পার্থের চিঠি (২য় পর্ব) বোরহান উদ্দিন আহমদ
আগের অংশ পরের অংশ
আনিসার চাইল্ড কেয়ারঃ পরদিন ৪ মে ২০১৫। পার্থে আমাদের প্রথম পূর্ণ দিবস। আজ মিতি আমাদের সঙ্গে পুরো দিনটা কাটাবে বলে তার হসপিটালের অবজারভার-সিপের অবৈতনিক চাকুরী থেকে ছুটি নিয়েছে। ঘুম ভাঙ্গলো সকাল ৭ টার দিকে। জামাই তানভীর ভোর সাড়ে পাঁচটায় তার কাজে গেছে। ছয়টা থেকে তার কাজ শুরু। মিতি পরোটা ডিম ভাজি করে দিলো। মুর্গীর মাংস দিল। খুব জম্পেশ প্রথম নাস্তা হলো পার্থে। মিতিকে নিয়ে আমরা দুজনে বহুদিন পরে নাস্তা করলাম। চা খেলাম। এরপর মিতি নাতনী আনিসাকে তার চাইল্ড কেয়ারে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতির দূরহ সাধনা শুরু করলো। কারণ এ সময়ে আনিসা নানা বাহানা করে দেরী করিয়ে দেয়। নতুন ডাইপার পেন্ট/পায়জামা জামা শীতের কাপড় পরানো। কিছু নাস্তা করানোর চেষ্টা। মিতির নিজের কাপড় পরা। আনিসার দুধের বোতল পানির বোতলসহ ১/২ সেট কাপড়সহ তার ব্যাগ রেডি করা। অনেক কর্মকাণ্ড। আমরা দুজনে শীতের কাপড়সহ কাপড় চোপড় পরে আগেই তৈরি হয়ে গেছি। মিতি আনিসাকে রেডি করলো। নিজে রেডি হল। আমরা ঘর থেকে বের হলাম আনিসাকে নিয়ে। সঙ্গে তার ব্যাগ।
এবার আনিসাকে তার প্র্যারামবুলেটরে বা প্র্যামে বসানোর পালা। এটা ভাঁজ করে গ্যারেজে রাখা হয়। প্রথমে মিতি আমাদেরকে ভাঁজ করা থেকে প্র্যাম রেডি করার পদ্ধতি দেখালো। কারণ এরপরে অনেক দিনই আমি আর আমার স্ত্রী আনিসাকে তার চাইল্ড কেয়ারে নিয়ে যাবো। আনিসাকে প্র্যামের ষ্ট্র্যাপ দিয়ে আটকিয়ে বসানো হলো যাতে রাস্তায় চলবার সময় সে প্র্যাম থেকে পড়ে না যায়। আমরা দুজনে সে পদ্ধতি দেখলাম।
এবার আমরা এই ১৫৭নং পেনিনসুলা রোড কমপ্লেক্সের সদর দরজার দিকে আগালাম। এটা আমাদের বাসার প্রায় লাগালাগি। গেটের ভিতর ঢুকে আমাদের বাসাই সবার আগে। আমাদের দুজনের কামরার জানালা থেকে ১৫/২০ ফিট দূরে। এই গেট উঁচু লোহার। পাশে এর একটা সরু ছোট অংশ আছে যেখান দিয়ে গাড়ী যেতে পারেনা। মিতি প্রথমে সিকিউরিটি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে গেট খোলার পদ্ধতি দেখালো। গাড়ী নিয়ে ঢুকতে হলে রিমোট কন্ট্রোল ছাড়া উপায় নেই। সিকিউরিটি রিমোট কন্ট্রোল ও ছোট গেটের চাবি কমপ্লেক্সের মালিক প্রত্যেক ভাড়াটেকে একটি করে দিয়েছেন। পরে মিতি সিকিউরিটি চাবি ছোট গেটের সিকিউরিটি লকে লাগিয়ে ঐ গেট খুললো। আমরা আনিসাকে নিয়ে বাইরে আসলাম। পরে বাইরে থেকে ছোট গেট খুলতে হলে কেমন করে গেটের শিক গলিয়ে চাবি ঐ গেটের সিকিউরিটি লকের ভিতরের ফুটোয় কঠিন পদ্ধতিতে ঢুকিয়ে খুলতে হয় সে কঠিন পদ্ধতি দেখালো। যাতে করে একই চাবি দিয়ে এই গেটের লকের বাইরের ফুটোতে লাগিয়ে গেট খোলা যায় সে জন্য পরে বিশেষ সিকিউরিটি চাবি বানিয়ে দিবে আমাদের জন্য, মিতি জানালো।
যাহোক ছোট গেট দিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম আনিসাকে নিয়ে। পাশেই মেইন রোড মানে পেনিনসুলা রোড। আমরা ভাল করে রাস্তার গাড়ী দেখে নিয়ে আমাদের বাসার কাছাকাছি রাস্তা ক্রস করলাম আনিসাকে প্র্যামে নিয়ে। তারপর বামে এগিয়ে চললাম। ২০০ গজ দূরে একটা ম্যাপল গাছের চারপাশ বাঁধানো গোল চক্কর। এরপর থেকে এটাকে আমরা ম্যাপল লীফ গোল চক্কর বা রাউন্ড এবাউট বলব। গোল চক্কর থেকে ডানে ১০০ গজ গেলাম। সেখানে একটা চৌরাস্তা। সেখানে সাবধানে রাস্তার গাড়ী দেখে রাস্তা পার হয়ে রাস্তার বাম ধার ধরে বামে চললাম। এটাই সেভেন্থ এভেনিউ। যার প্রায় শেষ প্রান্তে ৪০০ গজ দূরে রাস্তার অপর পারে মানে ডান দিকে আনিসার চাইল্ড কেয়ার। ঐ বিল্ডিং কমপ্লেক্সের উপর একাডেমী অফ সাইন্স আর তার নীচে টুইশন সেন্টার সাইন বোর্ড দেখা যায়।
এখানে আমরা আনিসাকে তার প্র্যামে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে রাস্তার ডানে গেলাম। রাস্তা থেকে এখানে ঢাল বেয়ে ঐ কমপ্লেক্সের গ্যারেজে উঠলাম। পরে আরো একটা ঢালু সিঁড়ি বেয়ে মূল বিল্ডিংয়ের দোতালা লেভেলে আসলাম। ফটোসেনসেটিভ অটোমেটিক ডোর। আমরা সামনে যেতেই যাদুর মত নিজে নিজেই খুলে গেল। দরজার কাছেই ডান দিকে আনিসার চাইল্ড কেয়ারের মূল দরজা। মিতি কম্বিনেশন সিক্রেট কোড পাঞ্চ করল। পরে দরজার একটা একটা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ধাক্কা দিল। দরজা খুলে গেল। আমরা আনিসাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। এখানে আনিসার প্র্যামের স্ট্র্যাপ খুলে আনিসাকে প্র্যাম থেকে নামানো হলো। তার প্র্যাম মিতি ভাঁজ করে সেখানে রাখলো। আরো কিছু প্র্যাম সেখানে আগে রাখা ছিল। সবার প্র্যাম লাগে না। অনেক মা বাবা বাচ্চাকে গাড়ীতে করে এখানে এনে পরে কোলে করে দিয়ে যায় বাচ্চা আরো ছোট হলে। যাহোক পরে আরো একটা দরজা একই ভাবে একই কম্বিনেশন ব্যবহার করে খুলে আমরা আরো ভিতরে ঢুকলাম। এর সাথে বাম দিকের দরজা দিয়ে ঢুকেই আসল চাইল্ড কেয়ারের দেখা পেলাম। আরো অনেক বাচ্চা ইতিমধ্যে এসে গেছে।
মাঝারি আকারের ঘর। ঝকঝকে তকতকে। মেঝে খুব পরিষ্কার কাঠের। কয়েকটা নিচু টেবিলের চারপাশে মজার খুব নিচু ক্ষুদে চেয়ারে বাচ্চারা বসে আছে আর কাগজে তাদের মহিলা টিচারের বা কেয়ারারের সামনে আঁকিবুঁকি ছবি আঁকছে বা খেলছে। কোন বাচ্চাকে এখনই দিয়ে গেছে। তাকে মহিলা টিচার মমতা ভরে কোলে নিয়ে আছে। দেয়ালে বাচ্চাদের শেখার জন্য রঙ্গিন ছবি। কেয়ারারদের সাথে আমাদের দুজনের পরিচয় হল। এদের একজনের আদি নিবাস ভারতে। একটা নিচু দরজা দিয়ে পাশের রুমে মিতি গেল আর আনিসার ব্যাগ তার জন্য নির্দিষ্ট র্যা কে রাখল। পরে বাচ্চাদের রুমে এসে টডলার বাচ্চাদের একটা তালিকায় আনিসার নামের পাশে এখানে তাকে দিয়ে যাবার সময় লিখে মিতি তার পাশে স্বাক্ষর করল। তারপর আনিসার দিকে না তাকিয়ে আমরা সবাই তাকে চাইল্ড কেয়ারারের কাছে রেখে চলে এলাম। মিতি আগেই আমাদের দুজনকে আনিসার নানা নানী হিসাবে পরিচিত করেছে।
এখানে আনিসার ৮ ঘণ্টা তাদের কেয়ারে থাকবে। তার ডাইপার চেঞ্জ, তাকে খাওয়ানো, খেলার ব্যবস্থা, সব কিছু তারা করবেন। আমরা বাচ্চাদের ঐ রুম থেকে বের হয়ে করিডরের পাশে কিচেন আর তাতে কর্মরত এক ভারতীয় অস্ট্রেলীয় মহিলার দেখা পেলাম। মিতি আমাকে ও আমার স্ত্রীকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম রোখসানা। মহিলা আমাদেরকে সালাম দিলেন। তার আদি বাড়ী ভারতের মুম্বাইয়ে। মিতি তারপর এর কাছাকাছি আমাদেরকে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলার সাথে পরিচিত করল। ইনিই এই চাইল্ড কেয়ারের সিইও বা কর্তাব্যক্তি। আমরা পরে আনিসাকে এখানে নিয়ে আসবো ও এখান থেকে তাকে নিয়ে যাব। তাই নিরাপত্তার কারণে আমাদের আইডি বা পরিচয়ের জন্য মিতির পরামর্শে আমরা দুজনে আমাদের পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু উনি যখন জানলেন আমরা আনিসার নানা ও নানী, তখন উনি বললেন, নো নিড (কোন প্রয়োজন নেই)। এটা তার সৌজন্যের পরিচায়ক।
পরে মিতি আমাদেরকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের অন্য ধারে এক পাকিস্তানী দোকানে এসে কিছু কিনল। আলাপে জানতে পারলাম তার আদি বাড়ী পাকিস্তানের করাচীতে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশিত পাকিস্তানীদের একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন ফ্রি পাওয়া গেলো। এরপর কাছাকাছি একটা ভারতীয় দোকান থেকে কিছু কাপড় চোপড় কিনল আনিসার জন্য। কোয়ালিটি বেশ ভাল। দাম তুলনামূলক ভাবে সস্তা। সেখানে একটা ভারতীয় ইংরেজি ফ্যাশন ম্যাগাজিন ফ্রি পাওয়া গেল। এরপর আরো দুএকটি দোকান ঘুরে মিতি আমাদেরকে একটা রেস্টুরেন্টের রাস্তার ধারে বারান্দায় বসালো। সে আমাদেরকে হোয়াইট টি খাওয়ালো মানে দুধ দেয়া চা, শুধু লিকার নয়। চায়ের পরিমাণ প্রচুর। খুব সুস্বাদু। দাম মাত্র ৩ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। আজ আনিসাকে নিয়ে যাত্রার কালে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। তাই শীত ছিলো কনকনে এই অটামের শেষ মাসে মানে মে মাসে। বাংলাদেশের পৌষ মাসের মতো। ঠাণ্ডার মধ্যে চা খেতে খুব ভাল লাগল।
আমরা হেঁটে বাসায় ফিরলাম। দুপুরে লাঞ্চ করে বিশ্রাম করলাম। বিকেলে আনিসাকে চাইল্ড কেয়ার থেকে নিয়ে আসবার জন্য প্রস্তুত হলাম। ইতিমধ্যে জামাই তানভীর অফিস থেকে ফিরল। শীত বেশী বলে আনিসাকে প্র্যামে না এনে বরাবরের মতো তার গাড়ীতে আনার জন্য গেল। আমি তার সঙ্গে গেলাম এবং আনিসাকে নিয়ে আসলাম। সেখানে তানভীর দেখাল সারাদিন চাইল্ড কেয়ারের তারা আনিসার জন্য কখন কি করেছে তার লিখিত রেকর্ড রেখেছে। তাকে দুপুরে খাইয়েছে। পরে আনিসা দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। বিকেলে নাস্তা খাইয়েছে। বিকেলে তাকে দুধ খাইয়েছে।
পাশ্চাত্য দেশের চাইল্ড কেয়ার সম্বন্ধে এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। তাই যারা এ সম্বন্ধে আগেই জানে সেই সব বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অন্যদের অবগতির জন্য এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম। পরে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন আমি আর আমার স্ত্রী কিংবা আমি একা আনিসাকে চাইল্ড কেয়ারে সকালে দিয়ে এসেছি এবং পরে বিকেলে সেখান থেকে নিয়ে এসেছি। আনিসাকে নিয়ে সেখানে হেঁটে যেতে বা আসতে ৭/৮ মিনিট লাগে। আদরের নাতনীর জন্য কিছু করতে পেরে আমরা যারপরনাই আনন্দ পেয়েছি।
প্রতিবেশী ববের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ঃ আনিসাকে নিয়ে এসে সদর দরজার ছোট গেটের জন্য সিকিউরিটি লকের ভিতর ও বাহির দুই দিক থেকে খোলা যায় এমন সিকিউরিটি চাবির কপি বানানোর জন্য এই কমপ্লেক্সের ৪নং ইউনিটের প্রতিবেশী ববের কাছে গেল তানভীর। আমাকে সঙ্গে নিল। ববের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। ববের আদি নিবাস সার্বিয়ায়। সে জাতে সার্ব। বয়স আমার প্রায় সমান মনে হলো। সদালাপী হাসিখুশি ভদ্রলোক। তার স্ত্রী লিলি তখন বাসায় ছিলেন না। তার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশী হলাম। ববের শখ মাছ শিকার। তানভীর এরপর মাছ শিকার করতে গেলে আমাকে তার সঙ্গে নেয়ার জন্য অনুরোধ করলো। বব সানন্দে রাজী হল। আগের দিন আমরা এখানে পৌছার দিন সন্ধ্যার আগে মিতি আর তার মা বব আর স্ত্রী লিলির সাথে তাদের বাসায় দেখা করেছে। তারা তাদের ব্যাক ইয়ার্ডে লিলির ফুল ও ফলের বাগান দেখে মুগ্ধ হয়েছে। লিলি তাদেরকে তার গোলাপ গাছের দুটি লাল গোলাপ উপহার দিয়েছে। আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি যে সেই গোলাপে অত্যন্ত মিষ্টি গন্ধ যেখানে আজকাল বাংলাদেশে গোলাপের গন্ধের কথা আমরা ভুলতে বসেছি। তানভীর ববের কাছে দুই দিক দিয়ে ছোট গেট খোলা যায় সেই স্পেশাল সিকিউরিটি চাবি ধার চাইলো কপি বানানোর জন্য। অত্যন্ত ভদ্র ও পরোপকারী প্রতিবেশী বব সানন্দে সেই চাবি ধার দিলেন।
সেদিনই তানভীরের সাথে কাছাকাছি বানিংস নামের দোকানে গেলাম। সেখানে এক যুবক কী মেকার তানভীরের অনুরোধে ঐ স্পেশাল চাবির কপি বানিয়ে দিল। ববের চাবি তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফেরত দিল তানভীর। তানভীর আমার পার্থের দিনলিপি লেখার জন্য ডাইরি কিনে দিল। সে সেদিনই আমাকে তার ল্যাপটপ এই বাসার ডাইনিং টেবিলে সেট করে দিয়ে আমার দুর্ভাবনা দূর করে দিল। আমি আনন্দিত চিত্তে আমাদের বুয়েটের এলামনাই বন্ধন সিক্সটিনাইনে ( ১৯৬৯ সনে পাশ করা বুয়েট গ্র্যাজুয়েটদের এলামনাইয়ের ই-মেইল গ্রুপে) আমার পার্থ পৌঁছবার সংবাদ দিলাম। সেদিনই দুপুর নাগাদ বন্ধনের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার সিডনীর নারায়ণ ও মালেক (আমার বিয়াই)'এর সাথে মোবাইলে আলাপ হলো। পার্থের প্রশান্তি সকালেই মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলেছিল। সেদিন কবিতা লিখলাম "প্রশান্তিময় পার্থ" আর আমাদের বুয়েটের বন্ধন-সিক্সটি নাইন ফোরামে সেটা উপহার দিলাম। (চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
বোরহান উদ্দিন আহমদ, পার্থ থেকে |