পার্থের চিঠি (১১তম পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
সার্বিয়ান খাবার বুরেকঃ
১৬ মে ২০১৫ শনিবার কোভেন্ট্রি ভিলেজ সুপারমার্কেটে আনিসার চুল কাটা নামের সংগ্রাম শেষ হলে পাশের দোকানগুলোতে কিছু কেনাকাটা করল তানভীর। সেখানে এক দোকানে বিড়াল, কুকুর, খরগোস, গিনিপিগ ইত্যাদি বিক্রি হয় দেখলাম। ওই দোকানের সামনে একটা বিশাল পার্সিয়ান বিড়াল শিকল দিয়ে বেঁধে এক সোফায় শুইয়ে রেখেছে। সে ঘুমাচ্ছে আরামসে। অনেকেই তাকে আদর করল। মিতি আর আমিও আদর করলাম। কি তার নরম লম্বা সাদা লোম! এমন কখনও দেখিনি।
পরে আর্লি লাঞ্চের আয়োজন হলো ঐ সুপারমার্কেটে। মিতি আর তানভীর ঐ রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসলো আনিসাকে নিয়ে। সেখান এক কেনিয়ান অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি তাদের দোকানে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করছে দেখলাম। আদিতে তারা ভারতীয় ছিলেন। পরে তাদের পূর্বপুরুষরা স্থায়ীভাবে আফ্রিকার কেনিয়া চলে গেছেন। এরা এই প্রজন্ম আবার স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়া চলে এসেছেন। বেশ বিচিত্র। সেখান থেকে আনিসার জন্য জামা কিনলাম। আনিসার জামাটা ভিজে গেছিল। তাই নতুন একটা জামা কেনা খুব দরকার ছিল। এই দম্পতি হিন্দিতে কথা বলতে পারে। তাদের সাথে হিন্দিতে কথা বলে আনন্দ পেলাম। খুব সদালাপী এই দম্পতি, বিশেষ করে মহিলাটি।
ফিরে এসে লাঞ্চ করলাম। খুব সুস্বাদু খাবার দিয়ে লাঞ্চ। নাম বুরেক। রেস্টুরেন্টের নাম সুলতান (Sultan)। এটা বারবারোসদের রেস্টুরেন্ট। এই বারবারোসরা সার্বিয়ান, সম্ভবতঃ মুসলমান। তাদের উপর সার্বিয়ার এককালের মুসলিম শাসক তুর্কীদের প্রভাব এখনও খুব প্রবল বোঝা গেল। এই খাবার গোল পরোটার মত। তার ভিতরে গোস্তের কিমা। আজ ছিল গরুর গোস্তের। ভেড়ার গোস্তেরও হয়। পরে গোল গোল অংশগুলো পেঁচিয়ে ৩প্যাচ জোড়া লাগানো হয়। মানে জোড়া লেগে যায় পাশাপাশি। লম্বায় ৫/৬ ইঞ্চি হয়। স্বাদ অপূর্ব। বাবলীর জন্য খিচুরি সবজী নেয়া হল তার মুখের লাইকেন ফ্লানাস (Lichen Phlanus) রোগের জন্য যাতে ডাক্তারের পরামর্শে তার জন্য গরুর গোস্ত নিষিদ্ধ। পরে আমার কাছ থেকে বাবলী কিছুটা বুরেক নিল। তানভীর অন্য কিছু নিয়েছিল, গোল লম্বা কাবাব ও পরোটা। পরে সেও মিতির কাছ থেকে কিছুটা বুরেক নিল। পরে কোক খেলাম। এরপরে তানভীর বাবলীর জন্য পনির আর পালং শাক দেয়া একটা কিমা-পুরীর মত নিয়ে এলো। সেটা বাবলী আর আমি ভাগাভাগি করে খেলাম। এর স্বাদও ভাল। পরে আমরা একটু আগালাম। সেখানে বাচ্চাদের খেলার আয়োজন বিনা পয়সায়। দোতালা সমান উঁচুতে কিছু। ফ্লোর লেভেলে কিছু। আনিসাকে সেখানে তার প্র্যামে করে নিয়ে যাওয়া হল। একটা কিউবে তাকে ঢুকানো হল। কিন্তু দুটো বাচ্চা সেখানে আগে থেকেই খেলছিল বিভিন্ন আকৃতির বিভিন্ন রংয়ের কিউব, ত্রিভুজ, বৃত্ত ইত্যাদি দিয়ে। সম্ভবতঃ স্পঞ্জের তৈরি। আনিসা একটা বাচ্চা যেগুলো নিয়ে খেলছিল সেগুলো দিয়ে খেলতে চেয়েছিল। তাতে করে সেই বাচ্চার সাথে আনিসার মারামারি লেগে যেতে পারে। তাই আনিসাকে ঐ খেলাঘরের ভিতর থেকে সরিয়ে আনা হল। পরে মিতি আর বাবলী পাশের কেমিস্ট শপ থেকে কিছু কেনাকাটা করতে গেল। তানভীর তো আগেই কেনাকাটা করতে অন্য দোকানে গেছে। আমি আনিসাকে সেই বাচ্চাদের খেলার রাজ্যের এলাকায় কিন্তু খেলাঘর বা কিউবের বাইরে প্র্যামে নিয়ে ঘুরলাম। পরে সবাই বাসায় ফিরলাম।
স্ত্রীর মমতাঃ
সকাল থেকে মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বিকেলে আলো কমে এসেছে। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। আমি আর বাবলী দুজনে বের হলাম নাতনী আনিসাকে প্র্যামে নিয়ে। আনিসা ও বাবলীর সাথে কিছুক্ষণ যেয়ে পরে আমি একলা আরো হাঁটতে গেলাম সোয়ান নদীর পারে। কিন্তু দেখি কনকনে হাওয়া বইছে নদীর মানে দক্ষিণ দিক থেকে। তবু নদীর পারে গেলাম হেঁটে। কাঠের জেটিতে গেলাম। সেখান থেকে মে ল্যান্ডস ইয়ট ক্লাবের সবুজ চত্বরে আসতেই দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তার মাঝে গাছের আড়ালে ক্লাব বিল্ডিং/কমপ্লেক্সের পিছনে আসলাম। সেখানে টয়লেট আবিষ্কার করলাম। জেন্টস আর লেডিজ এর জন্য। এটা পরে অনেক কাজে লাগবে এই এলাকায় হাঁটাহাঁটি করতে। পরে দেখেছি এটা শুধু উইক এন্ডে খোলা থাকে। অন্য দিনগুলোতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর নিরাপত্তার কারণে এগুলো তালাবন্ধ থাকে। যাহোক,গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আরো এগিয়ে ওয়াকওয়ের পাশে ঝর্না বা সরু খালের উপরের কাঠের ছোট্ট সেতু পার হয়ে হিলটপ পার্কের হিলের গোড়ায় পৌঁছলাম। তারপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম। পাহাড়ের ঢালের ঘন গাছের আড়ালে আগাচ্ছি। এমন সময় জীবন সঙ্গিনী বাবলীর মোবাইল পেলাম। গতকাল বিকেলেই আমার মোবাইল চালু করা হয়েছে জামাই তানভীরের সৌজন্যে। সেটা ছিল মহা-সুসংবাদ। গতকাল প্রথম মোবাইল বাবলীকে করলাম। যাহোক, আজ বাবলী বৃষ্টির জন্য আমার কাছে গাড়ী পাঠাবে কিনা জানতে চাইলো। আর বৃষ্টি হচ্ছে, তাই বাসায় ফিরতে বললো। আহা, মমতাময়ী স্ত্রী! আমি বললাম আমি গাছের আড়ালে আছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি না। যাহোক, তবু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলাম।
পরে হিলটপ পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে রাস্তার মোড়ে এসে বামে ঘুরলাম, ফোর্থ এভিনিউ ধরে এগিয়ে গেলাম। এই রাস্তা একটু দূরে উঁচু পাহাড়ের মতো হয়ে চলে গেছে। ব্যায়াম হবে মনে করে ঢাল বেয়ে পাহাড়ের মতো উঁচু অংশে উঠলাম, নামলাম। আবার উঠলাম, নামলাম। তারপর ফিরে চললাম বাসার দিকে। মেইন রোডে নদীর ধারে ইষ্ট ষ্ট্রীটে উঠবার মুখে দেখি জামাই তানভীর আমি যে পাশে ঘুরে এসেছি সেখান থেকে গাড়ী নিয়ে এসে আমাকে ডাকছে গাড়ীতে উঠবার জন্য। বাবলী তাকে পাঠিয়েছে নিশ্চয়। মমতাময়ী স্ত্রীর ভালবাসায় আপ্লুত হলাম। আমি তানভীরের ডাকে সাড়া দিয়ে গাড়ীতে উঠলাম। তানভীরকে অনেক ধন্যবাদ।
গাড়ী নিয়ে তানভীর এই ইষ্ট পার্থের এইথ এভিনিউয়ের কাছাকাছি কোলস (Coles) নামের ডিপার্টমেন্টাল শপে গেল। এই প্রথম বার এখানে আসলাম। অনেক বড় এটা। আর কত রকমারি জিনিষ পত্র যে সেখানে পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই। পরে অবশ্য অনেক বার সেখানে মার্কেটিংয়ের জন্য গেছি। যাহোক, সেদিন সেখান থেকে স্প্লেন্ডা নামের কম মিষ্টির সুইটেনার বা চিনির বিকল্প ও অন্যান্য শুকনো খাবার কিনল। বাসায় এসে তার একটা খাবার সে ডিম দিয়ে রান্না করল। অপূর্ব তার স্বাদ। চিতাই পিঠার মত। খুব মজা করে সেটা সবাই খেলাম চায়ের সাথে।
রাতে ডিনার করলাম মোটা বিশাল সাইজের লেবানীজ চাপাতি,সবজী আর গোস্তের ঝোল দিয়ে। নাতনী আনিসা আমার সাথে লেবানীজ চাপাতি গোস্তের ঝোল দিয়ে খেলো। তার খাওয়ার ভঙ্গী খুব মজার। সে চাপাতি ঝোলে ডুবিয়ে সেই ঝোল প্রথমে শুষে খায়। পরে চাপাতি খায়। শেষের দিকে সে ঝোলের বাটির মধ্যে তার হাত ডুবালো। তার এই ভঙ্গী তুলনাহীন!
ঝমঝম বৃষ্টিঃ
পরদিন ১৭ মে রবিবার। দুপুর থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি। এই কমপ্লেক্সের বিল্ডিংগুলোর ছাদ বা চাল টিনের। টিনের চালে বৃষ্টি পড়লে বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ীর মতো ঝমঝম আওয়াজ হয়। শুনতে খুব মজা লাগে। তবে বৃষ্টি আষাঢ় মাসের বৃষ্টির মত। এই ঝমঝম বৃষ্টি। এই নেই।
রোদেলা দিনঃ
পরদিন ১৮ মে সোমবার। আজ চমৎকার রোদেলা দিন। সুন্দর নীলাকাশ। হাঁটতে বের হলাম একা। তখন বেলা সোয়া দশটা। প্রথমে সোয়ান নদীর দিকে যাওয়া শুরু করলাম। পরে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে ডান দিকে। গিলফোর্ড রোডের মোড়ে এসে বাম দিকে টার্ন নিয়ে ঐ রাস্তা ধরে আগালাম। পরে বাম দিকে ফোর্থ এভিনিউ ধরে আগালাম। এটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পরশু যে পাহাড়ের মত অংশে উঠেছিলাম সেখানে এসে পৌঁছলাম। পরে সেটা ধরে এগিয়ে সোয়ান নদীর কাছাকাছি ইষ্ট ষ্ট্রীটে এসে পৌঁছলাম। মনে আবিষ্কারের আনন্দ।
সোয়ান নদীর ঘাটে কাঠের জেটিতে গেলাম। পরে মেল্যান্ডস ইয়ট ক্লাবের সবুজ চত্বর। বৃষ্টিতে নদীর পানি বেড়ে গেছিল তার নমুনা পাওয়া গেল। এই পানি কূল ছাপিয়ে ঘাসের চত্বরে ও আশে পাশে উঠেছিল। পরে আজ ওয়েস্ট ওয়াকওয়ে ধরে পশ্চিম দিকে বা ডান দিকে গেলাম। নতুন আবিষ্কারের আনন্দে অজানা ওয়াকওয়ে দিয়ে আগের হাঁটার শেষ সীমা পার হলাম। ওয়াকওয়ের ডানে ও বামে গভীর বনভূমি। বাম দিকে বনভূমির ফাঁক মাঝে মাঝে সোয়ান নদীর পার ও পানি দেখা যায়। ডান দিকে বনভূমির উপরে পাহাড়ের উপরে বাড়ী ঘর ও দালান কোঠা দেখা যায় মাঝে মাঝে বনের ফাঁকে ফাঁকে। ওয়াকওয়ে দিয়ে কিছুদূর যাবার পর হাতের ডানে পিচ ঢালা একটা কার পার্কের মতো দেখলাম বনভূমির ডান পাশে। জানিনা এটা এখানে কেন রেখেছে। অনেক গাড়ী সেখানে পার্ক করা। এক জায়গায় হাতের বাম পাশে সোয়ান নদীর পারে ছোট ছোট দুটো কাঠের জেটি দেখলাম। সেখানে যেয়ে কিছুক্ষণ বসে নদীর শোভা উপভোগ করলাম। মনে তখন একটা কবিতার পঙক্তি ঘুরপাক খাচ্ছে। এক জায়গায় দেখলাম কালকের বৃষ্টির সঙ্গী ঝড়ো হাওয়ায় পাশের বনভূমির একটা গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে। এক জায়গায় ডান পাশে সুন্দর সবুজ চত্বর ও তার ডান পাশে উঁচু পাহাড়ে সুন্দর ঘরবাড়ী দালান দেখলাম।
ক্রমে ক্রমে ওয়াকওয়ের দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ৩/৪ কি মি যাওয়ার পর একটা কাঠের ব্রিজ পার হয়ে সিটি অফ ভিনসেণ্টে এর সাইন বোর্ড দেখলাম। এই সিটি মূলতঃ পাহাড়ের উপর হাতের ডান দিকে। নদী যেদিকে তার উলটো দিকে। সেখানে সুন্দর একটা পার্ক হাতের বাম দিকে রাস্তা ঘেঁষে। তার আগে একটা বার্ব-বি-কিউ করার জায়গা ও রেস্টুরেন্টের মতো হাতের ডান দিকে পড়েছিল। পার্কের পরে ওয়েস্টার্ন সাব ষ্টেশন নামের একটা বৈদ্যুতিক পাওয়ার ষ্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ফিরলাম। ডান দিকে মানে ওয়াকওয়ে ধরে চললে একটা ব্রিজ এসে পড়বে সোয়ান নদীর উপরে। হয়তো সেটা ২/৩ কি মি দূরে হতে পারে। সেটা আর একদিন আবিষ্কার করব। যাহোক, খুব ভাল লাগল আজ এই রোদেলা দিনে ওয়াকওয়ে দিয়ে হেঁটে। সেখান থেকে ফিরে সিটি অফ ভিনসেন্টের আগের সেই পার্কের কাছে এক বেঞ্চে বসে আজকের রোদেলা দিনের অনুভূতি নিয়ে কবিতা "বৃষ্টি-মুখর দিনের পরে"এর প্রথম কয়েকটা পঙক্তি লিখলাম। এটারই প্রথম পঙক্তি এতক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাসায় এসে কবিতা শেষ করলাম ও বুয়েটের সতীর্থদের সাথে "বন্ধন-৬৯"ফোরামে শেয়ার করলাম। বাসায় ফিরলাম মোট এক ঘণ্টা বিশ মিনিট হেঁটে। (চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |