সুজন-নাদিয়ার খাট / আজাদ আলম
আগের অংশ
সুজনেরা কি জমিদারের বংশধর? আমার খটকা লেগেছিল অন্য আরো একটা কারণে, কেন স্রেফ খাটের ছবি? এমন না যে বাসর রাতের সাজানো পালঙ্কে সুজন এবং নাদিয়া বসে আছে-তার ফটোগ্রাফ। সুজনকে প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না, “কি ব্যাপার সুজন, সাড়া ঘরে শুধু এক পালঙ্কের ছবি? এ ছবিটাতে বর-কনে মানে তোমরাও নেই, রহস্যটা কি?”
“কাহিনী একটা আছে চাচা, লম্বা সে কাহিনী, খাওয়ার টেবিলে বসেই গল্পটা বলি”।
আদ্যোপান্ত প্রেমাচ্ছন্ন জীবনী শোনার পর খাটটির নাম দিয়েছিলাম, সুজন-নাদিয়ার খাট। সবাই এক প্রস্থ হেসে নিয়েছিল এত সুন্দর নামকরণের জন্য। রসিকতা করে বলেছিলাম, “বাহ, এ কাহিনী তো দেখি কবি জসিম উদ্দিনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ লোকগাথাকেও হারিয়ে দিল।” আবার শুরু হয়েছিল এক দীর্ঘ শব্দময় হাসির হুল্লোড়। নাদিয়া তার সশব্দ হাসি থামাতে না পেরে বাথরুমে লক আটকে হেসেছিল অনেকক্ষণ। সেগুন কাঠের এই মজবুত খাটটি অপূর্ব নিখুঁত নকশা মণ্ডিত। খাটের মাথার দিকে যেটাকে আমরা বেড হেড বলি তার দুইপাশে দুই ময়ূরীর দুই ঠোঁট উঁচু হয়ে মিলেছে একদম মাঝ বরাবর। পায়ের দিকটাতেও একই নকশা। খাটের পা গুলো সিলিন্ড্রিকাল। পুরো পায়া জুড়েই খোদাই করা মসৃণ এবং পরিপাটি পান পাতার নকশা। বেশ কষ্ট পেয়েছিল সুজন তার প্রিয় বস্তুটিকে সেবার আনতে না পেরে। নিয়ে আসার সব ব্যবস্থাই করেছিল সে। বাবার অনুরোধে রেখে আসতে হয়। বাবার যুক্তি, “অস্থায়ী যেখানে তোমার অবস্থান সেখানে সুন্দর স্থায়ী আসবাব পত্রটি টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাওয়ার মত নস্টালজিয়া না থাকাই শ্রেয়।”
এই পালঙ্কের ইতিহাস, সুজনদের পরিবার এবং তার গ্রামের এককালের জমিদার পরিবারের বন্ধুত্বের সুতায় গ্রথিত। বৃটিশ আমলের এই খাটটি একসময় জমিদার চন্দ্র শেখর বাবুর শোয়ার ঘরের শোভা বর্ধন করত। সুজনের পিতামহ ওমর আলি এবং জমিদার চন্দ্রশেখর বলতে একসাথেই বেড়ে উঠে। একই পাঠশালায় তাদের পড়ালেখার হাতে খড়ি। ওমর আলি জমিদারের প্রজা সত্বেও চন্দ্র বাবুর সাথে সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। হৃদ্যতার জন্ম নেয় পাঠশালা থেকেই। চন্দ্র শেখর ছোট বাবু নামে সবার প্রিয় ছিলেন। উত্তরবঙ্গের নাম করা জমিদার হৃশি কেশর বাবুর ছোট ছেলে চন্দ্র কেশর বাবু ছিলেন সুশীল জমিদার। প্রজাদের সাথে কথা বলতেন কম। ছোট ছোট বাক্যে সবার আবদারের উত্তর দিতেন মেপে মেপে। মুখ খুলে আবদারের আগেই বুঝে নিতেন প্রজারা কি বলতে চায় এবং তাই কথা না বাড়িয়ে আবদার মেটানোর ব্যবস্থা করতেন সম্ভব হলে। গম্ভীর রাশ ভারী জমিদার যে প্রজাদের এত প্রিয়ভাজন হতে পারে, ছোট বাবু তার প্রমাণ রেখেছিলেন সেই এলাকায়। ছোট বাবুর কাছে ব্যতিক্রম ছিল ওমর আলি। সুজনের দাদা। গল্পের পর গল্প করে চলতেন দুজনে। অনেক সময় সারা রাত ধরে গল্প করতেন। অকালে স্ত্রী বিয়োগ হলে দ্বিতীয়বার পাত্রস্থ হন নি ছোট বাবু। ওমর আলী অনেকবার অনুরোধ করছিলেন বন্ধুকে আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে। বংশের বাতি জ্বালিয়ে রাখতেও তো সন্তান সন্ততি দরকার। কাজ হয় নি। চন্দ্র শেখরের একটাই ইস্পাত কঠিন যুক্তি এতে স্বর্গীয় বাসন্তী রানীর ভালবাসার অমর্যাদা হবে। নিঃসন্তান জমিদার বিশাল জমিদারীর উত্তরসূরির অভাব পূরণের তাগিদও অনুভব করেন নি। ছোট বাবু এই সেই পালঙ্কে হেলান দিয়ে তামাক সেবন করতেন আর ওমর আলির সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন।
ভারত বিভাগের সময় জমিদার বাড়ির সবাই ভারতে চলে গেলেও ছোট বাবু থেকে যেতে চেয়েছিলেন। শেষমেশ তা হয় নি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। যাওয়ার প্রাক্কালে ওমর আলীর হাত ধরে অনুরোধ করে ছোটবাবু, “ওমর, তোমার জন্যে একটা উপহার রেখে যেতে চাই এক শর্তে। এই যে এই পালঙ্ক তুমি দেখছো, এটা আমি পেয়েছিলাম বংশের ছোট সন্তান হিসেবে। আমার দাদার বিয়েতে উপহার পেয়েছিলেন দাদী এই সেগুন কাঠের পালঙ্ক। দাদার মৃত্যুর পরে আমার বাবা পান ছোট সন্তান হিসেবে। দাদাই এই নিয়ম করে গেছেন। পরিবারের যে সব চেয়ে ছোট তার দখলেই থাকবে এই বিছানাটি। আমার তো ছেলে মেয়ে নেই। তাই আমি এই খাটটি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই বন্ধুত্বের নিশানা হিসেবে।” অনেক অনুনয় করেছিল দাদা ঐতিহ্য বাহী এই আসবাবটি যাতে ছোট বাবু নিয়ে যান ওপারে। কাজ হয় নি তাতে। ছোট বাবুর অনুরোধ ছিল আরো বেশি শক্ত। “তুমি তো জানই আমার কোন ছেলে মেয়ে নেই, তোমার ছেলে মেয়েদের আমি অনেক স্নেহ করি, ভালবাসি। তারাই একদিন এই পালঙ্ক এবং এর ইতিহাস বয়ে নিয়ে বেড়াবে গর্বের সাথ- আনন্দের সাথে। আমাদের বন্ধুত্বের শক্ত বন্ধন হয়ত এই পালঙ্কের মধ্য দিয়ে অটুট থাকবে। এই পালঙ্কই হোক আমাদের আগামী হাজার বছরের সেতু বন্ধন। আশা করি তুমি না করবে না।” কথাগুলো শেষ করে ছোট বাবু হাত চেপে ধরেছিলেন বন্ধু ওমর আলীর। ওমর আলির মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোই নি সেই রাতে। প্রিয় বন্ধু চলে যাচ্ছে নিজের রাজ্য ছেড়ে- জমিদারী ছেড়ে। রেখে যেতে চাইছে এক হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার স্মৃতি-চিহ্ন।
এক গভীর রাতে ছোট বাবু নিজেই এসে পালঙ্ক টি দিয়ে যান ওমর আলীর বাড়িতে। ওমর আলী যত্নের সাথে আগলে রেখেছিলেন বন্ধুত্বের এই নিশানা। বছর বছর পালিশ করে উজ্জ্বল পরিপাটী রেখেছেন পালঙ্কের চেহারা। এতটুকু জৌলুস কমতে দেয় নি ওমর আলী। তার ছোট সন্তান, সুজনের বাবা, আহাদ আলীর সংসারে আসে এ পালঙ্ক। কথা রেখেছেন সবাই। কেউই এর যত্ন আত্তির সামান্যতম অবহেলা করে নি। সুজন তন্ময় হয়ে শুনেছে এ কাহিনী দাদা ওমর আলির মুখ থেকে। দাদার ভরাট দরদ মাখা গলায় এই স্মৃতিচারণ শোনার দিন থেকেই সুজন এই পালঙ্কের প্রেমে পরে যায়। এই পালঙ্কের মালিক হওয়ার মানসে কতবার যে তার কচি মন মোনাজাত করেছে, “হে আল্লাহ, আমিই যেন বাবার ছোট ছেলে হয়ে থাকি।” সুজন তার এ বাসনার কথা বেশ আনন্দের সাথেই ফাঁস করে দিল। পালঙ্ক বিষয়ক সব কিছুই তার অহংকার, তার ভালবাসা। এ যেন তার এক খণ্ড জমিদারিত্ব- এক বিশাল প্রাপ্তি।
“আমি থাকবো না- কিন্তু থাকবে আমার দেশের সেগুন কাঠের এই পালঙ্ক। আমার ছোট সন্তানের ঘরে ঠাঁই হবে এই ইতিহাসের। দেশে হয়ত এরা যাবে না তার পরেও এই পালঙ্কের কথা মনে হলে ভাববে এইতো আমরা দেশের বিছানায় শুয়ে আছি। এই তো এক খণ্ড বাংলাদেশ আমাদের সাথে লেপটে আছে।” কথাগুলো শেষ করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিল সুজন। আবেগের বশে অনেক কথাই বলে ফেলেছে। রাত অনেক হয়েছে। সুজনের ছোট ছেলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বিশাল পালঙ্কে- আড়াআড়ি ভাবে। পরিতৃপ্তির ঘুম দিচ্ছে। এই পালঙ্কের উত্তরাধিকারী হয়ত: সেই-ই হবে। ফ্যামিলিতে সেই এখনও ছোট। বড় ছেলে ঘুমায় নি। বাবার কোলে মাথা না রাখলে সে ঘুমাতে পারে না। বিছানার আর এক পাশে আধা শোয়া হয়ে গেমবয় খেলছে ও।
সুজন এখনো একজন খাটি দেশ প্রেমিক। জানি, পালঙ্কের যত্ন পুরোপুরি নিবে ও - যেমন নিয়েছিল ওর পূর্ব পুরুষেরা। একই মাটিতে বেড়ে ওঠা- একই বর্ণের- দুই ধর্মের- দুই বন্ধুর সৌহার্দ স্মৃতি মাখা অমূল্য এই সম্পদ সযত্নে রাখবে সুজন, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তার অবর্তমানে উত্তসুরিরা এর সুরত-হাল কি রকম রাখবে তা নির্ভর করছে সুজনদের উপর। কতটুকু দেশপ্রেম ভালবাসার বীজ পুতে দিতে পারবে ছেলেমেয়েদের মানস-পটে সেটাই হবে মাপকাঠি।
কঠিন বিষয়। যাদের শেকড় উপড়ে ফেলে নিয়ে এসে আর এক ভিন মাটিতে রোপণ করছি, তারা বাংলাদেশের সোঁদা গন্ধ মাটির মৌলিক উপাদানগুলো নিয়ে বেড়ে উঠছে তো!
আগের অংশ
আজাদ আলম, সিডনি
|