান্সপ্লান্ট অথবা ডায়ালাসিস ছাড়া কোন উপায় নাই”। ডায়ালাসিসের জন্য আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করল আর তড়িঘড়ি করে আমাদের দুজনের কিডনি ম্যাচিং এর জন্য টেস্ট শুরু করল। আমি তো তেমন টেনশন করছি না, ভাবছি আমি যেহেতু মা, কাজেই আমার সাথে তো মিলবেই আর একবার ট্রান্সপ্লান্ট হলেই তো অরূপা ঠিক হয়ে যাবে। একদিনের কথা কোনদিন ভুলবো না - ম্যাচিং এর জন্য যে পরিমাণ রক্ত লাগবে তা আমাদের কাছ থেকে নেওয়া তো কোন সমস্যা না, কিন্তু ঐ পরিমাণ রক্ত অরূপার ছোট্ট শরীর থেকে নিতে হলে তা ভেইন থেকে নিলে হবে না আর্টারি থেকে নিতে হবে। এজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন নার্স ওর মুখে লাফিং গ্যাসের মাস্ক চেপে ধরে ছিল আর আরেকজন নার্স ওর পা এর আর্টারি থেকে রক্ত নেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি অরূপার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম একটু পরে দেখি ওর মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বের হচ্ছে আর শরীরটা নীল হয়ে গেছে, আর চোখের শুধু সাদা অংশটা দেখা যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে নার্সদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ শুনছে না, ভাবছে আর্টারি থেকে বাচ্চার রক্ত নেয়া হচ্ছে তাই দেখে মা কাতর হয়ে হয়ে চেঁচামেচি করছে। ততক্ষণে আমি ওই নার্স এর হাত ধরে ধাক্কা দিতে শুরু করেছি আর নার্স টা খুবই বিরক্ত হয়ে আমাকে সরানোর চেষ্টা করছে। তারপর যাহোক এক পর্যায়ে নার্স অবস্থা বেগতিক দেখে ইমার্জেন্সি বোতাম চাপ দেবার সাথে সাথে ঐ ঘরে পাঁচ ছয় জন ডাক্তার এসে গেলো, তাদের চেষ্টাতেই অরূপা আবার নিঃশ্বাস নেয়া শুরু করলো। ঐ দিন আমি প্রথম অরূপাকে হারানো আর একই সাথে ফিরে পাওয়ার মিশ্র অনুভূতি অনুভব করলাম। এমন উদাহরণের অবশ্য অভাব নাই ছোট্ট অরূপার জীবনে।
কিন্তু মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরল যখন কিডনির ম্যাচিং রিপোর্ট আসল। আমার সাথে সব কিছু মিলছে কিন্তু আমার শরীরে এন্টিবডি অনেক বেশী। প্রেগনেন্সির পর সব মেয়েদের শরীরে এন্টিবডি বেড়ে যায়, কিছুতেই আমার কিডনি অরূপার জন্য নেবে না। আমার অনেক অনুরোধের জবাব হিসাবে বললো- “তুমি হাজার চাইলেও কোন লাভ নাই তোমার কিডনি অরূপার শরীরে কয়েক দিন পর আর কাজ করবে না, কারণ অরূপার শরীরেও তখন এন্টিবডি বেড়ে যাবে, পুনরায় ম্যাচিং এর জন্য অবস্থা তখন আরো কঠিন হয়ে পরবে”। আবার এদিকে শুভর সাথে সব কিছু ম্যাচ করেছে কিন্তু শুভর সুগার লেভেল অনেক বেশী তাই ওর কিডনিও অরূপার জন্য দিতে পারবে না। একেবারে দিশাহারা হয়ে পরলাম, এত দিনের আশায় ছাই পড়ে গেলো। তারপর জানতে পারলাম “পিয়ার ডোনেশন” এর ব্যাপারে। আমাদের মত আরও যেসব পরিবার আছে যাদের কিডনি প্রয়োজন তাদের সাথে যদি আমাদের ম্যাচিং হয় আর আমাদের সাথে যদি তাদের ম্যাচিং হয় তাহলে কিডনি অদল- বদল হবে। তাছাড়া মরণোত্তর অরগান ডোনেশনের সিদ্ধান্ত যারা নেয় তাদের কারো সাথে ম্যাচ করলে ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব, কিন্তু এই ধরনের ম্যাচিং খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। তারপরও অনেক অনিশ্চয়তার বোঝা মনে নিয়ে আমরা “পিয়ার ডোনেশন” এর জন্য প্রস্তুতি নিলাম। এর মধ্যে শুভ আর একবার ওর সাথে ম্যাচ করে দেখার জন্য অনেক অনুরোধ করে অনুমতি পেল। আল্লাহর অশেষ রহমতে দ্বিতীয়বার শুভ'র সুগার লেভেল ভাল আসল, তক্ষনি সিদ্ধান্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব শুভর কিডনি দিয়ে অরূপার ট্রান্সপ্লান্ট করা হবে। এই সিদ্ধান্ত যেদিন হলো, সেদিন ছিল ৩ জুন অপলা-অরূপার ২য় জন্মদিন। উপহার হিসাবে শুভ অরূপাকে দিল নিজের কিডনি আর অপলাকে ফিরিয়ে দিল ওর জন্মান্তরের সাথী অরূপাকে। আর আমি ওদেরকে উপহার দিলাম আরো মজবুত একজন মা। ট্রান্সপ্লানটের তারিখ কাকতালীয় ভাবে ঠিক হল ১৬ই জুন-- ওই দিন আমাদের বিয়ে বার্ষিকী, উপহার হিসাবে আল্লাহর কাছে আমরা অরূপার স্বাভাবিক জীবনটা চাইলাম। এখন ভাবলে অবাক হই যে আমাদের জীবনের বিশেষ তারিখ গুলা কিভাবে আরও বিশেষ হয়ে গেছে।
যাই হোক, মনে অনেক আশা নিয়ে বাসায় আসলাম, কিন্তু মনের আশঙ্কা তো আর যায় না। ২ বছর বয়সের মাত্র ১১ কেজি ওজনের একটা বাচ্চার ঐটুকু শরীরে কি করে বড় মানুষের কিডনি লাগানো হবে? শুভ এ বিষয়ে অনেক তথ্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করল, কিন্তু কোন কিছুতেই মনের ভয় কাটলো না, বরাবরের মতো আল্লাহর উপরে সব কিছু ছেড়ে দিলাম। এত কিছুর ভিতরেও শুভর মাথা সব সময় খুব ঠাণ্ডা, সব পরিস্থিতির জন্য ও যেন প্রস্তুত, সব কিছু যেন ভালই হবে। অবশেষে অনেক প্রতীক্ষার পর শুভর কিডনি দিয়ে অরূপার ট্রান্সপ্লান্ট হলো।
এখন ঐ অবস্থাটা ভাবলে শিউরে উঠি। ঐ সময় নানা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে জীবন কেটেছে, মনের অজান্তে যা দেখেছি তা আজও আমার পিছু ছাড়েনি। অরূপা ছিলো চিলড্রেন হসপিটালে, শুভ পাশের এডাল্ট হসপিটালে, ছোট্ট অপলা আমার সাথে সারাক্ষণ লেপটে থাকে। দিনের পর দিন বাড়ীতে যেতে পারি না, নাওয়া-খাওয়ারও কোন ঠিক ছিল না, একজন নার্স সারাদিন আমার সাথে থাকতো, সাহায্য করতো। অপলার কোন সমস্যা হত না, ও যেন ওভাবেই নিজেকে খুশী রাখতে শিখে গেছিল, কখনো আমাকে বিরক্ত করত না বরং অরূপাকে সামলাতে আমাকে সাহায্য করত। আর এমন ভাব করতো ও যেন অরূপার আর একটা মা। ওই সময় এখানে কাছের বন্ধুদের সাহায্যের কথা তো আর অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না, তার সাথে ছিল দেশে পরিবার আর স্বজনদের দোয়া। যা প্রাণ থেকে অনুভব করেছি।
এই হসপিটালে অপলাকে নিয়েই হোস্টেলে থাকার সুযোগ করে দিল সোশাল ওয়ার্কার। মনে পড়ে, শুভর অপারেশন এর আগে ওর ডাক্তার হেসে বলেছিল “চিন্তা করো না আমরা সাবধানে তোমার কিডনি বের করব, অন্য সময় তো অসুস্থ কিডনি বিনে ফেলে দেই তোমারটা তোমার মেয়ের জন্য যত্ন করে পাঠাব।“ ৪ ঘণ্টা ধরে শুভর কিডনিটা ওর শরীর থেকে বের করে বরফ দিয়ে নিয়ে আসল, এনেস্থিসিয়া রুমে অরূপাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, ডাক্তার গর্ডন থমাস যিনি অরূপার অপারেশন করবেন, উনার মা বাঙালী ছিলেন, উনি ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারতেন, বললেন- “ভালো ভালো, তোমার হাসবেন্ডের কিডনি অনেক ভালো অবস্থায় পেয়েছি।“ কথাগুলো কানে আসছিল কিন্তু কতটুকু শুনেছি বলতে পারব না, মাথাটা পুরো ফাকা হয়ে গেছিল। ভাবতে পারছিলাম না যে শুভর কিডনিটা ওর শরীর থেকে বের করে ফেলেছে। পায়ের নিচটা শূন্য লাগছিল, জানি না কোন শক্তিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার ২ মিনিটের মধ্যে অরূপাকে এনেস্থিসিয়া দিল ও আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে চলে গেল।
তারপর আসলাম শুভর কাছে। তখনো ওর জ্ঞান ফেরেনি, শুভকে দেখে কেমন যেন হুহু করছিল মনের মধ্যে, ওর জায়গায় আমি থাকতে না পারার কষ্টটাও হচ্ছিল খুব, তবে জ্ঞান ফেরার পর শুভর চেহারায় যে প্রশান্তি ছিলো তাতে মনে হলো শরীরের সব কিছু দিয়ে দিতেও যেন ওর কোনই সমস্যা নাই। ৯ ঘণ্টা পর অরূপাকে দেখতে গেলাম ICU তে, কাঁচের জানালা দিয়ে দূর থেকে অরূপাকে দেখলাম, ছোট্ট দুটো ঝুটি করা, ঘুমিয়ে আছে চুপ করে।
ডাক্তার জানালো শুভর কিডনি বড় থাকার কারণে আর ওর কাটা জায়গা ফুলে থাকার কারণে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ দিন পেট সম্পূর্ণ খোলা রাখবে, সেলাই করবে না, আর জ্ঞানও ফিরাবে না। শুভ যেহেতু তখন অরূপার কাছে আসতে পারবে না তাই অরূপার একটা ছবি তুললাম শুভর জন্য। পরের দিন শুভকে হুইল চেয়ারে নিয়ে অরূপার কাছে আসলাম, শুভ ঘুমন্ত অরূপাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারল, কষ্টের মধ্যেও মনের মধ্যে একধরনের শান্তি।
জ্ঞান ফেরার ৪ দিন পর সকালে অরূপাকে ওয়ার্ডে দিল, দুপুরে ওকে নরম খাবার দিল। আমাকে অবাক করে ও মুখে একটু খাবার খেলো, আর সন্ধ্যার মধ্যে ওর শরীরে লাগান সব যন্ত্রপাতি সহ বেবি কট ধরে একাই উঠে দাঁড়াল। খুব ভয় লাগছিল- আমার মনে হচ্ছিল যদি ও ব্যথা পায়? পেটের মধ্যে লাগানো শুভর কিডনিটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়? অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে অরূপা হাসছিল, দুষ্টুমি করছিল, অপলার সাথে কথা বলছিল। অপলা তখন ভাঙা ভাঙা কথা বলতে পারত কিন্তু অরূপা বলতো না, অপলাই শুধু অরূপার ভাষা বুঝত। আমি রাতারাতি এই পরিবর্তন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যেই অরূপা মুখে কিছু খেত না বলে টিউব দিয়ে খাওয়াতাম আর ফিডিং ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করতাম, হাঁটত না তাই ফিজিও থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হত, কথা বলত না তাই স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতাম, আরো কতো জায়গায় দৌড়াতাম তা বলার না, অথচ শুভর একটা অর্গান নিমিষে অরূপাকে ওর স্বাভাবিক জীবনটা ফিরিয়ে দিল। ঐ দিন শুভ এসে যখন এই নতুন অরূপাকে দেখলো ওর সেই আনন্দটা সব কিছুর ঊর্ধ্বে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়.... আগের অংশ পরের অংশ
নওরোজ খালিদ বর্ণী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|