পার্থের চিঠি (৯ম পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
সাউথ পার্ক ফোর শোর(South Park Fore Shore) দর্শনঃ
১২ মে, মঙ্গলবার। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক বাবলীর পায়ের ব্যথার জন্য তার পায়ের রেস্ট বা বিশ্রাম। তাই আমি মিতির সাথে যেয়ে আনিসাকে তার চাইল্ড কেয়ারে রেখে এলাম আমার নাম সাইন করে। চাইল্ড কেয়ারের সামনের রাস্তা থেকে মিতি বিদায় নিয়ে তার ট্রেন ধরতে চলে গেল। আমি আনিসাকে নিয়ে রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে উঠে তার চাইল্ড কেয়ারে নিয়ে বাকী সব কিছু করে বাসায় ফিরলাম। আজ বিকেলে তানভীর আনিসাকে চাইল্ড কেয়ার থেকে নিয়ে এলো।
সন্ধ্যার পরে মিতিকে পড়াশোনার সুযোগ দেয়ার জন্য যাতে আনিসা তাকে বিরক্ত না করে সে জন্য তানভীর আনিসাকে নিয়ে আমাদেরকে এখানকার দর্শনীয় সাউথ পার্ক ফ্রন্ট শোরে নিয়ে এলো। অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম না নিয়ে মিতিকে পড়াশোনার সুযোগ দেয়ার জন্য জামাই তানভীরের এই সহযোগিতা ও কষ্ট স্বীকার অসাধারণ। বাসা থেকে গাড়ীতে যাত্রা করে ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে সেই পার্কে পৌঁছে গেলাম আমরা। এই পার্ক সোয়ান নদীর পারে। খুব চমৎকার পার্ক। খুব সুন্দর ও শান্তিময়। নদীর পার কংক্রিটে বাধাই করা। তার পাশে সবুজ ঘাসের পার্ক। একটু দূর দিয়ে নদীর পারের সমান্তরাল পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা আছে। মাঝে মাঝে বসবার জন্য নদীর পারের কাছাকাছি বেঞ্চি পাতা আছে। মাঝে মাঝে মাঝারি সাইজের গাছ আছে। পার্কটা সোয়ান নদীর একটা খাড়ির মতো অংশের তিন ধারে গড়ে তোলা হয়েছে। তিন ধারের দৈর্ঘ্য এক মাইলের মতো হবে। সী-বীচের মত পানি যেখানে মাটি স্পর্শ করেছে সেখানে সামান্য চওড়া বালুকাময় পারের মত। তার পাশে চওড়া ঘাসের পার। খুবই শান্তিময় পরিবেশ। আমরা অটামের শীতের রাতে গেছিলাম। শীত খোলা জায়গায় বসে কাটানোর জন্য স্বস্তিকর ছিল না। বসন্ত আর গ্রীষ্মের দিনে গেলে এই প্রশান্তিময় পার্কের ঘাসের সবুজ পার আর পানি দেখে আরো ভাল লাগত। সারাদিন শান্তিতে কাটানো যেতো। তবু এই পার্কের শান্ত সৌন্দর্য মনে প্রশান্তি এনে দিল।
আনিসা কান্নাকাটি করছিল। তাই তানভীর তাকে নিয়ে গাড়ীর কাছে গেল। আধো আলো আধো অন্ধকার পার্ক। মানে সেখানে উজ্জ্বল আলো ছিল না। তবে রাত্রি থাকায় এই পার্কের আরেক শোভা দেখা যাচ্ছিল। সেটা হল রাতের সোয়ান নদী আর দূরে সিবিডির (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট বা মেইন টাউনের বা ডাউন টাউনের)বিভিন্ন রংয়ে আলোকিত দালানগুলো। সেটাও মনোমুগ্ধকর। এই বিল্ডিংগুলোর মধ্যে পার্থের যে তিনটা আইকন টিভি নিউজের সময় দেখায় সেই তিনটা বিল্ডিংও সুন্দর আলোকিত অবস্থায় দেখলাম। পরে জেনেছি এই বিল্ডিং তিনটির সবার ডান দিকেরটা Bank West (ব্যাংক ওয়েস্ট), মাঝেরটার উপর লেখা AMP (এটা একটা ফাইন্যান্সিং এজেন্সির নাম, এ ছাড়া অন্য কর্পোরেট অফিস এই বিল্ডিং'য়ে আছে), এর পরের মানে সর্ববামের বিল্ডিংয়ের উপর লেখা South32, এটাতেও বিভিন্ন কর্পোরেট অফিস আছে যার অন্যতম ঐ সাউথ থার্টিটু। এই পার্কে যদিও আমাদের বাংলাদেশের মত রাতের অন্ধকারে কোন সন্ত্রাসীর আক্রমণের সম্ভাবনা নেই, তবু রাতের বেলা আধো আলো আধো অন্ধকার জনবিরল পার্কে অবস্থান করতে আমরা অভ্যস্ত নই। কাজেই কিছুটা অস্বস্তি বোধও কাজ করছিল মনের গহীনে। তবু উপভোগ করলাম এই প্রশান্তি ও সৌন্দর্য। পরে ফিরে আসলাম আমাদের গাড়ীর কাছে এক সুন্দর প্রশান্তিয় স্থান দেখার স্মৃতি নিয়ে।
ইয়াহু একাউন্টে যেতে অলঙ্ঘনীয় বাধাঃ
এখানে পৌঁছোবার পরই যেদিন প্রথম ল্যাপটপ পেলাম সেদিনই চেষ্টা করলাম আমার বাংলাদেশের ইয়াহুর পুরনো একাউন্টে প্রবেশ করতে। আমার সঠিক পাশ ওয়ার্ড ব্যবহার করলাম। কিন্তু অতিরিক্ত সিকিউরিটি সচেতন ইয়াহু, এই নতুন লোকেশন থেকে আমাকে তো আগে ইয়াহুতে এক্সেস বা প্রবেশ করতে দেখেনি, এই কারণে নিশ্চিত হবার জন্য আমার পরীক্ষা নিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, Who is your oldest cousin?(আপনার সর্বজ্যেষ্ঠ কাজিন কে?)। এখন সেই ২০১০ সালে ইয়াহু একাউন্ট খোলার সময় আমার ইন্টারনেট প্রভাইডার আমার মত নিয়ে কিংবা না নিয়ে কার নাম দিয়েছিলো সেটা এতদিন কি আর সঠিক মনে আছে? আমি আমার জীবিত বয়োজ্যেষ্ঠ খালাত ভাইয়ের নাম দিলাম। সেটা ইয়াহু গ্রহণ করল না। আমাকে ১২ ঘণ্টার জন্য লক আউট করল। পরের দিন আমার জীবিত ও মৃত খালাত ভাইবোনদের সবার বড় খালাত ভাইয়ের নাম দিলাম। সেটা ইয়াহু গ্রহণ করল না। আবার ১২ ঘণ্টার জন্য আমাকে লক আউট করল। মানে আমি ইয়াহু একাউন্টে ঢুকতে পারলাম না। আমার প্রথম দিকের কবিতাবলি এবং কিছু ভ্রমণ কাহিনী ঐ ইয়াহু একাউন্টে ছিল।
সেদিন এ নিয়ে আমার ছেলে ইমনের সাথে সিডনীতে কথা বললাম। সে সিডনীতে ইয়াহুর আইডি সিকিউরিটির অফিসারের সাথে কথা বলে একটা টেলিফোন নাম্বার আমাকে দিল। আমি সেই নাম্বারে ৭ মে ২০১৫ বৃহস্পতিবার সর্বপ্রথম কথা বললাম। সেও (সেই ভদ্রমহিলা)আমার সমস্যার কথা মানে আমার পুরনো ইয়াহু আইডিতে প্রবেশ করতে চাই শুনে তাদের পদ্ধতির দোহাই দিয়ে আমাকে একই গদ বাধা প্রশ্ন করলেন, Who is your oldest cousin?। আজ আমি সেই জীবিত ও মৃত সবার বড় খালাত কাজিনের নাম বললাম। কিন্তু সেই উত্তর ইয়াহু গ্রহণ করল না। আমাকে ২৪ ঘণ্টার জন্য লক আউট করল। তবে সে আমাকে আমার একটা কেস নং দিল। পরে যোগাযোগের সময় এই কেস নং উল্লেখ করতে হবে। এই ইয়াহু একাউন্টে প্রবেশের সংকট নিয়ে কবিতা লিখলাম "ঘরের চাবি কি পরের হাতে"। এই কবিতা আমি মেল্যান্ডস ইয়ট ক্লাবের সবুজ চত্বরে সোয়ান নদীর পারে বসে লিখেছি। সেই কবিতা বন্ধন ফোরামে আমি পোষ্ট করলাম। পরে এই নিয়ে আরো যোগাযোগ করেছি সেই অফিসারের সাথে সিডনিতে। তাকে আমি আমার আব্বার চাচাত ভাইয়ের এক ছেলে যিনি ৯০ বছরের পরে মারা গেছেন তার নাম বললাম। সেই উত্তর ইয়াহু গ্রহণ করল না। আমাকে আবার ২৪ ঘণ্টার লক আউট করল। পরে আবার যোগাযোগ করে আমি এক ফুফাতো ভাইয়ের নাম বললাম যিনি বয়সে আমার আব্বারও বড় ছিলেন। উনি আমার বড় আপার বড় ছেলে ছিলেন। কিন্তু এই উত্তরও ইয়াহু গ্রহণ করল না।
এই সংকট এখনও রয়ে গেছে। আমি ইয়াহু'তে আমার পুরনো একাউন্টে আর প্রবেশ করতে পারিনি। জানিনা বাংলাদেশে ফিরেও তাতে প্রবেশ করতে পারব কি না। এই সমস্যা এবার নতুন করে হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালে যখন সিডনীতে পৌঁছেছিলাম সেবার প্রথম প্রচেষ্টায় কোন পরীক্ষার সম্মুখীন না হয়ে আমার এই ইয়াহু একাউন্টে প্রবেশ করতে পেরেছি।
সোয়ান নদীর পারে সিসিম ফাঁকঃ
১৩ মে ২০১৫, বুধবার। আজ সকালে আমি মিতির সাথে বের হলাম। আনিসাকে দুজনে তার চাইল্ড কেয়ারে রেখে আসলাম। মিতি আজ ছুটি নিয়েছে পড়াশোনার জন্য। ফিরে নাস্তা করলাম। পরে হাঁটতে গেলাম একা। আজ অনেক আবিষ্কার করলাম। প্রথমে পেনিনসুলা রোড ধরে বাম দিকে মানে পশ্চিম দিকে ম্যাপল লীফ রাউন্ডএবাউট পার হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে হাঁটলাম। সোজা গিলফোর্ড রোড পর্যন্ত গেলাম। বাম দিকে গিলফোর্ড ধরে সামান্য কিছুদূর গেলাম। ফিরে এলাম একই পথে। পরে সোয়ান নদীর পারে মেল্যান্ডস ইয়ট ক্লাবে গেলাম। সেটা পার হয়ে পশ্চিমের ওয়াকওয়ে দিয়ে কিছুদূর যেয়ে তার পাশে পাহাড়ের উপরের সেই পার্কে মানে আমাদের হিলটপ পার্কে গেলাম। সবুজ একটা ৫০/৬০ ফিট উঁচু টিলার উপরে এই পার্ক। এই পার্কে বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছু বাচ্চা খেলাধুলা করছে। তাদের মায়েরা পাশে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে। এই সব খেলাধুলার ব্যবস্থার মধ্যে একটা টারজান সুইংয়ের মত, একটা ভূমি সমান্তরাল তারের উপরে যেটা স্লাইড করে। পরে দেখছি পাশে একটা ছোট্ট ট্রি হাউজের মত আছে পার্কের এক পাশে। এক পাশে মাটিতে কচ্ছপ জিরাফ ডাইনোসরের সব মূর্তি আছে। এই পার্কের পাশে একটু উঁচুতে একটা বড় সবুজ মাঠ। মাঠের সবুজ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পরে পাহাড় থেকে নেমে আবার পাশের পশ্চিমের ওয়াকওয়ে দিয়ে বহুদূর গেলাম আগের বারে যতটুকু গিয়েছিলাম সেই সীমানা ছাড়িয়ে। রাস্তা ক্রমে গভীর বনভূমির মাঝে রহস্যজনক হয়ে যায়। আবার ফিরে এলাম। হিলটপ পার্কের পাহাড়ের নীচে ওয়াকওয়ের পাশে একটা রহস্যময় টয়লেট দেখলাম; প্রাচীন এম এস ডাব্লিউ লেখা ছোট একতালা দালানে। সেটার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ দেখলাম। ঠেলেও কাজ হল না। একটা রহস্যময় আলো জ্বলছে নিভছে। পরে দেখলাম দরজা খোলার জন্য বাটন আছে। বাটন টিপলাম। আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পের মত "সিসিম ফাঁক" হল। দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকলাম। আবার দরজা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল। তখন ইংরেজিতে ঘোষণা শুনলাম, "দরজা খোলার জন্য বাটন টিপবেন। বের হয়ে গেলে টয়লেট নিজে নিজে ফ্লাশ হয়ে যাবে। ১০ মিনিটের বেশী থাকবেন না"। ঠিক মত বের হতে পারব, নাকি ভিতরে আটকা পড়ে যাব, এই টেনশন ভুগলাম পুরো সময়টা। পরে বাটন টিপে বের হয়ে মুক্তির আনন্দ পেলাম।(চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |