পার্থের চিঠি (৬ষ্ঠ পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
পার্থের প্রথম জুম্মার নামাজঃ
ক্যাটালিনো নামের মাছের দোকান থেকে সরাসরি বাসায় ফিরে জুম্মার নামাজের জন্য প্রস্তুত হলাম। আগেই গোছল করে বের হয়েছিলাম। তানভীর হাতের দু একটা জরুরী কাজ সারল। মিতি তাড়া দিচ্ছিল গোছল সেরে নেবার জন্য। কিন্তু তানভীর তাকে জানালো সে ১টা ৪০ মিনিটে যাত্রা করবে। বাসা থেকে সেখানে গাড়ীতে করে যেতে ৫ মিনিটও লাগবে না। যাহোক, আমরা ২টার আগে সেখানে পৌঁছলাম।
বাসা থাকে যাত্রা করে ম্যাপল লীফের মোড় থেকে ডান দিকে গেলাম আনিসার চাইল্ড কেয়ারে যাবার সময় যে দিকে যাই। আমরা সোজাসুজি চলে চাইল্ড কেয়ারের সেভেন্থ এভিনিউয়ের মোড় পার হয়ে পরে ক্রমে এইটথ এভেনিউ, নাইন্থ এভিনিউ পার হয়ে ফালকির্ক এভিনিউয়ে প্রবেশ করলাম বায়ে টার্ন নিয়ে। তার শেষ মাথায়ই হাতের বামে সেই অস্থায়ী মসজিদ। সামনে লেখা মেল্যান্ডস ইসলামিক সেন্টার। ২০০৫ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার প্লেজেন্টনে গিয়ে দেখছি তাদের ঐ ভাড়া করা যায়গায় অস্থায়ী মসজিদের নামও ছিল প্লেজেন্টন ডাবলিন ইসলামিক সেন্টার। এটা মেল্যান্ডস শপিং সেন্টারে দোতালায়। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে মসজিদে প্রবেশ করলাম। দরজার সামনে একটা র্যাাকে জুতা রাখার ব্যবস্থা। সেটা ভরে যাওয়ায় নীচেও জুতা রাখা হয়েছে দেখলাম। যাহোক, মসজিদের সেই রুম মুসল্লিতে প্রায় ভর্তি ছিল। কোন রকমে আমি আর তানভীর জায়গা করে বসলাম। মসজিদের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। ইমাম সাহেব চোস্ত অস্ট্রেলিয়ান একসেন্টে ইংরেজিতে বয়ান দিচ্ছিলেন। পরে জেনেছি ইমাম সাহেবের আদি বাড়ী ইরিত্রিয়ায়। তার নাম সালেহ ইব্রাহিম। বয়ান শেষ হলে আজান হল। মানে সুন্নত পড়বার জন্য বাংলাদেশের মত আলাদা করে কোন সময় দেয়া হল না মুসল্লিদেরকে। তারপর আরবিতে খুতবা মনে হয় হল কিংবা সরাসরি জুম্মার ফরজ নামাজের জামাত শুরু হল। তখন দুপুর ২টা ২০মিনিট। নামাজ শেষে অধিকাংশ মুসল্লি সুন্নত নামাজ না পড়ে চলে গেলেন। সুন্নত মসজিদে কিংবা কোথাও না পড়বার বা আদায় করবার সৌদি আরবের নতুন অভ্যাসের প্রভাব খুব প্রবল এখানে দেখলাম। মুসল্লিরা বিভিন্ন দেশের মনে হল। বিদেশী কারো সাথে আজ প্রথম দিন আলাপের সুযোগ হল না, শুধু তানভীর নীচ তলায় বাংলাদেশী একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। যে রুমটাতে এই নামাজ পড়লাম সেটা ছোট আয়তনের। সামনে এক পাশে আবার কোনাচে আকারে, আয়তাকার নয়, যদিও এর পাশের সংলগ্ন অংশ (মানে মাঝে পার্টিশন বা দেয়াল নেই, একই রুম) আয়তাকার। ইমাম সাহেব সেখানেই দাঁড়িয়ে বয়ান দিচ্ছিলেন ও পরে জামাতের নামাজ পড়ালেন। জুম্মার জামাতের পর আমি বাংলাদেশের মত সুন্নত ও নফল পড়লাম। প্রথমে জুম্মার পরের বাদ আল জুমা ও সুন্নাতুল ওয়াক্ত পড়ে জুম্মার আগের কাবলুল জুমা ও পরে নফল। নামাজ পড়ে দরজার বাইরে আসলাম। সেখানে মসজিদের জন্য ডোনেশনের বা সাদকা বা দানের বাক্স পেলাম। ৫০ সেন্টের কয়েন দান করলাম। পরে নীচে নেমে দেখলাম তানভীর সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। পরে দেখেছি দোতালায় একই সাইজের ছোট ছোট আরো ৪টা কামরায় নামাজ পড়া হয়। ৬ষ্ঠ কামরায় ইসলামিক সেন্টারের অফিস ও ধর্মীয় পুস্তকের লাইব্রেরী। এই মসজিদে আমাদের বাসা থেকে হেঁটে গেলেও ১০ মিনিটে পৌঁছা যায়, পরে দেখছি। যাহোক, তানভীর সেখানে নীচ তলায় আমার সাথে আমার মেয়ে মিতির বাংলাদেশের বাজিতপুরের জহিরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসমেট এমিলির স্বামীর বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এই প্রথম বাংলাদেশী যার সাথে পার্থে এসে দেখা হল মিতিদের ছাড়া। খুব ভাল লাগল। পার্থে প্রথম জুম্মায় অন্য মুসলমানদের সাথে দেখা হওয়ায় ও জুম্মার নামাজ পড়তে পারায় খুব আনন্দ হল। আজ নামাজ শেষে তানভীরসহ সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলাম। খুব আনন্দ হল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম।
পার্থে প্রথম দাওয়াতঃ
বিকেলে আনিসাকে তানভীর নিয়ে এলো তার চাইল্ড কেয়ার থেকে। আমরা মাগরিবের নামাজের পর চটপট তৈরই হয়ে নিলাম। মনোয়ার-আবিদাদের বাসায় দাওয়াতে যাব। এটা একটা অসাধারণ দাওয়াত। কারণ স্বামী মনোয়ার আমার ছেলে ইমনের বন্ধু। আমরা যখন সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম আর ইমন ছুটিতে পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে সৈয়দ পুরে আসত তখন সেখানেই তাদের দেখা আর আলাপ পরিচয় ও বন্ধুত্ব। আর স্ত্রী বা গৃহিণী আবিদা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মিতির সাথে শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল ও কলেজের স্কুল লেভেল থেকে ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। কাজেই আমরা একান্ত আপনজনদের বাসায় বেড়াবার মত আনন্দ পেলাম।
বাসা থেকে বের হয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা মনোয়ার-আবিদাদের বাসায় পৌঁছে গেলাম। মনোয়ার ও আবিদা আমাদেরকে সাদরে রিসিভ করল। আমি পুত্র ইমনের বন্ধু মনোয়ারকে স্নেহ ভারে আলিঙ্গন করলাম। অনেক আন্তরিক আলাপ আর গল্প গুজব হল। আমি মনোয়ার আর আবিদাকে আমার লেখা বই "আমেরিকাকে যেমন দেখছি" উপহার দিলাম। তারা খুব খুশী হল এই সামান্য উপহার পেয়ে। মনোয়ার আর আবিদা দুজনে খুব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী। মনোয়ার সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে ফার্স্ট বয় ছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে অনার্স আর মাস্টার্স পড়েছে। আর আবিদা কলেজ থেকে পাশ করে চুয়েটে (চিটাগং ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি)থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। আলাপ করে জানা গেল সে আমাদের সতীর্থ চুয়েটের এককালের শিক্ষক ও পরে ভাইস চ্যান্সেলার ডঃ শ্যামলেন্দু বিশ্বাসের ছাত্রী।
পরে আমরা প্রীতিভোজ খেলাম। বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু সবজী, পরে অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ, চিকেন আর গরুর গোস্তের কারী। খুব মজা করে খেলাম। দেখলাম আনিসাকে মনোয়ার আর আবিদা খুব আদর করে। বিশেষ করে মনোয়ারের সাথে আনিসা খুব মজায় খেলা করে। মিতি তার পুরোনো বান্ধবীর সাথে অনেক আনন্দে গল্প করল বিদেশ বিভূঁইয়ে। আমরাও পার্থে এই প্রথম দাওয়াতে এমন আপনজনদের বাসায় এমন আন্তরিক ব্যবহার, আতিথেয়তা ও ভালবাসার স্পর্শ পেয়ে যারপরনাই আনন্দ পেলাম।
লিলিদের বাসায়ঃ
পরদিন ৯ মে, শনিবার। জামাই তানভীরের সাপ্তাহিক ছুটির ২য় বা শেষ দিন। আমরা দুজনে তানভীরের সাথে আনিকাকে নিয়ে বব-লিলিদের বাসায় গেলাম। আজই আমি আমাদের সর্ব দক্ষিণের বা ৪নং ইউনিটের প্রতিবেশী ববের স্ত্রী লিলিকে প্রথম সামনাসামনি দেখলাম কাছ থেকে। এর আগে তাকে গাড়ীতে করে গেট দিয়ে চলে যেতে কিংবা আসতে দেখেছি দূর থেকে। দেখলাম খুবই হাসিখুশি এই বৃদ্ধা মহিলা। সুন্দরী। অত্যন্ত দীর্ঘকায়, ৬ফিটের বেশী লম্বা। খুবই সদালাপী। অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে আলাপ করলেন আমাদের সাথে। ববও তেমনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আলাপ করলেন। তাদের ছেলে জোরানের সাথে আলাপ পরিচয় হল আজ প্রথম। অত্যন্ত দীর্ঘদেহী, সাত ফিটের মত লম্বা। সে এখানে পি এইচ ডি করছেন। পি এইচডি'র বিষয় সাবেক যুগোস্লাভিয়া সংক্রান্ত।
আমি তাদের আদি নিবাস যুগোস্লাভিয়ার (তাদের আদি-নিবাস ছিল যুগোস্লাভিয়ার সার্বিয়ায়) বিখ্যাত নেতা মার্শাল টিটোর প্রশংসা করায় তারা সবিনয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেন। কেমন করে এই কমিউনিস্ট নেতা জনসাধারণের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে খর্ব করেছেন জনগণের নামে এবং ভণ্ডামির দ্বারা পৃথিবীকে বিভ্রান্ত করেছেন সেটা তুলে ধরলেন। বোঝা গেল এই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হওয়ায় তারা আজ থেকে ৪০ বছরেরও আগে যুগোস্লাভিয়া ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়াতে চলে এসেছে। জোরানের জন্ম অস্ট্রেলিয়াতে। সে এখনও অবিবাহিত। বয়স ৩০ পার হয়েছে।
লিলি আমাদেরকে যুগোস্লাভিয়ার বিখ্যাত তুর্কী কফি আর বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। এই তুর্কী কফি অটোম্যানদের দ্বারা বলকান উপদ্বীপ তথা যুগোস্লাভিয়া শাসনের চিহ্ন ও ঐতিহ্য। কফি আর লিলির আতিথেয়তা খুব ভাল লাগল। পরে লিলিদের অত্যন্ত সমৃদ্ধ পারিবারিক লাইব্রেরী দেখলাম। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার পুরো সেট সেখানে আছে দেখলাম। যুগোস্লাভিয়ার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপর খুব সুন্দর একটা বই দেখলাম। পরে বইটা লিলির কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়বার ইচ্ছা জেগে রইল। লাইব্রেরী দেখে খুব আনন্দিত হলাম।
পরে লিলির সখের অত্যন্ত সুন্দর ফুল ও ফলের বাগান দেখলাম। বাগানে বড় বড় গোলাপ বাগান আলো করে আছে। আারো কত নাম না জানা ফুল আর পাতাবাহার চারার গাছ। আর কমলা (মানে মাল্টা) ও লেবু গাছগুলো ফলে ফলে ভরা দেখলাম। এ সব দেখে খুব ভাল লাগল। লিলিরা আমাদেরকে অত্যন্ত আন্তরিক বিদায় জানাল। বিদায়ের আগে লিলি তার বাগানের খুব বড় ও দুর্লভ সুগন্ধ ভরা লাল দুটি গোলাপ, দুটি খয়েরী রংয়ের পাতার ও একটি সবুজ রংয়ের ডেকোরেটিভ পাতার চারা উপহার দিল। অনেক আনন্দ নিয়ে আমরা আমাদের এই সুন্দর প্রতিবেশীদের বাসা থেকে ফিরলাম।
রাতে আমরা মিতির এখানকার হসপিটালের বাংলাদেশী ডাক্তার ও বান্ধবী মৌসুমি ও তার স্বামী ঢাকার আইইউটি'র পাশকরা ইঞ্জিনিয়ার সুজোর বাসায় দাওয়াতে গেলাম। সেখানে অনেক ইঞ্জিনিয়ার আর কয়েকজন ডাক্তারের সাথে আলাপ পরিচয় হল। তার বিস্তারিত পরের পর্বে লেখার আশা রাখি। (চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |