“গুড মর্নিং বাংলাদেশ” বিগেস্ট মর্নিং টি ইভেন্ট, সিডনীবাসী বাংলাদেশীদের একটি সফল আয়োজন।
আজাদ আলম: মে মাসটা ছিল ক্যান্সার কাউন্সিল ফান্ড রেইজিং আয়োজকদের জন্য একটি বিশেষ স্মরণীয় মাস। “বিগেস্ট মর্নিং টি” মরণ ব্যাধি ক্যান্সার নিরাময়ের ব্যয়বহুল রিসার্চের জন্য অর্থ সংগ্রহের একটি সেবামূলক ক্যাম্পেইন। সারা অস্ট্রেলিয়া ব্যাপী স্কুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যেমন বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে, চকলেট বিক্রি করে পয়সা তুলে তেমনি বড় বড় কোম্পানির মালিকেরাও চা চক্রের আয়োজন করে এই মহৎ কাজের জন্য পয়সা তোলার ব্যবস্থা করেন। এমনকি বাসায় বাসায় এর নামে টিনের বাক্সে খুচরো পয়সা জমা করে ক্যান্সার কাউন্সিলের ফান্ডে জমা দেন অনেক পরিবার।
সিডনিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও সাড়া দিয়েছেন সহজাত মানসিকতার কারণেই। এই মানবিক কাজে যোগ দিয়েছেন এই ক্যাম্পেইনের প্রায় গোরা থেকেই। গত ১৪ বছরের মত এবারেও মে মাসের ৩, ১০, ১৭ এবং ২৪ তারিখের এই চার রবিবারে সিডনিতে আয়োজিত হলো “গুড মর্নিং বাংলাদেশ”, “বিগেস্ট মর্নিং টি” বাংলাদেশি স্টাইলে। নিউ সাউথ ওয়েলস ক্যান্সার কাউন্সিলের জন্য অর্থ সংগ্রহে প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবারের এই মহৎ উদ্যোগের কথা শুধু বাংলাদেশিদের মুখে মুখে নয় এর গুণগান লোকাল এরিয়ার লোকজন তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও এখন গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেন, প্রশংসা করেন, উদাহরণ টানেন। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল পার্লামেন্টেও বাংলাদেশী কমুনিটির এই সফল উদ্যোগ প্রশংসিত হয়। ২০০১ সালে যে প্রোগ্রামটি সিডনীর পশ্চিমাঞ্চল ব্ল্যাক-টাউনে মাত্র ৮০০ ডলারের নিচে সংগ্রহ করে, সেই একই প্রোগ্রাম আজ ২০১৫ সালে এসে তাঁদের সংগ্রহের খাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন সর্বমোট এক লক্ষ বিশ হাজার ডলারের বেশি। এ বছরেই ফান্ড রেইজিং এর পরিমাণ ২২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। বলতে গেলে এই বিশাল সংগ্রহের প্রায় পুরোটাই সিডনীতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের বদান্যতার ফসল। ঐক্যবদ্ধতা, নিরলস, নিঃস্বার্থ এবং নিরন্তর প্রচেষ্টার এটি হল একটি প্রকৃষ্ট নমুনা।
ক্যান্সার কাউন্সিলের সিইও জিম এল এস্ট্রেংজ এবং মেডিক্যাল ডাইরেক্টর মনিকা রবটিনের সাথে আয়োজকরা
সিডনীর চার ভেনুতে চার রোববারে আয়োজিত হয় এই সকালের নাস্তার আয়োজন ‘‘গুড মর্নিং বাংলাদেশ” এই ব্যানারে। শহরের পশ্চিমাঞ্চল ব্ল্যাক টাউন এবং ইঙ্গেলবার্নে দুটি, মধ্যাঞ্চল লাকেম্বায় একটি এবং পূর্বাঞ্চল ম্যাস্কট সাবার্বে আর একটি। প্রতিটি ভেনুতেই সকাল নয়টা থেকেই আসতে শুরু করেন আশে পাশের লোকজনেরা। হরেক রকমের চা, পেঁয়াজু এবং পুরি ততক্ষণে রেডি প্রায়। হাতে বানানো পরোটা আর ভাজির জন্য লাইনে থাকেন অনেকেই। ভুনা মাংস তো আছেই। সকাল ৯ টা থেকেই অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ অংশগ্রহণকারী আর ক্রেতা দর্শকদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে। সদ্য ভাজা পরোটা,সদ্য হাড়ি থেকে নামানো ভাজি, মাংস আর গরম গরম ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা,সিঙ্গারা, বিফ পেস্ট্রির গন্ধে ভরপুর থাকে প্রতিটি সেন্টার। মিষ্টি প্রিয় বাঙ্গালিদের হরেক রকমের মিষ্টি চমচম, জিলাপি, রসগোল্লা, রস মালাই, মুখ পাখন, পাটি সাপ্টা, তেলের পিঠা, নারিকেলের পিঠা ইত্যাদি তো আছেই। এই সমস্ত খাবারের আয়োজনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তারা হলেন স্থানীয় মহিলা মহল। তারা সবাই শতভাগ উৎসাহ আনন্দ নিয়ে অংশ গ্রহণ করেন এই ফান্ড রেইজিং অনুষ্ঠানে, মহৎ উদ্দেশ্যে। অনেক রাত জেগে পিঠা পুলি মিষ্টি তৈরি করেন। সকালে উঠে আবার সেগুলো নিয়ে ভেনুতে আসেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করেন এবং সমুদয় অর্থ খুশি মনে দিয়ে দেন ক্যান্সার কাউন্সিলের তহবিলে।
চলছে পরিবেশনা
প্রতিটি আয়োজনে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা ছাড়াও ক্যান্সার কাউন্সিলের পরিচালক মণ্ডলের অনেকেই আসেন বাংলাদেশীদের উৎসাহ যোগাতে, ধন্যবাদ জানাতে। এবারে সময় করে এসেছিলেন ক্যান্সার কাউন্সিলের সিইও জিম এল এস্টেরেঞ্জ ম্যাস্কটের অনুষ্ঠানে। তিনি বেশ গর্বের সাথেই স্বীকার করলেন, বাংলাদেশীদের এই নিঃস্বার্থ সহযোগিতার কথা। বাংলাদেশি কমুনিটি ছোট হলেও এই কমুনিটিতে বড় হৃদয়ের মানুষের সংখ্যা যে অনেক তা এই অকৃপণ বিশাল আয়োজনই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। ব্লাকটাউন, লাকেম্বা এবং ইঙ্গেলবার্নের অনুষ্ঠানেও লোকাল এম পি রা বাংলাদেশীদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং কেউ কেউ মনে করেন এ রকম সুন্দর সফল আয়োজন অনুকরণ যোগ্য।
ব্ল্যাকটাউনের অনুষ্ঠানে ফেডারেল এম পি জুলি ওয়েন এবং এড হিউসিক, ইঙ্গেল্বার্নের আয়োজনে ফেডারেল এম পি লাউরি ফারগুসন, লাকেম্বার অনুষ্ঠানে ফেডারেল এম পি টনি বার্ক এবং ম্যাস্কটের ফাঙ্কশনে ফেডারেল এম পি ম্যাট থিসেলথওয়েট অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও প্রতিটি অনুষ্ঠানে ষ্টেট এম পি রাও আসেন।
স্থানীয় বাংলাদেশি নেতৃবর্গের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে সম্মিলিত নিঃস্বার্থ অংশগ্রহণের কথা। দল মত ধর্ম নির্বিশেষে, সবার সার্বিক অংশগ্রহণ এবং তার সফল ফলাফল প্রমাণ করে আমরা চাইলেই দেশের জন্যও অনেক বড় বড় জনহিতকর কাজের অর্থ সংগ্রহ করতে পারি। এ প্রসঙ্গে ঢাকায় আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালের কথা উল্লেখিত হয়। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের বিরাট অবদানে আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। গরিব দুঃখী ক্যান্সার রোগীদের বিনা অর্থে সেবার কাজ চলছে পুরোদমে। “বিগেস্ট মর্নিং টি” এর পুরোধা ডঃ আব্দুল হক এবং ডাক্তার আয়াজ চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশীদের আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালে অবদানের কথা গর্বের সাথে উল্লেখ করেন। ভবিষ্যতেও যেন আমরা এরকম কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসি এ আহবান জানান। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীদের এই স্পিরিট, এই একতা এবং মানসিকতার মূল্য অনেক বেশী। দশে মিলে কাজ করার এই ফসল, এই সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে অদূর ভবিষ্যতে সিডনিতে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য কোন কার্যক্রম হাতে নেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে ভাবনা চিন্তার সময় এসেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশি কমুনিটির বিশিষ্ট বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব জনাব মোস্তফা আব্দুল্লাহ।
বিদেশের মাটিতে আস্তানা গেঁড়ে, চাকরি বা ব্যবসা করে দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে প্রবাসীরা যেমন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করছেন ঠিক তেমনি এমন দৃষ্টান্তের সেবা মূলক কাজে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও উজ্জ্বল করছেন দেশ ছেড়ে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি শেষে হাসিমুখ
|