পার্থের চিঠি (৫ম পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
আমাদের প্রতিবেশীরাঃ
আজ ৮ মে। আগের দিন বৃহস্পতিবার সকালে আনিসাকে আমি আর বাবলী মিতির সাথের বের হয়ে তার চাইল্ড কেয়ারে দিয়ে এসেছি। মিতি চাইল্ড কেয়ারের সামনের রাস্তা পর্য্যন্ত আমাদের সাথে গেল। তারপর সে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে তার ট্রেন ধরতে রেল ষ্টেশনের দিকে পা বাড়াল।আজকে শুক্রবার। আজ জামাই তানভীরের সাপ্তাহিক ছুটির প্রথম দিন। সে-ই সকালে আনিসাকে চাইল্ড কেয়ারে দিয়ে এলো তার গাড়ীতে করে।
আমি আর বাবলী সকালে নাস্তা করলাম। মিতি ও তানভীর তাদের সময়ে নাস্তা করল। পরে মিতি পড়তে বসল তার ষ্টাডি রুমে। তানভীর আমাদেরকে নিয়ে প্রতিবেশী লিলি আর ববের বাসায় বেড়াতে গেল।আজ বব, তার স্ত্রী লিলি আর ছেলে জোরান সবাই বাসায় ছিলেন। বব আর লিলি আমাদেরকে সাদরে রিসিভ করলেন।
এই বাসা মানে পেনিনসুলা রোড বাড়ী নং ১৫৭ বিল্ডিং কমপ্লেক্সে আঙ্গিনার ভিতরে মোট চারটা বাসা। সামনে ১নং ইউনিটে থাকেন শীলা নামের এক বিধবা বৃদ্ধা ডাক্তার একা। তার বাসার মেইন গেট বা দরজা রাস্তার দিকে আমাদের কমপ্লেক্সের সদর দরজার বাইরে। তার কোন গাড়ী নেই যদিও আমাদের বাসার দরজা দিয়ে বের হলেই তার আর তানভীরের গ্যারেজ। তার সাথে তার পিছনের দরজা।তার বাসায় ঢুকতে হলে তাকে কমপ্লেক্সের সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে হয় না।
শীলা বয়সে আমাদের চেয়ে বড়। বয়স সম্ভবতঃ আশি ছুঁই ছুঁই। শীলার স্বামী মারা গেছেন। ছেলেমেয়েরা সব অনেক বড়। তারা তাদের সংসার নিয়ে আলাদা শহর বা বাসায় আছে। শীলা এখন ডাক্তারী থেকে অবসর নিয়ে শিক্ষকতা করেন।তাকে প্রথম সপ্তাহে দেখিনি। সম্ভবতঃ আমরা এখানে আসবার কয়েক দিন পরে ৯ মে তারিখে তানভীর আমাদেরকে একটা চিরকুট দেখাল আর বললঃ দেখেন আব্বা, কত ভাল নেইবার। চিরকুটটি শীলার হাতে লেখা ছিল। ইংরেজীতে লিখেছিলেনঃ "১০তারিখ থেকে২০ তারিখ পর্য্যন্ত বাইরে থাকব। এই সময় যদি তোমরা কোন অচেনা লোককে আমার বাগানে কাজ করতে দেখ, বুঝবে সে হচ্ছে আমার বন্ধু জর্জ। বাসায় কোন অসুবিধা হলে জর্জকে জানিও।" এই হচ্ছে এখানকার নেইবারদের পরস্পরের প্রতি আর বন্ধুদের প্রতি আস্থা ও নির্ভর করার নমুনা। শীলার সাথে আমাদের দুজনের দেখা হয়েছে অনেক পরে, মাত্র একবার।
আমি আর বাবলী বাইরে থেকে হেঁটে আসছিলাম। মনে হয় আনিসাকে তার চাইল্ড কেয়ারে দিয়ে ফিরছিলাম। তখন দেখি শীলা বাসায় কাছাকাছি মেইন রোডে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তখন তার সাথে আলাপ পরিচয় হল। খুব ভদ্র ব্যবহার এই সুন্দরী দীর্ঘাঙ্গিনী বৃদ্ধা প্রতিবেশীর।
শীলার বাসার পরে আমাদের বাসা, ২নং ইউনিট। সবার বাসার পশ্চিম দিক দিয়ে টানা রাস্তা কমপ্লেক্সের সদর দরজা বা মেইন গেট থেকে সোজা দক্ষিনে ববদের বাসা পর্য্যন্ত চলে গেছে। বব লিলির বাসার সবার শেষে বা সর্বদক্ষিনে। তাদের বাসা ৪নংইউনিট। মাঝে ৩নং ইউনিটে ৩জন ভারতীয় তরুণ ভাড়া থাকে। তারা ভারতের হারিয়ানা রাজ্যের লোক। সবাই হিন্দু। আমাদের দেশের মত অবিবাহিত যুবকদেরকে বাসা ভাড়া দেয়া যাবে না বলে যে অলিখিত নিয়ম বা ট্যাবু আছে সেটা এখানে বাড়ীওয়ালারা মানে না।
তবে তাদের এক সমস্যা আছে। তারা থাকে ৩ জন। কিন্তু তাদের কাছে সদর দরজার রিমোট কন্ট্রোল মাত্র একটা। ছোট দরজার সিকিউরিটি চাবিও মনে হয় সবার কাছে নেই। এজন্য তারা এই কমপ্লেক্সের নিয়ম ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ না করে বাইরে যায় এবং কিছু একটা নিয়ম বহির্ভূত কাজ করে। ফলে বড় দরজা মাঝে মাঝে সম্পূর্ন বন্ধ না হয়ে অল্প একটু খুলে থাকে, যদিও সেটাকে জোর করে পুরো খোলার কোন উপায় নেই। তবু এটা বড় দরজার একটা বিভ্রাট, যা ঐ তরুনদের কীর্তি।
বাসাগুলো পূর্ব পশ্চিমে সমান্তরাল। দুই বাসার মাঝে একজনের গ্যারেজের জায়গা। সব গুলো বাসা একতলা। কেবল বব-লিলিদের বাসা ডুপ্লেক্স, দোতালা।
কিংস পার্ক দর্শনঃ
আজ জামাই তানভীরের সাপ্তাহিক ছুটির ১ম দিন। আজ সকালে আনিসাকে তানভীর তার গাড়ীতে করে তার চাইল্ড কেয়ারে দিয়ে এল। তার কিছু কাজ ছিল এখানকার বিখ্যাত কিংস পার্কের কাছে। চা নাস্তার পরে তানভীর আমাদের দুজনকে প্রস্তুত হতে বলল। একটু পরে আমরা দুজনে বের হলাম জামাই তানভীরের সাথে। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা এখানকার বিখ্যাত কিংস পার্কে পৌঁছে গেলাম। এটার কথা কয়েকদিন আগে বন্ধু মালেক বলেছিল। এটা একটা অসাধারন পার্ক। একালের ব্যাবিলনের উদ্যান আর কি! মাউন্ট এলিজাবেথের উপরে। শহরের সিবিডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিষ্ট্রিক্টের কাছাকাছি। সোয়ান নদীর ধারে। এই পাহাড়িয়া শহরে রাস্তা ধীরে ধীরে মাউন্ট এলিজাবেথের উপরে উঠে যায়। বোঝাই যায় না যে নদীর পার থেকে ৯০/১০০ফিট উপরে উঠে গেছি। উপরে উঠে প্রথমে সবুজ পার্ক দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে পার্কের কিনারে আসলে চোখে পড়ে পাহাড়ের নীচে একদিকে দুইলেইনের করে দুটো ওয়ানওয়ে রোড একটু দূরে। তার পাশে রেল লাইন। এর পাশে পার্থের প্রান ও মাতৃসমা সোয়ান নদী তার সব ঐশ্বর্য্য নিয়ে বয়ে চলেছে। পার্কে বসে পুরো শহর দেখা যায়। পার্কে সবুজ ঘাস, সুন্দর গাছপালা আর সুন্দর প্যাভেলিয়ন। একটা ভেন্টেজ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে সারা শহর খুব সুন্দর দেখা যায়। অসাধারন সে দৃশ্য! সেখানে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখলাম মুগ্ধ হয়ে। এখানে বসে নদী দেখলে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। সেখানে দেয়ালে Serenity বা প্রশান্তি সম্পর্কে সুন্দর একটা উদ্ধৃতি দেখলামঃ " Let the river carry your sorrow away"। সেখানে কিছুক্ষন থেকে পাশে একটা ফলক লেখা জায়গায় গেলাম। সবুজ পার্ক আর পাশে সোয়ান নদী আর পার্থ নগরী দেখে মন আনন্দ ও প্রশান্তিতে ভরে গেল।
তারপর সিড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে গেলাম পার্ক সংলগ্ন এবোরোজিন আর্ট গ্যালারীতে। সেখানে এবোরোজিন বা অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বংশধর আর্টিষ্ট যারা বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত ও মডার্ন আর্টে প্রশিক্ষিত তাদের আধুনিক আর্টের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ করে ট্র্যাডিশনাল আদিবাসী বা এবোরোজিন ধারার শিল্পকর্ম বা চিত্রশিল্প সৃষ্টি করেছে। অসাধারন সে সব ছবি। খুবই আকর্ষনীয়। সেগুলো দেখলাম দুচোখ ভরে। বাবলীর মোবাইলে সেগুলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তোলা হল। সেখানকার কিউরেটর মিচেল রিকেটের সাথে আলাপ হল। তার কাছ থেকে আমরা আদিবাসী আর্টের দুটো পোষ্টার বা রেপ্লিকা কিনলাম ৬ অষ্ট্রেলিয়ান (অঃ)ডলার দিয়ে। এটাই এবারের আমাদের প্রথম কেনাকাটা। আমাদের জামাই এখানে পার্থে ওয়েষ্ট অষ্ট্রেলিয়ায় Krispy Kreme Doughnut 'এর নতুন শাখা খুলেছে জানালে মিচেল জানালেন তার বাচ্চারা এখানকার ক্রিসপী ক্রীমের ডোনাট খেতে খুব পছন্দ করে। এ কথা শুনে আমাদের খুব আনন্দ ও গর্ব হলো।
পার্কের এক বড় বৈশিষ্ট্য এর ১ম ও ২য় মহাযুদ্ধের অষ্ট্রেলিয়ার আত্মদানকারী সৈনিকদের জন্য নির্মিত একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ বা মেমোরিয়াল। সেগুলোর সামনে আমাদের ছবি তুললাম। পরে দেখেছি এই স্মৃতিস্তম্ভের কারনে দূর থেকে এই পার্ক চেনা যায়।
এর আগে জামাই তানভীর তার এ এন জেড ব্যাংকে গেল। আমরা আদিবাসী আর্ট গ্যালারী দেখা শেষ করে উপরে পার্কে উঠবার একটু পরে তানভীর ফিরে এল। তার সাথে সামান্য কিছুক্ষন ১ম ও ২য় মহাযুদ্ধের মেমরিয়ালগুলো দেখলাম। অনেক বড় পার্ক। সবটুকু ভাল করে দেখতে অনেক সময় লাগবে। আজ জুম্মার নামাজ পড়ব। তাই আজ বেশীক্ষন ঘুরে ঘুরে দেখা হল না। তাই মনে অনেক আনন্দ ও অনেক অতৃপ্তি নিয়ে ফিরলাম। আরো এক দুবার এসে এই পার্থের ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান দেখলে মনে তৃপ্তি হবে। এরপর আমরা ফ্রেস মাছের একটা বড় দোকান CATALINO'তে গেলাম। তানভীর স্যামন আর ষ্ট্র্যাপার মাছ কিনল। সেখানে বহু রকমের সামুদ্রিক ও নদীর মাছ পাওয়া যায়। সেখানে প্রকান্ড স্কুইড মাছের ছোট সংস্করন বা জাত আর অক্টোপাস বিক্রির জন্য রাখা আছে দেখলাম। এই স্কুইড মাছ ২০০৮ সালে ১ম বার অষ্ট্রেলিয়াতে এসে খেয়েছি। খেতে চিংড়ি মাছের মত সুস্বাদু।
এইদিনে বাসায় কাছেই মেরিল্যান্ডস শপিং সেন্টারের ইসলামিক সেন্টার নামের ভাড়া করা অস্থায়ী মসজিদে পার্থের প্রথম জুম্মার নামাজ পড়লাম জামাই তানভীরের সাথে। রাতে এক অসাধারন দম্পতি যার স্বামী আমার ছেলের বন্ধু মনোয়ার আর স্ত্রী আমার মেয়ের বান্ধবী আবিদা তাদের বাসায় পার্থের প্রথম দাওয়াত খেলাম আমরা সবাই। এ সব বিস্তারিত পরের পর্বে বলব আশা রাখি।(চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |