নিঃশব্দে বিদায় বদরুল আলম খান
কীভাবে এটি ঘটলো, তার অনেকটাই আমাদের কাছে এখনও অজানা রয়ে গেছে। মুকুল শ্বাসকষ্ট নিয়ে সপ্তাহ দেড়েক ভুগছে, অগত্যা উপসর্গ থেকে মুক্তি পেতে এ্যাম্বুলেন্সে করে ওয়েস্টমিড হাসপাতাল এলো, এমনকি সহধর্মিণীকেও না জানিয়ে। তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জীবনের ইতি। একে কি নিয়তি বলবো? নাকি নিরেট দুর্ঘটনা, তাও জানি না।
সিডনির বেলাভিস্তা নিবাসী মখলেসুর রহমান মুকুলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল এপিংএ, মিন্টু ভাইয়ের বাসায়। মাস কয়েকও হয় নি দেশ থেকে এসেছি, ঠিক মুকুল যেভাবে প্রথমে বুয়েট, তারপর ব্যাংকক হয়ে ১৯৮৯ সালে সিডনী এসেছিল। আমরা তখন বেকারত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। কোন এক সন্ধ্যায় মুকুল এসে হাজির, মিন্টু ভায়ের বাসার সামনের চত্বরে বসে নানা গল্পের সূত্রপাত। তার সেই হাসি খুশি মুখ, আপন করে নেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতার কাছে হার মেনে গিয়েছিলাম প্রথম পরিচয়ে। তার থেকেই জানলাম সে বুয়েট থেকে পাশ করে বেরিয়েছিল ১৯৮৭ সালে। আমি তাকে বলেছিলাম আমার বুয়েটের ছাত্র জীবনের কথা, যদিও খুবই স্বল্পকালীন সময়ের ইতিহাস সেটি। তারপর নানা খানে, নানান সমষ্টিক আদান প্রদানের ফাকে, তার নিজের বাসায় নানা অনুভূতি মিশ্রিত পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি – এ সবই এখন চোখের সামনে ভাসে।
আমার স্ত্রী প্রায়ই বলতো মুকুল - লিসার মতো সুখী দম্পতি সচরাচর দেখা কঠিন। “সুখী দম্পতি” নামের সমাসবদ্ধ দু’টি শব্দ আমাদের কাছে যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়, লিসার কাছে সেটি দিগন্ত বিস্তৃত, কীভাবে সে সহ্য করবে এই হারিয়ে যাওয়া পরম কাছের মানুষকে, জানি না। একটা ক্যামেরা মুকুলের নিজস্ব সম্পদের মতো হাতে ঝুলতে দেখেছি কিন্তু তার লক্ষ্যবস্তু ছিল একজনই। স্ত্রীর ছবি নেওয়ার জন্য তাকে চতুরতার আশ্রয় নিতে হয় নি, ক্যামেরা তাক করলেই, লিসার মুখ উদ্ভাসিত, এই অভ্যাস থেকে মুকুলকে চ্যুত হতে দেখিনি কখনও। দু’জনই একই প্রফেশনের রীতিকৃত্যে বাঁধা পড়েছিল, দু’জনই প্রকৌশলী, নানা সফলতার মোড়কে বাঁধা তাদের সেই জীবন-ছন্দ নানাভাবে নানা খানে প্রকাশ পেয়েছে। মুকুলের মুখে শুনেছি লিসার সাহসিকতার নানা গল্প। হ্যাঁ, ব্লাকটাউনেই হবে, হঠাৎ লিসাকে অফিসের কাজে যেতে হবে। মুকুল পিছ ছাড়ে নি। নির্জন গাড় রাতের আঁধারে লোকালয় থেকে দূরে সিডনী ওয়াটারের একটি স্টেশন। আবছা আবছা দেখা যায় মাত্র, পাশেই বিশাল জলাশয়, লিসা সেখানে নির্দ্বিধায় গিয়েছে। এই গল্পটি মুকুলের থেকে শোনা। সবাইকে না শুনিয়ে মুকুল স্বস্তি পায় নি।
লিসার সঙ্গে তার ঘর বাঁধার ইতিহাস সচরাচরের চেয়ে ব্যতিক্রমীই বলবো। বন্ধু যুগলের মতো বোন ফিরোজার সঙ্গে যে সম্পর্ক তার গড়ে উঠেছিল, সেই দাবিতে মুকুল জানিয়েছিল তার জন্য বউ নিশ্চিত না করে বোন যেন সিডনীতে না আসেন। বোন মহাবিপদে পড়লেন। দ্রুত সিডনী যাওয়ার তাড়া থাকলেও ভাইয়ের সহধর্মিণীর খোঁজে নামতে হয়। ভাই বিশেষ কোন দাবীর বোঝা চাপিয়ে দেয় নি। মেয়েকে শিক্ষিত হতে হবে - হয় ইঞ্জিনিয়ার, অথবা মাইক্রোবায়োলজিস্ট। তাই হলো, বোন ইতিমধ্যে সিডনী চলে এসেছেন। কিছুকাল পরে মুকুল দেশে গেলো। লিসাকে সহধর্মিণী বানিয়ে ফিরে এলো। এক এক করে ঘর আলোকিত করে তাদের কোলে এলো দুই সন্তান। মুকুলের শিশুপ্রীতি অনেকটা কিংবদন্তির মতো শোনাবে, সে শিশু নিজের হোক বা হোক অন্য কারও। জড়িয়ে ধরে আদর করা, কাছে টানা হয়তবা মুকুলের মতই একজনের পক্ষে সম্ভব। তার অবিশ্বাস্য সততা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল ছোটকাল থেকে। নিশ্চিত জানি, তার এই গুণাবলী বিশেষ প্রগাঢ়তায় ফুটে ওঠে তার স্কুল জীবনে। ১৯৭৯ সালে খিলগাঁও সরকারী হাইস্কুল থেকে পাশ করে মুকুল নটরডাম কলেজে ভর্তি হয়েছিল। যাদের সাথে মুকুলের সেখানে পরিচিতি হয়, তারা সবাই তার সাক্ষী হয়ে আছে।
তারাশঙ্কর তাঁর ‘কবি’তে আক্ষেপ করে বলেছিলেন “জীবন এতো ছোট কেনে”। সত্যিই তো, তার জীবনকে বয়সের বিচারে স্বল্প পরিসরের বলাটাই ঠিক হবে। ঢাকা শহরে ১৯৬৫ সালে মুকুলের জন্ম। তখন পাকিস্তানের অধীনে জীবন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ছয় দিনের পাক ভারত যুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে সাধিকার আন্দোলন, বাংলাদেশের আবির্ভাব – এ সব ডিঙ্গিয়ে জীবনকে সে সুনিপুনভাবে, শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো, ঠিক আদি প্রকৌশলীর ঢঙ্গে তৈরি করেছিল। প্রবাস জীবন তো আর অন্তহীন কোন সুখের বিষয় নয়, আছে ভিন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা – সবই মুকুলকে করতে হয়েছে সুন্দর জীবনের তাগিদে। সেই জীবন এতো সহজে, এতো দ্রুত হারিয়ে যাবে, ভাবনার সূত্রে তাকে বিশ্লেষণ করা কঠিন। মুকুল সবার জীবনের খোঁজ নিয়েছে। বোনের ডায়েবিটিস, বোনকে বলতো - তোমার খাবার দাবার ঠিক নিয়মমতো হচ্ছে তো। আরও সবার ক্ষেত্রেও তার খবরদারী ছিল, কোথাও কার্পণ্য করে নি, অথচ নিজেই নিজের রোগব্যাধিকে আমলে নিতে ভুলে গেলো। ভেবেছিল তার অসুস্থতা মামুলী এজমা ছাড়া কিছুই না, অথচ হৃদরোগ কখন, কীভাবে অন্তস্রোতের মতো তার জীবন প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্ত করে দিচ্ছিল, তা অনেকটা অজানাই থেকে গেলো। যখন জানা গেলো তখন সময় ফুরিয়ে গেছে। জীবনের হাতে এই প্রবঞ্চনা আর প্রতারণার মাসুল তাকেই দিতে হলো। যৌবনের মধ্যেই হারিয়ে গেলো তার জীবনের শেষ পাতাটি। তবুও ভাবি তার জীবনের স্বল্প পরিসরতা বড় কথা নয়, জীবনের মূল্য তা দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়ত বোকামি হবে। যে কর্ম সে রেখে গেলো, তার মাত্রিকতা অনেক বেশী প্রসারিত। হয়ত সে কারণে মুকুলের নীরব বিদায় ব্যক্তি শোক থেকে সমষ্টি শোকে রূপ নিয়েছে।
৪ মে ২০২০
বদরুল আলম খান, সিডনী
|