bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব (৪)
বদরুল আলম খান


আগের অংশ পরের অংশ


বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর থেকে লেনিনের পেত্রোগ্রাদ শহরে ফিরে আসা। ওই শহরে তিনি বেশ কিছু সময় রাজনৈতিক নির্বাসনে কাটিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় চলেছে বিপুল পরিবর্তন। জারকে হটানো গেছে। ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অকর্মণ্য। রাজনৈতিক শুন্যতা, নেতৃত্বের অভাব, প্রথম মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ – কৃষক শ্রেণীর পর্যুদস্ত অবস্থা – সব মিলিয়ে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আকাশে বাতাসে। মার্চের ৩০ তারিখে লেনিন জুরিখ থেকে ট্রেনে চাপলেন। সাথে ২৬ জন সহকর্মী। রওয়ানা হলেন সেন্ট পিটারসবার্গের উদ্দেশে। প্রথমে এসে পৌঁছলেন সুইডেনে। সেখান থেকে ফেরী। তার পর ট্রেন। অবশেষে ফিনল্যান্ড এর রাজধানী হেলসিঙ্কি। হেলসিঙ্কি পৌঁছে শঙ্কায় ভরে উঠলো লেনিনের মন। কোনভাবে তাকে কেউ প্রতারিত করছে কিনা। গ্রেপ্তারের ভয় ছিল। কিন্তু সব সংশয় কাটিয়ে তিনি পৌঁছলেন জারের রাজধানী সেন্ট পিটারসবার্গে ১৭ দিন পর। ফিনল্যান্ড রেল স্টেশন। লেনিনের ট্রেন এসে পৌঁছালো অনেক দেরীতে। ট্রেন ভ্রমণের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জার্মান সরকার। তাদের ধারনা ছিল এই ব্যক্তিটি রাশিয়াকে বাধ্য করতে পারে যুদ্ধ বন্ধে। জার্মানির সাথে অসম চুক্তি সাক্ষরে বাধ্য হলে রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়বে। জার্মানির বিজয় হবে নিশ্চিত। এ কারণে লেনিনকে অনেকে জার্মানির গুপ্তচর হিসেবে সে সময় প্রচার করেছিলেন। তাকে গ্রেপ্তারেরও আদেশ ছিল। এপ্রিলের ১৬ তারিখের কথা। ফিনল্যান্ড স্টেশনে লেনিনকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে মস্কো সোভিয়েতের সদস্যরা। স্টেশনের যে ঘরটি নির্দিষ্ট ছিল জারের বিশ্রামাগার হিসেবে সেটি ইতিমধ্যে শ্রমিকদের দখলে। ঘরে ঢুকে লেনিন দেখলেন অগণিত শ্রমিক তার আগমন অপেক্ষায় সেখানে সমবেত হয়েছে। মস্কো সোভিয়েতের প্রতিনিধি ছিলেন একজন মিন্সেভিক। লেনিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কিন্তু তিনি সাদর অভিনন্দন জানালেন লেনিনকে। বললেন “কমরেড লেনিন, আমরা আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের প্রধান কাজ বিপ্লবকে রক্ষা করা। ভেতর এবং বাইরের শত্রু থেকে”। লেনিন উঠে দাঁড়ালেন। বললেন “ প্রিয় কমরেড, সৈনিক নাবিক এবং শ্রমিক ভায়েরা। আমি আপনাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। আপনারা বিপ্লবকে জয়যুক্ত করেছেন। আপনারা বিশ্ব প্রলেতারিয়াত বাহিনীর সবচেয়ে অগ্রসর বাহিনী। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের পরিচালিত যুদ্ধ ইউরোপে গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বালাবে। উদয় হবে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূর্য। পুজিতান্ত্রিক সমাজের পতন আজ অবশ্যম্ভাবী”।

স্টেশনের বিশ্রাম ঘর থেকে বেরিয়ে লেনিন মুখোমুখি হলেন বিশাল জনতার। অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বলতেই হয়। মোটর গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে সেই ভাষণই বদলে দিয়েছিল বিশ্ব রাজনীতিকে। লেনিন বড় মাপের কোন তাত্ত্বিক ছিলেন না। ট্রটস্কি বা অন্যান্যদের মতো মার্কস এর তত্ত্বের বিশুদ্ধতা নিয়ে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখেন নি। তার মুল লক্ষ্য ছিল বিপ্লব এবং বিপ্লব। রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে তিনি কখনও নরম ভাষায় সমালোচনা করেন নি। তার যুক্তি এবং আক্রমণ ছিল তীক্ষ্ণ এবং ক্ষুরধার। তর্ক বিতর্কের মুল বিষয় ছিল বিপ্লব কেন্দ্রিক। তত্ত্ব নিয়ে নয়। মানুষ বিপ্লব চায় সেটি তিনি ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলেন। কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় বিপ্লবের ধারনাটি তার মনে বদ্ধমূল হয়েছিল। তার ভাই অ্যালেকজান্ডার জারের হত্যা ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে তাকে ফাঁসিতে ঝোলান হয়েছিল। সেটি লেনিনের মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। বিপ্লবের একশ বছর পর লেনিনের কথা ভাবি। আরও অনেক ভাবনা মনে আসে। ভাবি সে সময়কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি জার্মানির সাথে শান্তি চুক্তি করতেন; যদি কৃষকের হাতে জমি বিতরণের প্রতি দৃঢ় ভূমিকা নিতেন তাহলে লেনিনের পক্ষে কি ঐ সরকারকে অপসারণ করা সম্ভব হতো? সেক্ষেত্রে কি রাশিয়ার ভাগ্য বদলে যেতো না? হয়তবা বিপ্লব এড়িয়ে রাশিয়া অনুসরণ করতো পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। জানি ইতিহাস আকস্মিকতায় ভরা। সবকিছু নিয়ম মাফিক চলে না। উত্থান পতনে ভরা মানুষের ইতিহাস। সে কারণে যা ঘটে গেলো সেটিই মেনে নিতে হল রাশিয়ার মানুষকে।



দুই

পহেলা সেপ্টেম্বর দেখতে দেখতে এসে গেল। ১৯৭২ সাল। রাশিয়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ভিন্ন ধাঁচের। তারা আমাদের মতো পহেলা জানুয়ারি থেকে শিক্ষা বর্ষ শুরু করে না। সেখানে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। আমার হোস্টেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একেবারে নিকটে। যাওয়ার পথে রয়েছে কিছু দোকানপাট। দোকানগুলি থেকে আমি কিনি রুটি দুধ মাখন ডিম বা মুরগি। সোভিয়েত সমাজে পণ্য সম্ভারের দিক থেকে দৈন্যতা সুস্পষ্ট। দোকানগুলিতে নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া যায় কিছু পণ্য। বাদ বাকি সময়ে পণ্যের ভাণ্ডার খালি। এটি আমার কাছে খুবই অবাক লাগতো। আমাদের হোস্টেল থেকে বেশ কিছু দূরে ছিল একটি কাচা বাজার। ঘরে উৎপাদিত অল্প স্বল্প শাক সবজি অথবা ফলের আঁচার জাতীয় পণ্য নিয়ে দেখতাম কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা বসে আছে। কিন্তু সে সব পণ্যের মূল্য ছিল আমাদের মত শিক্ষার্থীদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভাবলাম বিশাল সোভিয়েত অর্থনীতিতে ব্যক্তি উদ্যোগ কত ক্ষুদ্র মাপের। মস্কো শহরের একেবারে কেন্দ্রে কেনাকাটা করতে গিয়েছি অনেক বার। সেখানেও লক্ষ্য করেছি বৈচিত্র্যের দর্শনীয় অভাব। বহু দ্রব্য দোকানে ঝুলছে ঠিকই কিন্তু গুনগত মান ক্রেতাদের মন কাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণ, চাহিদার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের দিকটি নিয়ে এখানে কেউ ভেবেছে বলে মনে হয় না। ভাবলেও সেটি বাস্তবে রূপায়ন হয় নি। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের চাহিদা তৈরি হয় কখনও কৃত্রিমভাবে কখনও সত্যিকার চাহিদার কথা ভেবে। সেই চাহিদা পূরণ করে পুঁজি। এখানে সব কিছু জনগণের মালিকানায়। কথাটি আমি অবশ্য সোজা ভাবে দেখি নি। কাগজ কলমে মালিকানা নিশ্চিত হলেও প্রকৃত মালিক হচ্ছে পার্টি। গোটা পার্টি না। ক্ষুদ্র সংখ্যক একটি এলিট গ্রুপ। তাদের দায়িত্বে আছে কলকারখানা বা যৌথ খামারের পরিচালনা ভার। সে কারণে তাদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা। ক্ষমতা আরও আছে আমলাতন্ত্রের হাতে। তাদের জীবন শুনেছি খারাপ না। ডিনার টেবিলে ক্যাভিয়ার সালমন বা আরও দামি খাবারের ঘাটতি নেই। অথচ তাদের বিপরীতে সাধারণ মানুষ যারা সম্পদের আসল মালিক বলে রাজনৈতিক ইশতেহারে উল্লেখ আছে তারা জীবন কাটায় স্বল্প গুনমানের খাদ্যদ্রব্য বা পরিধানের বস্ত্র নিয়ে। সমাজতন্ত্রের এই দুর্বলতার দিকটি এখানকার টেলিভিশনে তুলে ধরতে দেখেছি যদিও খুব সূক্ষ্মভাবে। ফলে প্রায় মনে হয়েছে সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্ল্যানিং যদি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিকল্প কোন দোমেশালি ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা হলো না কেন? পণ্যের ঘাটতি বা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনের প্রতি অবহেলার কোন সমাধান বের করা হলো না কেন? আইনস্টাইন তার লেখায় বলেছিলেন পার্টি এবং আমলাতন্ত্র যদি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয় তাহলে জনগণের জন্য সেটি কোন সুখবর নয়। কথাটি যে কত সত্য সেটি সোভিয়েত অভিজ্ঞতা থেকে দেখি।

যাই হোক, শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষা শেখার ক্লাস। আমাদের ক্লাসটি এক তালায়। ঢুকে দেখি ক্লাস ভর্তি নানা দেশের ছাত্র ছাত্রী চেয়ারে আসন নিয়ে বসে আছে। ভারতবর্ষ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আসা সব ছাত্র ছাত্রী। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থায় লেখাপড়া কেমন হবে তা নিয়ে আমার মনে শঙ্কা ছিল। ক্লাসে গিয়ে বসলাম। একটু পর ক্লাসে ঢুকলেন আমাদের শিক্ষিকা। শুরু হল শিক্ষা দান। দেখি তিনি সাথে নিয়ে এসেছেন একটি ক্যাসেট প্লেয়ার। ক্লাস শুরু করলেন রুশ ভাষায় গাওয়া একটি গান দিয়ে। গানটি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী ভোলগাকে নিয়ে। গানের কথাগুলি এখনও মনে বাজে। রুশ ভাষা থেকে ভাষান্তর করলে গানটি শোনায় এরকম - “হে আমার ভোলগা! কোন সুদূর অজানা দেশ থেকে তুমি বয়ে চলেছ আবহমান কাল ধরে। ভোলগা, তোমার শেষ কোথায় জানি না। গম খেতের সোনালি রঙ, বরফ ঢাকা দিগন্তের শুভ্রতার ধার ঘেঁষে তুমি বয়ে চলেছো কতকাল ধরে। অথচ আমার বয়স মাত্র সতেরো। মা বলেছিল “পুত্র, এমন তো হতে পারে ঘরে ফেরার পথে রাস্তার ক্লান্তি তোমাকে দুর্বল করবে। তখন তুমি ভাসিয়ে দিও তোমার দেহ ঐ ভোলগা নদীর জলে। বিধৌত হয়ে পুনরায় জেগে উঠবে পূর্ণ শক্তি নিয়ে”..। গানের কথাগুলি স্বদেশ প্রেমে ভরা। শুনলে এখনও কেন জানি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম ক্লাস শুরু হবে লেনিন বা মার্কসের কোন বিপ্লবী উদ্ধৃতি দিয়ে। সমাজতন্ত্রের কথা দিয়ে। সমাজতন্ত্রের কোন নামকরা কবির কথা দিয়ে। কোনটাই ঠিক হলো না। পরে ঠিক বুঝেছিলাম আমাদের শিক্ষক তার ক্লাস কেন শুরু করেছিলেন ভোলগা নদী দিয়ে। রুশ জাতির দীর্ঘ ইতিহাস, যে বিশাল অঞ্চল নিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ড এবং যার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এই ভোলগা তার বুক ভরে আছে হাজার বছরের ইতিহাসে। যে সব উত্থান পতন রাশিয়ার ভাগ্যে লেখা ছিল তার প্রতিটির সাথে যুক্ত এই ভোলগা নদীর স্রোতধারা। এই নদী অবলোকন করেছে নানা উত্থান পতন। উত্তরের শ্বেত সমুদ্র (“হোয়াইট সি”) এবং বালটিক সাগর থেকে বেরিয়ে ভোলগা পড়েছে কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরে। তার কোন এক পাড়ে রয়েছে রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিনের জন্মস্থান কাজান শহর। আরও রয়েছে ইতিহাস বিখ্যাত নগরী ভোলগাগ্রাদ। ১৯৩৩ সালে স্তালিন ভোলগা নদীর সাথে মস্কো শহরের ক্ষুদ্র নদী মস্কোভাকে সংযুক্ত করেছিলেন জলের সংস্থান করতে। তাতে করে রাজধানী মস্কোর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। অন্যথায় মস্কো হয়তো বিচ্ছিন্ন থাকতো রাশিয়ার বাকি অঞ্চল থেকে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এসে গেল হঠাৎ করে। সেই ইতিহাসের সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল এই ভোলগা নদীর তীরে। সে এক জীবন মরণ যুদ্ধ যে যুদ্ধ নির্ধারণ করবে কে জয়ী হবে কে হবে পরাজিত। ১৯৪২ সালের জুন মাস থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ মাত্র আট মাসের ব্যবধানে ২০ লক্ষ রুশ এবং জার্মান জীবন হারিয়েছিল এই শহরের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। হিটলারের জার্মান বাহিনী ভোলগা নদী দখলে জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছিল কেন তার কারণ জানি। লক্ষ্য ছিল ককেশীয় অঞ্চলের তেল সমৃদ্ধ এলাকা তার দখলে আনতে। সোভিয়েতের লাল আর্মি এবং ভোলগাগ্রাদের মানুষ দাঁড়িয়েছিল তাদের পথ রোধ করে। ভোলগাগ্রাদ মাথা নত করে নি। সেই যুদ্ধই অনেক ঐতিহাসিকের মতে ঘুরিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মোড়। প্রমাণ করেছিল রাশিয়া কি করতে সক্ষম। সেই কালক্ষণ থেকে অনেক সময় কেটে গেছে। রুশ জাতি সেই বিষাদময় ইতিহাসের কথা ভোলেনি। এতো বছর পর আজও যারা এই নদীর ওপর দিয়ে জাহাজে ভ্রমণ করেন তাদের চোখে পড়ে এক বিশাল মূর্তি। মা রাশিয়ার মূর্তি “মাতৃভূমি তোমাকে ডাকে”। মায়ের ডাকে উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার সেচ্ছাসেবী সে সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। রক্ষা করেছিল মাতৃভূমিকে। মামায় কুর্বান নামক স্থানে নির্মিত এই মূর্তির দিকে তাকিয়ে রুশ মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় এই শহর রক্তে স্নাত হয়েছিল। তার নোনতা স্বাদ এখনও হয়ত লেগে আছে ভোলগা নদীর জলে। ১৭ তালা সমান উঁচু এই মূর্তি আজও মানুষের কাছে বেদনা দুঃখ এবং বিজয়ের প্রতীক হয়ে আছে। রুশ জাতির গৌরবময় বিজয়ের এই নিদর্শন আজও জানিয়ে দিচ্ছে রাশিয়ার শক্তিকে। এ জাতি মাথা নত করে না। ঐ মূর্তি হয়ত বলছে কেউ যদি ভুলক্রমেও রাশিয়াকে আক্রমণ করে তাহলে তার পরিণতি হবে ঠিক হিটলারের মতো।

দেখতে দেখতে প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে এলো। এখন দুই সপ্তাহের বিরতি। জানতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয় সাত দিনের শিক্ষা সফরের আয়োজন করেছে নবাগত শিক্ষার্থীদের জন্য। মস্কো থেকে তাদের নেওয়া হবে লেনিনগ্রাদ শহরে। রুশ বিপ্লবের শহর এই লেনিনগ্রাদ। শহরটি দেখার উত্তেজনা আমাকে গ্রাস করলো। সব মিলিয়ে তিরিশ জন ছাত্র ছাত্রী। ইতিমধ্যে শীতের আগমনবার্তা শুনতে পাচ্ছি। মস্কোতে বরফ পড়তে শুরু করেছে। গোটা শহর এখন বরফের হাতে জিম্মি। এ বরফ এখনও পেজা পেজা। সবাই বলছে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে শীত নামবে। ভাবছি যাবো আরও উত্তরের শহর লেনিনগ্রাদ। সেখানে বালটিক সাগরের হিমেল বাতাস। নিশ্চয় ঠাণ্ডা অনেক বেশি। শীতকে মোকাবেলা করার প্রাথমিক ব্যবস্থা নিতে হয়। ছোট্ট একটি সুটকেস গুছিয়ে নিলাম। পুরু কোট, মাথায় পশমের টুপি হাতে পুরু দস্তানা পরে এলাম লেনিনগ্রাদস্কি ভকজালে। ভকজাল রুশ শব্দ। অর্থ রেল স্টেশন। এখান থেকে সব ট্রেন যায় রাশিয়ার উত্তর পশ্চিমে। ট্রেনের নাম ক্রাস্নায়া স্ত্রেলা। বাংলায় “লাল তীর”। একটি কুপেতে চার জন করে যাত্রীর ব্যবস্থা। রাত ১০ টা তিরিশ মিনিটে ট্রেন ছাড়লো। ট্রেনের কামরায় সব কিছু গুছিয়ে এবার একটু বসেছি। দেখি ট্রেনের মহিলা এটেনডেন্ট চা বিস্কিট এবং দই নিয়ে হাজির। রুশ ভাষায় তাকে কীভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় সেটি অবশ্য শিখে নিয়েছি। ইতিমধ্যে ট্রেন গতি পেয়েছে। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ল্যাম্পপোস্টগুলি দ্রুত অপসারিত হচ্ছে আমার দৃষ্টি থেকে। মাঠ এবং প্রান্তর সাদা বরফে আবৃত।



আগের অংশ পরের অংশ






Share on Facebook               Home Page             Published on: 22-Jan-2018

Coming Events:

Blacktown Lakemba Minto $ Raised so far