bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব (২)
বদরুল আলম খান


আগের অংশ পরের অংশ


আগের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়ি। শীঘ্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। কলেজের লাইব্রেরীতে হঠাৎ চোখে পড়লো বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি লেখা। লেখাটি সমাজতন্ত্রের ওপর। নাম “কেন সমাজতন্ত্র”? লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯৪৯ সালের মে মাসে। সেখানে তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সমাজ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন কি কারণে সমাজতন্ত্রই সেই আদর্শ যে আদর্শ দিয়ে গড়া সম্ভব প্রকৃত মানব সমাজ। লেখাটি পড়ে মনে হয়েছিল এ তো কেবল মহাজ্ঞানী কোন পদার্থ বিজ্ঞানী নন। এ তো একাধারে বিশাল মাপের এক সমাজবিজ্ঞানীর লেখা। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন কেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করতে হবে। দেখিয়েছিলেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি কীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ব্যক্তি মালিকানা কীভাবে ব্যক্তি এবং সমাজের সম্পর্ককে বিকৃত করে দেয় যেখানে সাধারণ মানুষের পাওয়ার কিছুই থাকে না। থাকে না জীবনের কোন নিশ্চয়তা বা ভরসা। যে ধরনের রীতিনীতি ঐ সমাজ গড়ে তোলে আইনস্টাইন তাকে সমাজ জীবনের জন্য নেতিবাচক ভেবেছিলেন। সেই নীতি তার ধারনায় সাধারণ মানুষের জীবনকে নিঃশেষিত করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় জীবন স্প্রিহাকে। পঙ্গু করে দেয় স্বাদ আহ্লাদকে। আইনস্টাইন স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক সামাজিক সম্পর্কের যে সম্পর্ক পুঁজিবাদী অর্থনীতির লোভ লালসা-গত উদ্যোগ থেকে বিরত থাকে। মানুষের মনকে পঙ্গু করে দেয় না। আরও ভেবেছিলেন এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা যা প্রাধান্য দেবে সামাজিক মঙ্গল ভাবনাকে। মুনাফা বা ভোগদখলের মানসিকতা সৃষ্টি তার কাজ নয়। সেই সময় থেকে কেটে গেছে বহুকাল। আইনস্টাইনের প্রতিটি কথা আমার মনকে সে দিন ভরিয়ে দিয়েছিল। আপেক্ষিক তত্ত্বের স্রস্টা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শে।

তবে একই সাথে আইনস্টাইনের লেখায় লক্ষ্য করেছিলাম একটি সতর্কবাণী। সেই দিকটি আমি কখনো ভুলি নি। আমার মনে হয়েছিল সেটিই ছিল তার লেখার সবচেয়ে মূল্যবান দিক। তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ভালো। কিন্তু সেই ব্যবস্থাই আবার ব্যক্তিকে শৃঙ্খলিত করতে পারে যদি আমলাতন্ত্র বা পার্টি সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে। তার উপদেশ ছিল যে ভাবেই হোক আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বকে রুখতে হবে। যেন মাথা চাড়া দিয়ে সে উঠতে না পারে। নিশ্চিত করতে হবে ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতাকে। অন্যথায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের সব চেষ্টা হবে ব্যর্থ। কি ভাবে আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বকে রোখা যাবে তার একটি ধারনা তিনি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্ক এবং পরিবেশ। সেই ফ্রেমওয়ার্কের প্রকৃত রূপ কি সেটি ঐ লেখায় স্থান পায় নি। কিন্তু নিঃসন্দেহে ঐ দায়িত্ব তিনি হস্তান্তর করেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। জানি আইনস্টাইনের ঐ ভাবনাটি গড়ে উঠেছিল দুই আদর্শের প্রভাবে। জার্মানিতে বসবাস-কালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজকে তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার অর্থনীতির প্রতি। আবার হিটলারের ফ্যাসিবাদী শাসন যে গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল তা থেকে পালিয়ে তিনি এসেছিলেন আমেরিকায়। সেখানে পরিচিত হয়েছিলেন গণতন্ত্রের সাথে। দেখেছিলেন ব্যক্তি স্বাধীনতার মূর্ত বহিঃপ্রকাশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একশ বছর পর আজ তার কথাগুলি বার বার মনে পড়ে। মনে পড়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ খুঁজতে গিয়ে। রাজনীতিবিদদের কোন প্রজন্ম কি আইনস্টাইনের ঐ সতর্ক বানীর প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল? না বলেই ধারনা করি। সমাজতন্ত্রীরা আইনস্টাইন পড়েনি। পড়লেও উপেক্ষা করেছে তার সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি। উনবিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সৃজনশীল সাহিত্য এবং দার্শনিক ঐতিহ্যকেও তারা ভালো করে অনুধ্যান করেছিল কিনা সন্দেহ করি। সে সাহিত্য হোক না ফরাসী জার্মান অথবা রুশ। প্রতিটি সাহিত্য ভাণ্ডারই শৈল্পিক মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মনোজগতের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। যে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিবাদী সমাজে অবদমিত হয় সাহিত্যিক এবং দার্শনিক সমাজ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু কেউ কি ভেবেছিল সেই স্বাধীনতাই আবার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিষ্পেষিত হবে? সমাজতন্ত্র কি দাবী করে নি একমাত্র ঐ আদর্শই মানুষের সার্বিক বিকাশকে নিশ্চিত করবে। প্রস্ফুটিত করবে মানুষের সব সম্ভাবনাকে। কোন বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তার সুপ্ত প্রতিভাকে মূর্ত করে তুলবে? “ডক্টর জিভাগো” বা আরও অন্যান্য লেখা পড়ে কিন্তু বার বার মনে বেজেছে সমাজতন্ত্র ব্যর্থতার দিকটি। শ্রমিক কৃষকের সাথে বুদ্ধিজীবীর চিন্তার সংযোগ ঘটে নি। না হলে কীভাবে তারই অভ্যন্তরে গড়ে উঠলো পুঁজিবাদের হিংস্র নব্য সংস্করণ। এই ব্যর্থতাই কি সমাজতন্ত্রকে পরিণত করেছিল যান্ত্রিক এক ব্যবস্থায় যা কিনা ধ্বংস করলো তার অভ্যন্তরীণ সৃজনশীলতাকে? মাঝে মধ্যে মনে হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যেন কেমো থেরাপি দিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা করা। যে থেরাপি ধ্বংস করে শরীরের সুস্থ এবং পীড়িত – উভয় সেলকে। ফলে ভাবি সমাজতন্ত্রের মধ্যেই কি রয়ে গেছে একনায়কত্বের বীজ? তাহলে ব্যক্তি বিশেষকে যেমন জোসেফ স্তালিন বা আরও কাউকে দোষারোপ করে কি লাভ!

যাই হোক, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হলো। নতুন রাষ্ট্র। ফিরে এলাম বুয়েটে। শেরে বাংলা হলের দক্ষিণ প্রান্তের ৪০৫ নম্বর রুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায় মন নেই। চারিদিকে আশান্বিত যুব সমাজ ঘিরে রেখেছে আমাকে। চলছে মিটিং মিছিল। নানা জাতীয় উদ্দীপনার ঢেউ আঘাত করছে চারদিক থেকে। রাত করে আড্ডা। গভীর রাতে দল বেধে মোরগ পোলাও খাওয়ার মধ্যে কি আনন্দ পেয়েছি জানি না। বুয়েটে চলছে ছাত্র ইউনিয়নের নানা সম্মেলন। পোস্টার লেখা মিছিল। এ এক গভীর আনন্দ। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য। সে এক অন্য আমেজের মধ্যে বাস করা। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক অঘটন। হঠাৎ একদিন কি এক সামান্য কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর অপমানিত হলেন ছাত্র লীগের এক মাস্তানের হাতে। মাস্তানটি নাকি পিস্তল উঁচিয়ে প্রফেসরকে শাসিয়েছিলেন। প্রতিবাদে সারা বুয়েট-ব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো চাপা বিক্ষোভ। মনে আছে বিশাল মিছিল করে আমরা গিয়েছিলাম বঙ্গ ভবনে। শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে। এর প্রতিকার পেতে। মুজিব বেরিয়ে এলেন। ধৈর্য ধরতে বললেন। বললেন কি জটিল সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। চারিদিকে অস্ত্রের ছড়াছড়ি। উদ্ধার করবো কি করে? অস্ট্রেলিয়ার এবিসি রেডিওর সাংবাদিক আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমাকে ঐ বিক্ষোভ সম্পর্কে কিছু বলতে বললো। সেদিন কি বলেছিলাম তা ঠিক ঠিক মনে আছে। বলেছিলাম এই সরকার মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলছে। সোনার বাংলার কথা বলছে। আসলে তার পক্ষে এ সব পূরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। দেখি আমার পাশ ঘিরে ক্রোধের একঝাক চোখ। ছেলেগুলি ছাত্রলীগের। তাদের দেখেছি বুয়েটের মিছিল মিটিংয়ে। ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা আমাকে আগলে রাখল। ফিরে এলাম হোস্টেলে হতাশা এবং আশার মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে।

ইতিমধ্যে খবরের কাগজে সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৫টি স্কলারশিপের কথা ঘোষণা করেছে। বন্ধুদের অনেকে আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। আমি দেই নি। তার কারণ পরিষ্কার। সরকার আওয়ামী লীগের। আমি বামপন্থী রাজনীতি করি। ফলে অবধারিত ভাগ্য জেনে আবেদন করার তাড়না অনুভব করি নি। আমার এক রুমমেট আশরাফ ভাই। তিনি অবশ্য নাছোড়বান্দা। বললেন “তোমার কিছুই করতে হবে না। শুধু এই ফর্মে নাম সাক্ষরটা করো। বাকিটা আমরা করে নেব। রুমের সবাই দরখাস্ত করছে। তুমি করবে না কেন”। যুক্তিটি গ্রহণ না করে পারলাম না। তাছাড়া সোভিয়েত দেশ দেখা বা সেখানে পড়াশুনা করার সুযোগ আমার কাছে ছিল যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সেই সাথে আরও ছিল অর্থ সমস্যা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ভালো করায় সরকার মাসিক ১২০ টাকা বৃত্তি দিয়েছিল দুই বছরের জন্য। প্রথম পাঁচ মাসেই দেখি ব্যাঙ্কের একাউন্ট শূন্য। এই কয় মাসে বৃত্তির সব টাকা খরচ করে ফেলেছি। এদিকে লেখাপড়ার অবস্থাও নয় ছয়। তিন মাস হয়ে গেছে ক্লাস শুরু হয়েছে। একদিন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসে ঢুকেই বের হয়ে এলাম। দেখি প্রফেসর ব্ল্যাক বোর্ডে কি সব সংকেত ব্যবহার করে লিখে চলেছেন যার সবটুকুই আমার কাছে দুর্বোধ্য। সে এক দুঃস্বপ্নের মতো আমার অবচেতন মনে স্থান করে নিয়েছিল। আজও অনেক সময় স্বপ্নে দেখি আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙের পরীক্ষা দেইনি। আমাকে পুনরায় পরীক্ষা দিতে হবে। অনেকটা বাধ্য হয়েই দরখাস্ত করার সম্মতি দিতে হল। এরই মধ্যে তিন মাস কেটে গেল। দরখাস্তের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখি সেক্রেটারিয়েট থেকে একজন পিয়ন আমাকে খুঁজছে। হাতে সরকারি ছাপসহ সিল গালা করা একটি চিঠি। পিয়ন বললো স্যার সুখবর আছে। খামটি খুলে দেখি সেখানে মস্কোতে আমার স্কলারশিপের খবর।

১০ই আগস্ট ১৯৭২ সাল। তেজগাঁও বিমান বন্দরে দাড়িয়ে আছে এরোফ্লোটের ইলুসান ১৮ বিমান। বুয়েটের হোস্টেল থেকে এয়ারপোর্টে এলাম বোনের সাথে। আমাকে বিদায় দিতে এসেছে বুয়েটের আরও কয়েক বন্ধু। লালচে রঙের একটি সুটকেসে গুছিয়ে নিয়েছি। সেখানে আমার কিছু কাপড় চোপড়। কয়েকটি বই। মায়ের দেওয়া একটি কাঁথা। মা বাবা কেউ আসেনি বিদায় দিতে। জানি স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রাস্তা ঘাটের অবস্থা করুণ। মনে আছে যশোরে গিয়ে মার সাথে দেখা করতে আমাকে আট বার ফেরী পার হতে হয়েছিল। সকালে রওয়ানা দিয়ে সন্ধ্যা রাতে পৌঁছেছিলাম যশোর শহরে। ইতিমধ্যে দুই প্রোপেলার বিকট শব্দ করে উঠলো। ঘড়িতে বাজে সকাল ৯-৩০ মিনিট। আমাদের প্লেন উড়লো আকাশে। প্রথমে করাচী, তাঁর পর তাসখন্দ। সেখানে সাময়িক যাত্রা বিরতি। ভোর রাতে পৌঁছলাম মস্কোর সেরেমেটিয়েভ বিমান বন্দরে। ১৮ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি সারা দেহে লেগে আছে। একেবারে নুয়ে পড়েছে দেহ। বিমান বন্দরে রাখা একটি বেঞ্চে গা এলিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। জেগে উঠলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তার ডাকে। দুঃখ প্রকাশ করলেন বিলম্বের জন্য। বললেন “চলো। মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি তোমাদের নিতে”। আমার সাথে বাংলাদেশ থেকে আরও ছয় জন শিক্ষার্থী। তারাও পড়তে এসেছে মস্কোতে। বাসে উঠলাম। বাস চলছে দ্রুত গতিতে। চার পাশে কল্পনার সেই জগত মূর্ত হয়ে উঠছে একের পর এক। যে দেশকে স্বপ্নে ভেবেছি সে দেশ এখন চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে তার দিগন্ত উন্মোচিত করে।



আগের অংশ পরের অংশ







Share on Facebook               Home Page             Published on: 22-Jan-2018

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far