bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব (১)
বদরুল আলম খান

পরের অংশ



এক

যশোরের কালীগঞ্জ বাজার থেকে কোটচাঁদপুর যাওয়ার প্রধান সড়কের দু ধার ঘেঁষে রয়েছে সারি সারি বৃক্ষরাজি। সারা বছর তারই ছায়ায় আধো আলো আধো অন্ধকার পরিবেশ বিরাজ করে। প্রচণ্ড রৌদ্রে পথচারীদের স্বস্তি দেয় এই বনাশ্রিত পরিসরটুকু। সাত কিলোমিটার যাওয়ার পর ডান হাতে পড়বে এলাঙ্গি নামের একটি গ্রাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বয়সে তখন তরুণ। সে কারণে সমস্যা ছিল দুদিক থেকে। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার ইচ্ছা অনেকবার ব্যক্ত করেছি। কিন্তু বাবার বাধায় সেটি হয়ে ওঠে নি। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রোশে পড়ারও শঙ্কা ছিল। সেই শঙ্কা বোধ থেকে আমাকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন বাবা এবং মা। মনে আছে তখনও ঘোর অন্ধকার। সূর্য ওঠার অনেক বাকি। মা একটি ব্যাগে কিছু খাবার এবং কাপড়চোপড় সযত্নে গুছিয়ে দিয়ে আমাকে বললো –“ যুদ্ধের কারণে তোকে এলাঙ্গি যেতে হবে। যুদ্ধ চলছে। সেখানেই থাকবে”। সিদ্ধান্তটি বাবা নিয়েছিলেন জায়গাটিকে নিরাপদ ভেবে। যুদ্ধের কারণে আমাদের পরিবার তখন গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। বাস ট্রেনে করে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি এবং আমার বাবা রওয়ানা হলাম পায়ে হেটে। ২৫ কিলোমিটার পথ। তখনও চারিদিক ঘোর অন্ধকার। হেটে চলেছি গ্রামের ধূলিময় রাস্তা দিয়ে। মাঝে মধ্যে উন্মুক্ত মাঠ, জলে ভরা খাল বিল। কৃষকের বাড়ির উঠানের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমার ক্লান্ত দুখানি পা। রাস্তার পাশে পোড়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। জিজ্ঞাসা করি “কারা পোড়াল”? উত্তর এলো “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গতকাল এসেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে”। অতি সন্তর্পণে পাক সেনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোথাও সোজা পথ কোথাও আঁকাবাঁকা পথ ধরে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে অবশেষে পৌঁছলাম এলাঙ্গি গ্রামে। এই গ্রামে বাবার মায়ের জন্মস্থান।

বাবার বয়স যখন দশ তখন আমার দাদি এবং দাদা দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। দাদির মৃত্যুটি ছিল আকস্মিক। ব্যাসিলারি আমাশয় নামের এক রোগে তিনি গত হয়েছিলেন দুই দিনের ব্যবধানে। সে সময় ঐ রোগের কোন ঔষধি প্রতিকার ছিল না। ফলে মারা গিয়েছিলেন যাকে বলে বিনা চিকিৎসায়। এ নিয়ে বাবার মনে দুঃখের সীমা ছিল না। মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে যখন তিনি মায়ের গল্প বলতেন তখন দেখতাম তার চোখ দুটো ছল ছল করছে। বাবার নানীমাকে আমি দেখেছি অনেক বার। তিনি দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন। একেবারে এক চিলতে শরীর। বয়স নব্বুই পঁচানব্বুই হবে। মুখের মাংস ঝুলে পড়েছে। চোখের দৃষ্টি নিথর। ধব ধবে সাদা শাড়ী পরে পরিসর সীমিত একটি ঘরে তার আশ্রয়। সারাদিন কাটিয়ে দিতেন বিছানার ওপর বসে। দুই পা এক সাথে করে হাত দুটো দুই হাঁটুর ওপর রেখে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। মাঝে মধ্যে মন্ত্র পড়ার মতো বিড় বিড় করতেন। নিজের সাথেই যেন কথা বলছেন। কখনও মনে হতো যেন কোন গভীর ধ্যানে মগ্ন। সেই মগ্নতা ভেঙ্গে যেতো ক্ষণিকে যখন কারও পায়ের শব্দ পেতেন। মাঝে মধ্যে দেখেছি শুয়ে আছেন। শোয়া বলে না। মায়ের গর্ভে শিশু যেভাবে মাথা এবং পা এক বিন্দুতে এনে শরীরটাকে ধনুকের মত বেঁকিয়ে রাখে ঠিক সেই রকম। ভাবি জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে কতই বা পার্থক্য! সন্দেহ বোধ করি প্রৌঢ়ত্ব আর শিশুকালের মধ্যে ব্যবধান বলে কিছু আছে কিনা। মাঝে মধ্যে তার পাশে গিয়ে আমি বসেছি। বসে থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেছি তার সান্নিধ্য। আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন কি আদর করে। ভেবেছি আমার দাদি মেহেরুন্নেছাকে আমি দেখিনি বটে। কিন্তু যিনি তার গর্ভধারিণী তার পাশেই তো বসে আছি আমি। যেন অনুভব করছি মেহেরুন্নেছার স্পর্শ। কেমন ছিলেন তিনি জানি না। তার কোন ছবিও নেই আমাদের পারিবারিক সংগ্রহে। কিন্তু বাবা বলতেন তার গায়ের রঙ ছিল এমনই ফরশা যে নীল রঙের শিরা উপশিরাগুলো দেখা যেতো সুস্পষ্ট ভাবে। বংশ মান সম্মান রক্তের যে ধারা এই বৃদ্ধার দেহে প্রবাহিত তার সাথে আমার সম্পৃক্ততার কথা ভেবে মন এক আবেগের স্রোতে ভেসে যেতো। ভাবলেশহীন ভাবে তার পাশে বসে আমি কাটাতাম দীর্ঘ মুহূর্ত।

এই নারীর স্নেহেই বড় হয়েছিলেন আমার বাবা। কিন্তু তার পরও কঠোর অনাথ জীবন তার মনের সব উষ্ণতা এবং জীবনের স্বাভাবিক প্রবণতাগুলি ধ্বংস করে দিয়েছিল অনেকটা অলক্ষ্যে। সেই নির্দয় মনজগত তার ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। আলাপ ব্যবহারে দেখেছি রুক্ষতার ছাপ। রাগি ছিলেন প্রবলভাবে। ছেলে মেয়েদের রাখতেন কঠোর শাসনের বাধনে। জীবনে অতি-মাত্রিক উচ্ছলতা কখনও পছন্দ করতেন না। মায়ের প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা। সেটি জেনেছি তার লেখা ডাইরির পাতায়। কিন্তু ভালবাসার সেই অনুভূতি প্রায়শ ভোতা হয়ে তার জায়গায় স্থান করে নিতো নির্মম কঠোরতা। যদি সততার কথা বলি তাহলে সেখানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। কোটচাঁদপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে তিনি পড়তে গিয়েছিলেন কলকাতার রিপন কলেজে। এই এলাঙ্গি গ্রামে ছোটবেলায় আমি এসেছি বহুবার। মানুষের মুখে শুনেছি বাবার ছোটবেলার নানা কাহিনী। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যে কটি মাস এখানে কাটিয়েছি সে সময়কে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বলে মনে করি। আজও মনে পড়ে বাবার মামাতো ভাইয়ের স্নেহ এবং আদর। এ যেন আত্মার টান। সেই টান আমাকে বহুবার বহু কারণে নিয়ে এসেছে এলাঙ্গি গ্রামের অতি কাছের কিছু মানুষের সান্নিধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা এখানেও কম বেশি উপলব্ধি করেছি। লক্ষ্য করেছি গ্রামের আশ পাশে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে সক্রিয় আছে। তাদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হয়েছি। একবার এখানে আশ্রয় নেওয়া এক বড় ভায়ের সাথে (তার নাম দুলাল) গিয়েছিলাম ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলতে। হাতে লোহার রড। সাথে একটি রেঞ্জ। সেই রেঞ্জ দিয়ে খুলতে চেষ্টা করেছিলাম ট্রেন লাইনের নাট বলটু। পারি নি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। সময়টি আমার জন্য ছিল আশা নিরাশার মধ্যে বাস করা। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনে ভরসায় বুক বেধেছি। আবার সব আশা ভরসা ভেসে গেছে মুক্তিযুদ্ধের কোন দুঃসংবাদ, ব্যর্থতা অথবা বিশেষ কোন মৃত্যু সংবাদে। দাদার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের টহল ছিল প্রায় প্রতিনিয়ত। সামরিক গাড়ির কনভয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে যেতো কোটচাঁদপুরের দিকে। আবার ফিরে যেতো যশোর ক্যান্টনমেন্টে। বাড়ির জানালা দিয়ে আড় চোখে তাদের চেহারা দেখেছি। জিপ গাড়ি থামিয়ে মাঝে মধ্যে তারা রাস্তার দু পাশে হেটে চলা মানুষকে জিজ্ঞেসবাদ করতো। দুই একজনকে তুলে নিতো জীপে। উত্তেজনা ভীতি আশংকা - সব মিলিয়ে কেটে গেছে ঐ কয়েক মাস। একদিন দেখি বাবার সর্বকনিষ্ঠ মামাতো ভাই উধাও। কেউ জানে না কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন তিনি। পরে জানা গেল পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পে। এলাঙ্গি গ্রামে এ ধরনের ঘটনা তেমন ঘটতে শুনিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যতই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে পাকিস্তানি সেনারা ততই হয়ে উঠেছে মরিয়া।

১৯৭১ সালের ১২ই ডিসেম্বর। দিনটির কথা ঠিক মনে আছে। দুপুরে হঠাৎ রটে গেল পাকিস্তানি সেনারা কালীগঞ্জ বাজার থেকে অগ্রসর হচ্ছে কোটচাঁদপুরের দিকে। আমরা পালাচ্ছি। মাঠ অতিক্রম করে যাচ্ছি পাশের গ্রাম গুড়পাড়ায়। মাঠ পার হতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। পাকিস্তানি মর্টার আক্রমণ চলছে মাঝে মধ্যে। মনে হচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে উড়ছে মর্টার। তার বিকট শব্দ আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। মাটিতে শুয়ে জীবন বাঁচানর চেষ্টা করলাম। উপরে নীল আকাশ। চারিদিকে শীতের শষ্যহীন খালি মাঠ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় প্রাণ নিয়ে পালানোর চেষ্টা। আমার সাথে ছিল আমার দুই বোন এবং বাবা। রাত কাটলো প্রায় না ঘুমিয়ে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চললো রাত ভর। ঘুম আসে না। উঠানে সবাই জড় হয়ে বসে আছি। বাবা ভয়ে সন্ত্রস্ত। কি হবে দুই যুবতী মেয়েকে নিয়ে। যদি পাক সেনারা এই গ্রাম আক্রমণ করে? কি হবে আমার মতো যুবককে নিয়ে। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে ভাবি নানা কথা। ভোরের দিকে গোলাগুলি থেমে এলো। সকালে উঠে দাদার বাড়ির দিকে এগুচ্ছি। পুকুরের ধারে পৌঁছে দেখি এক ভারতীয় শিখ সেনার মৃতদেহ গোলার আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া নারকেল গাছের একেবারে গোঁড়ায় শায়িত অবস্থায় আছে। দেহে প্রাণ নেই। বুকের জায়গাটিতে চাপ চাপ রক্ত। পা নেই। হাতে তখনও বন্দুকটি ধরা। ভাবি কোথায় কোন সুদূর পাঞ্জাব থেকে আসা এই তরুণ সেনা। দেহটি পড়ে আছে এই গ্রামের মাটিতে। বাবা মা পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন জানলো না বাংলার প্রত্যন্ত এই গ্রামে চির-শায়িত আছে তাদের সন্তান, ভাই, স্বামী বা আর কেউ। বাংলার মাটিকে মুক্ত করতে গিয়ে জীবন দিল অকৃপণ হাতে।

দাদার বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। দেখি পিচ ঢালা রাস্তার ওপর লাশের ছড়াছড়ি। নানা ধরনের অস্ত্র শস্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। পাকিস্তানি সেনাদের নিথর দেহ। মাঝে মধ্যে ভারতীয় সেনার মৃতদেহ পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায় কালভারটের নিচে অথবা পাশে বিলের পানিতে। হঠাৎ দেখি আহত এক পাকিস্তানি সেনা মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখে মুখে আতঙ্ক। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে আটক করেছে গত রাতে। আশ পাশে পাকিস্তান বাহিনীর কোন চিহ্ন নেই। বুঝি দলছুট হয়ে অবধারিত মৃত্যুর মুখে সে এখন দাড়িয়ে। সবার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। দৃশ্যটি কেন জানি আমার দুর্বিষহ মনে হল। স্থান ত্যাগ করে আমি চলে এলাম বাড়িতে। জানি না কি হয়েছিল পরে। তবে দুপুর গড়াতেই দেখি শত শত ভারতীয় সেনা কোটচাঁদপুরের দিক থেকে এলাঙ্গি গ্রামে এসে হাজির। বুঝতে বাকি নেই তারা এসেছে ভারতের ধরমপুর এবং পুটিখালি সীমান্ত অতিক্রম করে জীবননগর বৌদ্যনাথপুর হয়ে কোটচাঁদপুর এবং এলাঙ্গি গ্রামে। এসেই তারা দখল করে নিল স্কুলের মাঠটি। দাদার দোতলা বাড়ি হঠাৎ পরিণত হলো ভারতীয় বাহিনীর কম্যান্ড পোস্টে। দুপুর গড়াতেই দেখি ভারতীয় বিমান বাহিনীর জেট বিকট গর্জন করে ছুটে চলেছে কালীগঞ্জের দিকে। দুই মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। বুঝতে বাকি রইলো না বোমাটি পড়েছে কালীগঞ্জ সুগার মিলের উপরে অথবা কাছাকাছি কোথাও। জানতাম সেখানে রয়েছে পাক সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাটি। কুণ্ডলী পাকিয়ে কমলা রঙের ধোঁয়া উড়ছে আকাশে। স্বাধীনতার যে বেশি বাকি নেই- সেটি বুঝতে দেরি হল না।

আমার মায়ের মামাতো ভাই আব্দুর রাজ্জাক যুদ্ধ চলাকালে একটি বই আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। চাচা পেশায় ছিলেন উকিল। কিন্তু ওকালতির চেয়ে তার মন ছিল রাজনীতিতে। বিশ্ব ইতিহাসের ওপর তার ছিল প্রচণ্ড দখল। এমনিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণী নিয়ে বের হন নি। আর বিশেষ জ্ঞান ছিল গাছপালার ওপর। প্রায় সব গাছের ল্যাটিন নাম তিনি জানতেন। তার সাথে রাস্তায় হাটতে গিয়ে প্রায় বিব্রত বোধ করেছি। “বল তো এই গাছের নাম কি”? দুই আঙ্গুলের ফাকে সিগারেট চেপে বুকের ধোঁয়ার সবটুকু নাকের দুই বহির্গমন দিয়ে বের করতেন। মনে হতো যেন বাষ্পচালিত ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে বেরুচ্ছে সেই ধোঁয়া। চাচার বড় ভাই ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষাও জানতেন। শুনেছি কিছুকাল প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলিকে কাবুলে থাকাকালীন ফারসি ভাষা শিখিয়েছিলেন। বিলেতে যাওয়ার পথে থেমেছিলেন আফগানিস্তানে। ইরানেও কাটিয়েছিলেন কয়েক মাস। সেখানে রেজা শাহ পাহলবী পরিবারের কাউকে ইংরেজি শিখিয়েছিলেন বলেও শুনেছি। আমার বাবার সাথে আড্ডায় চাচা সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্প করতেন। গল্প বলতেন নানা ঢঙ্গে। বলতেন – “এই না হলে দেশ! সুখী সমাজ হতে গেলে আমাদের দেশকেও গড়তে হবে ঐ ভাবে”। বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারে তার ছিল অতুলনীয় প্রতিভা। বাম রাজনীতি করতে গিয়ে একবার তিনি যশোর থেকে কলকাতা গিয়েছিলেন পায়ে হেটে। সে ব্রিটিশ আমলের কথা। শুনেছি তাকে বহুবার রাত কাটাতে হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামের কোন মসজিদ বা কৃষকের গৃহে। তখন পাকিস্তান আমল। কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। চাচাও আত্মগোপনে। বাম রাজনীতির সে এক দুর্যোগময় সময়। চাচা নিজের কথা ভুলে মানুষের উপকার করতে চাইতেন। নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের প্রখ্যাত কৃষক নেতার মৃত্যুর পর চাচা তার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন স্বেচ্ছায়। নানা সংকট থেকে পরিবারটিকে মুক্ত রাখাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তারপর থেকে নড়াইলে বাড়ি করে সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেন যদিও তার ওকালতি ছিল যশোর শহরে। চাচার মুখে শুনেছি আরো অনেক গল্প। আত্মগোপন-কালে প্রখ্যাত লেখক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সত্যেন সেনের সাথে সখ্যতা ছিল। একটি গল্প তিনি একবার আমাকে শুনিয়েছিলেন। কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সত্যেনদাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন গোপনে পার্টির নেতৃস্থানীয় একজনের কাছে পৌঁছে দিতে। খামটি তিনি রেখেছিলেন বগল দাবা করে। সেটি নাকি হারিয়ে গিয়েছিল পথে। যে বইটি তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন তার রঙ মেটে। সাইজে বেশ মোটা। নিউজ প্রিন্টে ছাপা। উপরে লেখা “প্রশ্নোত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন”। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বইটির পাতা উলটেছি বহুবার। দাদার বাড়ির দোতলার ছাদে বসে। যুদ্ধ চলাকালে শুনেছিলাম সপ্তম নৌবহরের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিসিঞ্জারের কুটিল রাজনীতি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রায় থামিয়ে দিয়েছিল যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে এসে না দাঁড়াতো। ফলে সহানুভূতির এক বিস্তীর্ণ ভুবন ঐ দেশকে ঘিরে আমার মনোজগতে স্থান করে নিয়েছিল। পরবর্তীতে সেটি আরও শিলায়িত হয়েছিল ঐ বইটি পড়ে। নানা ধরনের প্রশ্ন ও উত্তর ছিল বইটির প্রতিটি পাতায়। অক্টোবর বিপ্লবের কথা, লেনিনের কথা, প্রতিবিপ্লবীদের কথা, সোভিয়েত রাষ্ট্র গঠনের কথা, সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কথা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা। আমার জ্যেষ্ঠ বোনকে প্রায়ই বলতাম “দেখিস একদিন আমিও যাবো ঐ দেশে। দেখে আসব দেশটি কেমন।”



পরের অংশ







Share on Facebook               Home Page             Published on: 22-Jan-2018

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far