জীবন থেকে জীবনে নওরোজ খালিদ বর্ণী
আমার জীবনের কিছু স্মৃতির কথা লিখলাম। যারা ধৈর্য নিয়ে পড়তে ভালবাসেন, তারা হয়ত পড়বেন।
আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ৫ই নভেম্বর আমি জানতে পারলাম আমার আর শুভর জীবনে নতুন কেউ আসছে, ঐ দিন ছিল আমার জন্মদিন, মনে হলো জীবনে এর চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে! ৯ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ডের দিন, আমরা দুজন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি বেবির হার্ট-বিট শোনার জন্য, কোন ধারনাই ছিলো না, এতটা জোরে যে শুনতে পাব ভাবতেই পারিনি, মনে হচ্ছিল আমার নিজের হার্টের ঢিপ ঢিপ শব্দই যেন শুনতে পাচ্ছি, ডাক্তার হেসে বললো -”কি কয়টা হার্ট-বিট শুনতে পাচ্ছ?” হাতের দুটো আঙ্গুল তুলে দেখালো। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বললো-”দুইটা হার্ট-বিট পাওয়া যাচ্ছে, তোমার তো টুইন্স হবে।” দুইটা হার্ট-বিট আলাদা করে ভীষণ ভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই আলাদা করে বুঝতে পারলাম না। খুশিতে আমরা দুজনই কোন কথা বলতে পারছিলাম না, সব সময় আমার টুইন্সের অনেক সখ ছিল, আর সত্যিই যে আমার হবে তা ভাবতেই পারিনি।
যাই হোক তারপর একটু একটু করে ওরা খুব ভাল ভাবে বেড়ে উঠছিলো আমার ভিতর, নতুন নতুন ভাল লাগার অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটা মুহূর্ত। আয়নাতে একটু একটু করে নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম। ভেবেছিলাম ছেলে না মেয়ে জানতে চাইব না; কিন্তু পারিনি, পঁচিশ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ডের দিন জেনে গেলাম দুইটা মেয়ে হবে। শুভ খুশীতে নাম ঠিক করতে লেগে গেল। ঠিক হলো, যে আগে আসবে তার নাম হবে অপলা আর যে পরে আসবে তার নাম অরূপা। এরপর ২ সপ্তাহ পর পর স্ক্যান করতে যেতাম আর আলো-আধারিতে ওদের নানান কীর্তিকলাপ দেখতাম দুজন মিলে। কিন্তু ৩৪ সপ্তাহের স্ক্যানের দিন, নার্স মুখ কাল করে ডাক্তারকে ডেকে আনলো, আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললো “তোমার আজকে আর বাড়ী যাওয়া হবে না, আজকেই তোমার বেবি হবে, ইমার্জেন্সি সিজার করতে হবে।” আমার মনটা খুবই অস্থির হয়ে গেল। স্ক্যানের আগ মুহূর্তেও জানতাম বাচ্চাদের গ্রোথ-পজিশন সব ঠিক আছে , সিজার করতে হবে না। আমাদের তখনো তেমন কোন প্রস্তুতি নাই, আর মনে হলো সময়ের আগেই কেন ওদের আমার শরীর থেকে বের করা হবে, আর একটু থাকত আমার ভিতরে! শুভ বললো- “চিন্তা করছ কেন? স্ক্যান করার সময়,ওদের দেখার জন্য এত অস্থির হও, এখন বরং পৃথিবীর আলোয় ওদের চেহারা দেখতে পাবা! ভাবো তো আজকেই দুই কন্যা কোলে নিয়ে বসে থাকতে পারবা। ভয় পেয়ো না,যা হতে যাচ্ছে তা অবশ্যই ভাল হবে- ইনশাআল্লাহ।” অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, শুভ'র কথায় আবার সাহস ফিরে পেলাম, বাচ্চাদের দেখার লোভে মনটা ভাল হয়ে গেল।
কিছু সময়ের ব্যবধানে, অপলা- অরূপা চলে আসল আমাদের কাছে। প্রিম্যাচিওর হওয়ায় ওদের ইঙ্কিউবেটরে রাখা হলো। জ্ঞান ফিরে শুভর কাছে শুনলাম ওরা ভাল আছে, অনেক সুন্দর হয়েছে। ওদেরকে যখন প্রথম দেখলাম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ফুটফুটে বাচ্চা দুইটা আমার। প্রথমবার নিজের বাচ্চাদের একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য নার্সের অনুমতি চাইতে হলো, কিন্তু ইঙ্কিউবেটরের ছোট্ট জানালা দিয়ে ওদের উষ্ণ তুলতুলে শরীর দুটো ছুঁয়ে আমার সারা শরীরে যেন ঠাণ্ডা আনন্দের বাতাস বয়ে গেলো।
কিন্তু ওদের পাওয়ার সব আনন্দ ছাপিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে চরম কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিলেন, ওরা একই প্লাসেনটাতে থাকার কারণে, টুইন টু টুইন ব্লাড ট্রান্সফিউশন হয়েছিল, আইডেন্টিক্যাল টুইন্সের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে সেই আশঙ্কার কথা ডাক্তার আগেই বলেছিল, তবে এটা আগে থেকে বোঝার কোন উপায় নাই, আবার কোন প্রতিকারও নাই। জানতে পারলাম অপলা আল্লাহর রহমতে একদম ঠিক আছে আর অরূপারও সব ঠিকই আছে শুধু কিডনিতে একটু সমস্যা হচ্ছে।
ঐ সময় ৭ দিন পর আমাকে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিল, কিন্তু অপলা-অরূপা কে ছাড়লো না,জানালো যে ওদেরকে আমার সাথে নিয়ে যেতে দিবে না। বুঝে পেলাম না বাচ্চা দুটোকে হসপিটালে রেখে কি করে বাসায় চলে যাব! কোন মায়ের পক্ষে কি এমনটা করা সম্ভব! যাই হোক, কঠিন বাস্তবতার কাছে মায়ের মনের মায়া বা আবেগ সব কিছু ধুয়ে মুছে গেলো। শুভ আমাকে বাসায় নিয়ে আসল, হসপিটাল থেকে শুধু নিয়ে আসলাম একটা “এক্সপ্রেস পাম্প”। বাড়ী থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন দুটো বাচ্চা আমার শরীরের অংশ ছিল। নিজের শরীরের ভিতর সব সময় ওদের অস্তিত্বকে অনুভব করছিলাম। আর বাড়ীতে ফিরলাম ওদের ছাড়া শূন্য হাতে। সখের স্বপ্নগুলো কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। তারপরও শুভ যেন কিছুতেই আমার মনের মধ্যে গড়া স্বপ্নগুলো ভাঙতে দিবে না। ও এমন ভাবে ব্যাপারটা হালকা করার চেষ্টা করল যেন এটা কোন ব্যাপারই না, একটু সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা মাথায় বসে আমাকে অনেক বোঝাল। বলল- “আল্লাহ আমাদের ভালবাসেন, তাই আমাদের পরীক্ষা করছেন। আল্লাহ পরীক্ষা যেমন দিয়েছেন সাহায্যও করবেন। সবই এখন নির্ভর করছে আমাদের উপর। এই পরীক্ষায় আমরা ঠিকই ভালভাবে উত্তীর্ণ হবো কখনই ভাগ্যকে দোষারোপ করে হা হুতাশ করে হাল ছেড়ে দেব না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, তুমি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।” শুভ আমার অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য আরো বললো “মনে করো- এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তোমার বাচ্চার হাত কেটে গেলে কি তুমি নিজের বাচ্চার রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবা! নাকি নিজে শক্ত থেকে ডাক্তারের কাছে নিবা! আমি জানি, তুমি মা, এই দুর্বল সময়ে তোমার পক্ষে মাথা ঠিক রাখা কঠিন কিন্তু এখন এই জটিল সময়টার মোকাবেলা করার জন্য আমাদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে, মনটাকে আরো শক্ত করতে হবে, যাতে আমরা আমাদের বাচ্চাদের সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারি। আর আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারি।”
অনেক কথার পর ঐ রাত থেকেই সংকল্প করলাম, শুভর বিশ্বাস আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। বাবা হিসাবে ওর কষ্টটা তো কোন অংশে কম না, তার মধ্যেও এত দৌড়া দৌড়ি করছে, সাথে আমাকেও সামলাচ্ছে। আর আমি মা, আমাকে তো পারতেই হবে। যত যাই হোক কিছুতেই ভেঙে পরব না। শুভর মত একজন মানুষ পাশে থাকতে যত ঝড়ই আসুক না কেন সব সামলে নেবো। তারপর থেকে কখনো চোখের পানি ফেলিনি, ক্লান্ত হয়ে পরিনি কোন কিছুতে, খাওয়া-ঘুম কোন কিছুরই যেন কোন চাহিদা ছিল না। তাতে কোনো সমস্যাও হত না। তখন মনে প্রাণে শুধু আল্লাহকে ডেকেছি, যা কিছু সামনে এসেছে সামলানোর চেষ্টা করে গেছি, আর মনে করেছি সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঐ কঠিন সময়ে হসপিটালের সোশাল ওয়ার্কার আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। ও আমার অবস্থা দেখে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিল হসপিটালের হোস্টেলে। শুভ রাতে বাসায় যেত, রান্না সহ সবকিছু করত, সকাল হলে আমার খাবার নিয়ে আবার হসপিটালে আসত। এভাবে ১ মাস যাবার পর অপলাকে ছেড়ে দিল, কিন্তু বাচ্চা নিয়ে ওই হোস্টেলে থাকার কোন নিয়ম নাই। তাই আবারো কোনো উপায় না পেয়ে বাস্তবতার চাপে বাধ্য হয়ে অরূপাকে হসপিটালে একা রেখে শুধু অপলাকে নিয়ে বাসায় আসলাম। প্রতিদিন সকালে শুভ আমাকে আর এক মাসের অপলাকে হসপিটালে দিয়ে কাজে চলে যেত, আবার বিকালে কাজ থেকে হসপিটালে ফিরলে, রাতে তিন জন বাসায় চলে যেতাম। এভাবে ৩ মাস যাবার পর অরূপাকে পাঠিয়ে দিল সিডনি ওয়েস্টমিড চিলড্রেন হসপিটালে। এম্বুলেন্সের জানলা দিয়ে আমার ছোট্ট অরূপা এই প্রথম বাইরের আলো দেখলো।
এত দিন ভাবছিলাম সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু নতুন হসপিটালে আসার পর প্রথম জানলাম অরূপাকে বাঁচাতে হলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া আর কোন উপায় নাই। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না, এইটুকু বাচ্চার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট কি করে সম্ভব, এখানে বাংলাদেশ - ইন্ডিয়ার মত অর্গান পাওয়ার তেমন কোন সুযোগ নাই, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তখন এটাও জানলাম যে ডাক্তার যদি আরও সতর্ক হতো অর্থাৎ দুই সপ্তাহ অন্তর আলট্রাসাউন্ড না করে যদি আরও ঘন ঘন আলট্রাসাউন্ড করতো, তবে টুইন টু টুইন ব্লাড ট্রান্সফিউশন আরো আগে বোঝা যেতো তাহলে হয়ত এত বড় ক্ষতি হত না। চাইলে রয়াল প্রিন্স আলফ্রেড হসপিটালের ডাক্তারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতাম কিন্তু সব কিছু সামলাতে গিয়ে ওসব কিছু আর করা হয়ে উঠেনি। কিন্তু আমি যে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ছিলাম ঐ ডাক্তারকে কোন দিন ক্ষমা করব না, তাতে এখন অবশ্য কিছুই আসে যায় না।
তারপর দফায় দফায় মিটিং করে আমাদের সব জানালো যে কিভাবে কি করা সম্ভব, অনেক কথার পর, যখন জানলাম আমার বা শুভর যার সাথে ম্যাচ করবে তার একটা কিডনি দিয়ে অরূপাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব, তখন একটু স্বস্তি পেলাম। তবে অপারেশনের জন্য ওর ওজন কমপক্ষে ১১ কেজি হতে হবে। ডাক্তার আমাদেরকে নানা ভাবে বোঝালো। বলল-”তোমরা তো অনেক সৌভাগ্যবান যে তোমাদের দুটো করে কিডনি আছে যার একটা তোমার বাচ্চাকে দেয়ার কথা ভাবতে পারছ, তাতে তোমার বাচ্চাও নতুন জীবন পাবে আর তুমিও ভাল ভাবেই তোমার জীবন পার করে দিতে পারবা। ভাবতো ঐ সব বাবা- মার কথা যাদের বাচ্চাদের হার্ট বা কর্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট দরকার তারা কত অসহায়, নিজে বেঁচে থাকতে তারা বাচ্চাকে অর্গান দিয়ে বাঁচাতে পারছে না।” আরো বললো- “যে কোন ট্রান্সপ্লান্টই কঠিন তবে ট্রান্সপ্লান্ট সফল হলে মানুষ কিন্তু তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের চাইতে খারাপ থাকে না বরং অনেকাংশে ভালো থাকে কেননা তাকে নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়, নিয়ম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হয়।” ডাক্তার আমাদেরকে কিছু ছবি সহ আর্টিকেল দেখালো যারা হয়তো অরূপার চাইতেও কঠিন অবস্থা থেকে জীবনে অনেক সফল হয়েছে। কেউ ক্রিকেটার কেউ সাঁতারু কেউ আবার কিডনি স্পেশালিষ্ট ইত্যাদি হয়েছে, জীবনে কোন কিছুতেই বাধা আসেনি। “সুতরাং দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে বরং আশা রাখো যে তোমাদের বাচ্চা অনেক ভালো ভাবে বড় হবে, জীবনে ও যা হতে চায় হবে, তোমাদের অরূপাও একদিন মা হবে।” কথাগুলা মনের মধ্যে একদম গেঁথে গেলো, আশায় মনটা ভরে গেলো। ডাক্তারের বিদ্যা আর ক্ষমতার উপর আশ্বাস রেখে আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিলাম। তখন থেকে আমার মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস চলে আসল যে আমার একটা কিডনি দিয়েই সব কিছু সমাধান হয়ে যাবে।
তারপর সিদ্ধান্ত হলো অরূপাকে বাসায় যেতে দিবে, তখন CPR, ফিডিং টিউব লাগানো সহ আরো অনেক ইমারজেন্সি ট্রেনিং দিলো আমাদের, তখন ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিলো বাচ্চাকে প্রথম বাড়ীতে নেয়ার সময় বাবা মায়েরা কত স্বপ্ন-মাখা পরিকল্পনা করে, আর আমরা করছি ইমারজেন্সি ট্রেনিং। ক্ষণিকের ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনে অনেক আশা নিয়ে ৪ মাস পর প্রথম বারের মত আমাদের অনেক সখের টুইনস্ নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তারপরও হসপিটালের গণ্ডি পেরোতে পারলাম না, প্রতিদিনই দৌড়ের উপর থাকতে হতো, অর্থাৎ যখন তখন হসপিটালে যেতে হত। কিন্তু তারপরও মনে হতো দিন শেষে বাড়ীতে তো আছি। এভাবেই ওদের দুজন কে নিয়ে হাসি কান্নায় আমাদের মত নতুন মা-বাবার না বলা কাহিনীর ভাণ্ডার দিনে দিনে বাড়তে থাকে। জীবনের এই অধ্যায়টা আর না লিখি কারণ ঐ সময়কার কিছু কথা আর মনে করতে চাই না। প্রায়ই মনে হতো পরীক্ষা দিতে বসেছি, কিন্তু কোন প্রশ্নেরই উত্তর জানি না,সারা রাত পড়েছি এক বিষয়,পরীক্ষায় বসে দেখি অন্য বিষয়। তারপরও উত্তীর্ণ হবার আপ্রাণ চেষ্টা.... পরের অংশ
নওরোজ খালিদ বর্ণী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|