পার্থের চিঠি (৪র্থ পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
ইন্ডিজেনাস পাবলিক আর্ট ওয়ার্ক ঝিলঃ
পরের দিন ৬ মে বুধবার। আনিসাকে নিয়ে সকালে মিতির সাথে আমি আর বাবলী বের হলাম। আনিসার চাইল্ড কেয়ারের সামনে এসে মিতি চলে গেলো তার ট্রেন ধরতে। আমরা আনিসাকে চাইল্ড কেয়ারে নিয়ে গেলাম। বাবলী সাইন করলো সেখানে আনিসার হাজিরার তালিকায়। সব বাচ্চাদের সারনেম বা পদবী বা নামের শেষ অংশ আগে, ফার্স্ট নেম পিছনে। আনিসার নাম টডলারদের তালিকায় ৭ নং। আনিসাকে দিয়ে বাসায় ফিরে নাস্তা করলাম বিশাল লেবানীজ চাপাতি (চওড়া বা ব্যাস প্রায় ১২ইঞ্চি হবে) আর সবজী দিয়ে। এই রুটি হাফ কুকড থাকে। এই রুটি খাবারের জন্য প্রস্তুতের কিছু প্রক্রিয়া আমরা অনুসরণ করি। এর একটু গাঢ় পিঠ কলের পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেই। তারপর ওভেনে ২০/৩০ সেকেন্ড গরম করে নেই। চাপাতি সুন্দর নরম ও গরম হয়ে উঠে।
বিকেলে আমি আর বাবলী হাঁটতে বের হলাম সোয়ান নদীর ধারে। আজ প্রথমে নদীর ধারে আগের দিনের মত সেই কাঠের বেঞ্চে দুজনে বসে কিছুক্ষণ নদীর শোভা উপভোগ করলাম। তারপর ইয়ট ক্লাবের সবুজ ঘাসের চত্বরের উপর দিয়ে একেবারে নদীর ধারে গেলাম। সেখানে দু'একজন সৌখিন উৎসাহী মৎস্যশিকারী ফিশিং হুইল নিয়ে মাছ শিকারে বসে গেছে। কেউ আবার নদীর শোভা দেখছে নদীর পাড়ে বসে। তাদের ছাড়িয়ে আরো পশ্চিমে বা বামে এগিয়ে চললাম। সেখানে দেখলাম ডান ধারে একটা মাঝারি আকারের ঝিলের মতো। ঝিল তেমন গভীর মনে হল না। তবে এর ১ফুট খানেক পার পাথরের এবং তাতে এবরোজিন বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের আর্ট আঁকা। এর পাশে একটা স্টিলের পাতের ফলক লাগানো আছে। তাতে ইন্ডেজিনাস পাবলিক আর্ট ওয়ার্ক'এর শুভ উদ্বোধনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানে এই ঝিলের দেয়ালে আঁকা আর্টের নাম ঐ ইন্ডেজিনাস পাবলিক আর্ট ওয়ার্ক। এটা উদ্বোধন করা হয়েছে ২০০৪ সালে। এর পাশ দিয়ে পশ্চিমমুখী ওয়াকওয়ে (যাকে এরপর থেকে ওয়েস্ট ওয়াকওয়ে বলব) চলে গেছে।
লালচে পাথরের ওয়াকওয়ের মাঝ বরাবর সাদা দাগ কাটা আছে। মানে প্রত্যেক অর্ধেক ওয়ানওয়ে ওয়ানওয়ে, পথচারী বা সাইক্লিষ্টকে নিজের বাম দিক ধরে চলতে হবে। সাদা দাগের অন্য অংশ দিয়ে বিপরীত দিকের পথচারী বা সাইক্লিষ্ট চলাচল করবে। এতে কোন গাড়ী চলার অনুমতি নেই।
ওয়াকওয়ের বাম দিকে একটা পাথরের কাছিমের মুখের চেহারার নল দিয়ে পানি কোন অদৃশ্য উৎস থেকে চুইয়ে ঐ ঝিলে পড়ছে। পরে ঝিল থেকে ঝিলের উলটো দিকে একটা পাথরের সরু চ্যানেল বেয়ে দূরে সেই পানি আরেকটা জায়গায় ঝরনার আকারে জলাভূমি বা ওয়েট ল্যান্ডে পড়ছে। ঝিলের কাছেই একটা পার্ক। সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য স্লাইডসহ অন্য খেলাধুলার সামগ্রী ফিট করা আছে। আমরা এ সব দেখে পার্কের পাশে একেবারে নদীর ধারে চলে গেলাম। সেখানে নদীর কলকল ধ্বনি বা ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি শুনলাম। শুনতে খুব মধুর লাগলো।
ওয়াকওয়ে দিয়ে সেই বিকেলে বেশ কিছু সাইক্লিষ্ট আর পথচারী যাচ্ছে আসছে। পরে দেখেছি এই ওয়াকওয়ে মানে ইষ্ট ওয়াকওয়ে আর ওয়েস্ট ওয়াকওয়ে যতক্ষণ দিনের আলো থাকে ততক্ষণই সাইক্লিষ্টদের সাইকেল চারণায় ও ওয়াকারদের পদচারনায় মুখর থাকে। নদীর ধারে আর এই ঝিলের চারপাশে এবং ওয়াক ওয়ের পাশে অনেক সাদা রংয়ের লম্বা বাঁকা ঠোঁটের আইবিস পাখী আর বুনোহাঁস চরে বেড়ায় নির্ভয়ে। দেখতে খুব ভাল লাগে।আমাদের চোখে স্বপ্নের মত মনে হয়।
সেদিন ফিরবার পথে কাঠের জেটির কাছে আসতেই পাগড়িপরা একজন শিখ সর্দারজী আর একজন শ্যামলা ভদ্রলোকের সাথে দেখা ও আলাপ পরিচয় হল। তারা দুজনেই আমার মতো বয়সী। তারা ভারত থেকে এসেছেন। হরিয়ানা রাজ্যের লোক। তাদের ছেলেমেয়ের কাছে বেড়াতে এসেছেন আমারই মত। বিদেশে পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের লোকজনের সাথে দেখা হলে খুব আপনজনের মতো মনে হয়। বাংলাদেশের লোকজন হলে তো কথাই নেই। ভারত বা পাকিস্তানের লোক হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সাথে আলাপ জমে যায়। হিন্দি বা উর্দুতে আলাপ করতে অনেক সময় স্বচ্ছন্দ মনে হয়। অনেক শব্দের মিল আর ব্যাকরণের মিল এর কারণ হতে পারে। তাদের সাথেও আলাপ জমে গেলো। পরে জেনেছি শিখ সর্দারজীর পুরো নাম সুরজিৎ সিং আর শ্যামলা হিন্দু ভদ্রলোক শার্মাজীর পুরো নাম কাশীপ্রাসাদ শার্মা (কে পি শার্মা)। শার্মাজী এসেছেন এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার ঠিক এক মাস আগে।
ওয়েস্ট ওয়াকওয়ের সাথে প্রথম পরিচয়ঃ
পরের দিন ৭ মে, বৃহস্পতিবার। বিকেলে এই ওয়েস্ট ওয়াকওয়ে দিয়ে আমরা দুজনে প্রথম বারের মতো হাঁটলাম। ওয়াকওয়ের ডান দিকে কাছেই একটা নালার মতো। তার উপর দুই জায়গায় সুন্দর ছোট কাঠের পুল। নালার ভিতর বুনোহাঁস খেলা করে। তার পাশে একটা সবুজ টিলা উঠে গেছে। খুব খাড়া নয়। তবে কিছুটা খাড়া। সবুজ ঘাস থাকায় তা বেয়ে উঠতে কোন অসুবিধা হয় না। তবে মজা লাগে। এই দিন অবশ্য সেটা বেয়ে উঠিনি। পরে উঠেছি। এর উপর একটা পার্ক আছে। এর নাম দিয়েছি পরে হিল টপ পার্ক। এর কথা পরে আলাদা করে বিস্তারিতভাবে বলব।
যাহোক, এই সবুজ টিলার পাদদেশ দিয়ে ঐ ওয়াকওয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। ওয়াকওয়ের বামদিকে বা দক্ষিণ দিকে ওয়েটল্যান্ডের বনভূমি তার পরে সোয়ান নদীর পার। অন্যদিকে মানে ডানদিকে বা উত্তর দিকে ঐ একই বনভূমি তারপর পাহাড় বা টিলা। টিলার উপর বাড়িঘর আছে।
এই ওয়েটল্যান্ড সম্পর্কে কিছু বলা যাক। সোয়ান নদীর মোহনার বা ভারত মহাসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় নদীতে এখানে সুন্দর বনের নদীর মতো দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় ২ বার জোয়ার আর ২ বার ভাটা হয়। সম্ভবতঃ পানিও কিছুটা লোনা। এই লোনা পানি জমে পারে এই জলাভূমি আর তার জঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে সুন্দরবনের মত। প্রথমে সম্ভবতঃ নদীর পারের লাগালাগি চরের মতো হয়। পরে চর জেগে উঠে। সেখানে জলাভূমির সৃষ্টি হয়। জলাভূমির জঙ্গলের সৃষ্টি হয়। সেই বনভূমি বা জংগলে মুলতঃ রীড বা নলখাগড়া বা কাশবনের মতো ঘাস আর ঝাউগাছের মত গাছ, গাম ট্রি বা ইউক্যালিপটাস এবং অন্যান্য নাম না জানা গাছ জন্মেছে। হাল্কা জঙ্গল। মাঝারি বা ঘন জঙ্গল বলা যায় না তাকে। এই জঙ্গলে সাপ আছে বলে ওয়াকওয়ের মাঝে মাঝে সতর্কবাণী দেয়া আছে। ওয়েটল্যান্ড পুরানো হলে জোয়ারের সময় খুব সম্ভবতঃ এটার কেবল নদী সংলগ্ন অংশ নদীর জলে ভিজে। আর ঐ চর নদীর পুরানো পারের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
সেদিন আমরা দুজনে ওয়েষ্ট ওয়াকওয়ে দিয়ে পশ্চিম দিকে বা বামে হাঁটলাম। হিলটপ পার্ক ডানে রেখে আগালাম। এখান থেকে বাম দিকের মানে নদীর দিকের বনভূমি আর ডান দিকের বনভূমি ক্রমে ক্রমে ঘন হয়ে উঠল। ওয়াকওয়ে সাপের মত আঁকাবাঁকা। আমরা আধা কিলোমিটার চলে সন্ধ্যার আগে অজানা বনভূমিতে আর আগানো ঠিক মনে করলাম না। ফিরে এলাম। সাপের ভয়, অজানার ভয়। তবু এই বনভূমির ভিতরে হাটা অনেক থ্রিলিং সন্দেহ নেই। খুব ভাল লেগেছে এই বনপথে ওয়াকওয়ে দিয়ে দুজনের হাঁটা। আস্তে আস্তে এই বনভূমি আরো আবিষ্কার করবো। আগামীতে সে সম্পর্কে লিখবো। (চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |