পার্থের চিঠি (৩য় পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
সোয়ান নদীর সাথে প্রথম পরিচয়ঃ
পরদিন ৫ মে মঙ্গলবার। আজ মিতির হসপিটালের কাজ। সকালে আটটার দিকে আমি আর বাবলী দুজনে মিতির সাথে যেয়ে আনিসাকে তার চাইল্ড কেয়ারে দিয়ে এলাম। মিতি পরে তার হসপিটালে যাবার জন্য ট্রেন ধরতে কাছেই ঐ দিকে রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। আমরা দুজনে বাসায় চলে এলাম। যাবার সময় আগের দিন বানানো নতুন স্পেশাল সিকিউরিটি চাবি ব্যবহার করে এই কমপ্লেক্সের সদর দরজার ছোট দরজা খুলেছিলাম। ফিরবার সময় সেটা কাজ করলো না। তাই রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে দরজা খুললাম। আজ ফিরে দুজনে নাস্তা করলাম। নিজেরা ঠিক করে। বিরাট লেবানীজ ব্রেড বা চাপাতি খেলাম ডিম ভাজি আর সবজী দিয়ে। পরে চা খেলাম।
তারপর দুজনে হাঁটতে গেলাম। দুজনে এই প্রথম বাসা থেকে বের হয়ে বাম দিকে অল্প হেঁটে সেই ম্যাপল লীফ মোড় থেকে আজ বাম দিকে মানে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার নাম ইষ্ট স্ট্রিট। যদিও উত্তর দক্ষিণে লম্বা। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই থার্ড এভিনিউ নামের রাস্তা পার হয়ে রাস্তা ক্রমে উঁচু হয়ে দক্ষিণ দিকে আগালো। কির্খহাম টেরেস নামের রাস্তায় এসে এর সর্বোচ্চ পয়েন্টে এসে পৌঁছতেই হঠাৎ করে সোয়ান নদী উপর থেকে দেখতে পেলাম। কাকচক্ষু সেই নদী। স্নিগ্ধ জলরাশি সকালের রোদে চকচক করছে। সেখান থেকে অনেকটা খাড়া পাহাড়ের মতো রাস্তা নেমে গেছে। প্রায় ৬০/৭০ ফিটের মতো। আমরা আনন্দের সাথে নামলাম। আমাদের চোখের সামনে পার্থের সেই বিখ্যাত সোয়ান নদী। প্রথম দর্শনে আনন্দিত ও মুগ্ধ হলাম। নীচে নেমে প্রথমে দেখলাম এর ডান আর বাম দিকে মানে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ওয়াকওয়ে চলে গেছে। নীচে গাড়ী রাখার জায়গা। ডান পাশে মেল্যান্ডস ইয়ট ক্লাবের দালান। তারপর নদীর সবুজ ঘাসের পার। সেখানে একটা কাঠের চেয়ার। একটু দূরে একটা খেজুর গাছের মতো পাম গাছ। তার সাথেই পাশে নদীর ধারে ওয়েট ল্যান্ডের বনভূমি। এর একটু পিছন থেকে গাড়ী রাখার জায়গার পরে একটা কাঠের জেটি প্রায় ১৫০ফিটের মতো নদীর ভিতর চলে গেছে। কাঠের জেটির শুরুতে দুপাশে ওয়েটল্যান্ড বা জলাভূমির নমুনা রীডের মতো লম্বা ঘাস।আমরা প্রথমে ঐ কাঠের চেয়ারে কিছুক্ষণ বসে নদীর শোভা দেখলাম। সামনে প্রায় আধা কিলোমিটারের মতো চওড়া নদী। পাশের পাম গাছ দেখতে সুন্দর। আমরা দুজনে নদীতীরে দুজনে দুজনের ছবি তুললাম বাবলীর মোবাইলের ক্যামেরায়। তারপর ঐ কাঠের জেটি বেয়ে তার শেষ মাথায় চলে গেলাম। জেটির পাশে কাল রাজহাঁস বা ব্ল্যাক সোয়ান ভেসে বেড়াচ্ছে রাজকীয় ভঙ্গীতে যার নামে এই সোয়ান নদীর নাম। নদীর ওপারে একটু দূরে গাছপালার পরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা স্কাই স্ক্রেপার। এই তিনটা আকাশচুম্বী দালান পার্থের আইকন, পরে জেনেছি। টিভিতে খবর পড়বার সময় খবর পাঠকের পিছে পার্থের আবহ সৃষ্টির জন্য এগুলো পিছনে বা ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখায়। আর নদীর ধার দিয়ে ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটতে গেলে কিংবা শহরে বেড়াতে গেলে এই তিনটা স্কাই স্ক্রেপার সব সময় চোখে পড়ে। আমার প্রাথমিক ধারনা এগুলো ৪০ তলা উঁচু হবে। পরে সঠিক জেনে জানাবো।
নদীর জল বেদানার রসের মতো টলটলে নির্মল স্বচ্ছ। জেটি দিয়ে নদীর ভিতরে আগালে তলা দেখা যায় অনেকদূর পর্যন্ত। নদী এখানে পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহমান। পরে পশ্চিম ও পূর্বদিকে যেয়ে দক্ষিণ দিকে বেঁকে গেছে। জেটি বেয়ে পারে ফিরে এসে ইয়ট ক্লাবের বিল্ডিংয়ের সামনের সবুজ চত্বরে গেলাম। চত্বরের সামনে সেই সুন্দর নদী। চত্বরের ঘাস চোখ জুড়ানো সবুজ এবং সুন্দর সমান করে কাটা। চত্বরে বসে নদীর শোভা উপভোগ করলাম। পরে ঘাসে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লাম। কী শান্তিময় এই নদী আর নদীর পার! সারাদিন বসে থাকলেও মন ভরবে না। জেটির পাশে ছোট্ট চরার মতো। তাতে ব্ল্যাক সোয়ান আর বুনোহাঁস খেলা করছে। এই ব্ল্যাক সোয়ানগুলো আমাদের দেশের রাজহাঁসের মতো বড়। গায়ের রঙ সুন্দর গাঢ় কাল। ঠোঁট টকটকে লাল। সেদিন তিনটা ব্ল্যাক সোয়ান দেখলাম এক সাথে। এরপর আমরা চারটা সর্বাধিক এক সাথে দেখেছি। প্রথম দেখায় সোয়ান নদী দেখে মনে অনেক আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আর খুব খুশী হলাম এ কথা ভেবে এমন সুন্দর নদীতে আমাদের বাসা থেকে ৮ মিনিট হেঁটে দেখতে পাওয়া যায়।
দুপুরে মিতিমনির সাথে আমরা দুজনে বসে দুপুরের খাবার খেলাম ভাত মাছ মাংস ডাল দিয়ে মজা করে। তারপর কিছুটা বিশ্রাম ও দিবানিদ্রা বাংলাদেশের অবসর জীবনের অভ্যাস মতো।
আমার জন্মদিনঃ
আজ আমার জন্মদিন। আজ ৬৮ বছর পূর্ণ হল। সকালে জীবন সঙ্গিনী বাবলী আর মেয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো হ্যাপি বার্থ ডে। ফেসবুক খুলে ফেসবুক ফ্রেন্ডদের ও আমাদের বন্ধন ফোরামের ই-মেইলে বন্ধনের বন্ধুদের জন্মদিনের শুভেচ্ছায় আপ্লুত হলাম। বিকেল নাগাদ জামাই তানভীর অফিস থেকে ফিরে (সে অফিসে গেছে ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা ঘুমে থাকতে) ও ছেলে ইমন সিডনী থেকে হ্যাপি বার্থ ডে জানাল। আজ জন্মদিনে মেয়ে, জামাই আর নাতনীর সাথে থাকতে পেরে খুবই আনন্দিত হলাম। বিকেলে আনিসাকে তার বাবা অফিস থেকে ফিরে গাড়ীতে করে তার চাইল্ড কেয়ার থেকে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যার আগে আনিসা তার ছোট্ট হাতে আমাকে একটা নতুন বই তুলে দিল। তার বাবা ছিল সাথে। কভার খুলে দেখলাম আনিসা তার নানা ভাইকে এই বই উপহার দিয়েছে। বইয়ের নাম Perth's Best Bush, Coast & City Walks. খুব সুন্দর উপহার। তার উপর আদরের হাত দিয়ে পাওয়ায় তার মূল্য অসাধারণ। যারপরনাই খুশী হলাম নাতনীর হাতে এই জন্মদিনের উপহার পেয়ে।
সন্ধ্যার একটু পরে সবাই প্রস্তুত হয়ে বের হলাম আমার জন্মদিনে এদের আনন্দের আয়োজনে। গাড়ীতে করে আমরা ১৫ মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। যাবার পথে সম্ভবতঃ সোয়ান নদী পার হয়ে গেলাম, এই প্রথম বার। এরপরে অবশ্য দেখছি এই শহরে চলতে গেলে এই নদী বারে বারেই পার হতে হয়। রাস্তা ঘাট সিডনীর মতই উন্নত মানের। সিডনীর মতোই রাস্তা মাঝে উঁচু হয়ে যাচ্ছে আর সেই উঁচু থেকে নামছে ৩০/৪০ফিট। আমাদের গন্তব্য ছিল মাকান নামের এক মালয়েশিয়ান রেস্টুরেন্ট। পরে জেনেছি এই রেস্টুরেন্ট মেইন টাউন বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট (সিবিডি) এর কাছাকাছি ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়। খদ্দেরদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার তরুণ তরুণী। কিছু অস্ট্রেলিয়ান তরুণ তরুণীও ছিল। আমরা নাছি শব্দ দিয়ে শুরু একটা খাবারের অর্ডার দিলাম। নাছি পুটি নামে ভাত আর ভাজা মাছের খাবার আমি দেখেছি ২০০২ সালে মদিনা শরীফে হজ্জ্ব উপলক্ষে যেয়ে। যাহোক, খাবার যখন আসলো তখন দেখলাম সেটা চিকেন বিরিয়ানির মত। আমাদের খাবারের ঝাল কিছুটা কম। তানভীরেরটায় ঝাল অনেক বেশী ছিল। আরেকটু হলে তার জন্যও অসহ্য হত। আনিসাকে আমাদের পাশে তার উঁচু আর ছোট্ট চেয়ারে বসানো হলো। সে আমাদের একই খাবার প্লেটে নিয়ে নাড়াচাড়া করে খেলো। তাকে বড়দের মতো ভেবে সে ভাবে তার সাথে ব্যবহার করলে সে খুব খুশী হয়, তানভীর মিতি জানালো। পরে আমরা কোল্ড ড্রিংক খেলাম। খাবার খুব সুস্বাদু ছিল। অনেক গল্পগুজব করে আমরা ডিনার খেলাম। অনেক আনন্দ হলো। আমরা আমাদের ছেলে ইমন আর বউমা ক্রিস্টিনকে খুব মিস করলাম। তারা থাকলে আমাদের আনন্দ আরো অনেক বৃদ্ধি পেত। মেয়ে, জামাই আর নাতনীকে নিয়ে দেশ ছেড়ে বহুদূরে পার্থে এবারের জন্মদিনের আনন্দই ছিল আলাদা। এই জন্মদিনের কথা চিরদিন মনে থাকবে। (চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |