বদরুল আলম খানের নতুন বই “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন”
বইয়ের প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৯৮ প্রচ্ছদ – মাশুক হেলাল বইটি অনলাইনে পাওয়া যাবে।
১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব সফল হওয়ার পর সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ৭০ বছর টিকে থাকার পর সেই রাষ্ট্র হঠাৎ ইতিহাসে হারিয়ে গেলো। যে সব কারণে এই অঘটন ঘটেছিল তার কিছু কিছু ব্যাখ্যা ভিন্ন আঙ্গিকে এবং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার প্রয়োজন ভেবে এই বইটি লেখা হয়েছে।
বইটি শুরু হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমাদের স্বাধীনতা উত্তর ঘনিষ্ঠতার ইতিহাসকে ঘিরে। বাঙালি জাতিসত্তা যে নিপীড়ন ভোগ করেছে তার সাথে রুশ ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানের উপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে পঁচিশ বছর কাটানোর কারণে বাঙালি জাতির পক্ষে স্বাধীনভাবে কোন ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটেনি। ব্যক্তিগতভাবে সেই সুযোগ অনেকের জীবনে এসেছিল কেবলমাত্র স্বাধীন হওয়ার পর। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থায় অধ্যয়ন করার সুযোগে অনেকেই দেশটির সঙ্গে নানা ভাবে সম্পর্কিত হয়েছে। ফলে রুশ মহাত্মার সঙ্গে বাঙালি সমাজের পরিচয়-সৌভাগ্য নিখাদ মুক্তিযুদ্ধের বদৌলতে হয়েছিল।
সোভিয়েত রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হল তার কারণগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা সম্ভব। প্রথমত এই রাষ্ট্র ইতিহাস কাঁপানো বলশেভিক বিপ্লবের কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার পতন প্রমাণ করে বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তি এবং সামাজিক পুনর্গঠন সম্ভব নয় বা সম্ভব হলেও তার ফলাফল যৎসামান্য – শেষ বিচারে লাভের চেয়ে লোকসানের পরিমাণ হয়ত বেশী। অক্টোবর বিপ্লবের বেশ আগে থেকে সামাজিক বিপ্লবের বিষয়টি রুশ সাহিত্য এবং দর্শনশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবের নেতাদের কেউ এর প্রতি কোন মনোযোগ দেননি। রুশ সাহিত্যিকদের মধ্যে দস্তয়েভ্স্কি, তলস্তয় এবং বিশেষ করে চেখভ সামাজিক বিপ্লবের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাদের ব্যাখ্যাকে বলশেভিকরা উপেক্ষা করেছিল কিন্তু বিপ্লব-প্রসূত সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন তাদের ভাষ্যকে সঠিক প্রমাণ করে বলে দাবী করা হচ্ছে।
পতনের দ্বিতীয় কারণ ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করা। বলশেভিকদের হাতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছিল। রুশ ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো, অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং আধ্যাত্মিক। জার-তন্ত্রের অধীনে এক হাজার বছর ধরে ঐ ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতা হাতে হাত মিলিয়ে বিকশিত হয়েছে। বিপ্লবের পর সেই সুগভীর বন্ধনকে সোভিয়েত শাসন সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছিল, আর তার জায়গায় স্থান করে নিয়েছিল এক বিশেষ ধাঁচের যান্ত্রিক মনন। কীভাবে এই মনন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছিল সেটি পতনের কারণ উদ্ঘাতনে সহায়ক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
তৃতীয় কারণ - সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অতি মাত্রিক প্রসার এবং ফলশ্রুতিতে জন্ম নেওয়া জাতিগত সমস্যা। জাতিগত সমস্যা সোভিয়েত সমাজে অন্তস্রোতের মতো উপস্থিত থাকলেও প্রকাশ্যে তার ওপর আলোকপাত করা হয়নি বা কেউ অনুমান করলেও সাহস করে প্রতিবাদ করেনি। এই নীতিতে বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়েছিল মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বালটিক অঞ্চল। সেখানে সোভিয়েত ক্ষমতার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দমন নীতি এবং জাতি মিশ্রণের মতো অমানবিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল কিন্তু অনেকটা ভস্মীভূত আঁকারে এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো - কখনও পরোক্ষ অসহযোগিতা দেখিয়ে, কখনও বা সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি নীরব প্রতিবাদী ঘৃণা দেখিয়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সোভিয়েত রাষ্ট্র জাতিগত সেই ক্ষোভের কোন সমাধান দিতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকট তাতে করে বৃদ্ধি পেয়েছে, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ধাঁচে গড়া মিশ্র জাতি রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা। সোভিয়েত ব্যবস্থার ব্যর্থতার সর্বশেষ কারণ একনায়ক-তান্ত্রিক শাসন যার সঙ্গে যোগ করতে পারি গণতন্ত্র-হীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিলোপ এবং নাগরিক জীবনের ওপর রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব। সোভিয়েত রাষ্ট্রে কম্যুনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ব এবং দুর্নীতিকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্থান পতনের ইতিহাস দীর্ঘ, যার শুরু লেনিন এবং স্তালিনের সময় থেকে। সেই অস্থির অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের পূর্ণ বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করা অবশ্য করণীয় ভেবেছি। বইটির সর্বশেষ অধ্যায়ে রয়েছে রহস্য-সমৃদ্ধ, দুর্জ্ঞেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন-কথা, নাটকীয়তায় ভরা সেই পতনের সিম্ফনি। মোট কথা, “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” বইটি রুশ বিপ্লব এবং সোভিয়েত পরীক্ষণে ব্যর্থতার একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখা সম্ভব। পাঠক যদি সেই দৃষ্টি দিয়ে বইটি দেখেন, তাহলে এই শ্রম পণ্ডশ্রম হয়নি বলেই ধরে নেবো।
লেখক পরিচিতি বদরুল আলম খান এর জন্ম ১৯৫২ সালে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এম এ এবং মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে পিএইচডি। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে যোগ দেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে। ১৯৯৪ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যাপনা করছেন। পড়িয়েছেন ম্যাকোয়ারি ও সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ড-কালীন অধ্যাপক।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: বিশ্বায়ন: ইতিহাস ও গতিধারা; গণতন্ত্রের বিশ্বরূপ ও বাংলাদেশ; সংঘাতময় বাংলাদেশ: অতীত থেকে বর্তমান; মাও সে তুং: চীনের দুঃখ; পুঁজিবাদের সমাজতত্ত্ব (সম্পাদিত); সমাজতত্ত্ব: সংকট ও সম্ভাবনার দেড়শ বছর; দর্শনের সংকট; তৃতীয় বিশ্ব, ধর্ম ও বিপ্লব প্রভৃতি।
|