গানে গানে গভীর রাত রাজা বশিরের ঘরোয়া সংগীত সন্ধ্যা আজাদ আলম
২৫ শে জুলাই ২০১৫। রাত আটটায় আসরের শুরু এবং গভীর রাত একটার পর সমাপ্তি। মাঝে মিনিট ২০ এর চা বিরতি। কোন মোবাইল ফোনের শব্দ নেই, বাচ্চাদের কোন কান্না নেই। সুনসান মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছেন আর করতালি দিয়ে তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ জানাচ্ছেন ঘর-ভর্তি শ্রোতামন্ডলী। শিল্পীদের বিশেষ করে প্রধান শিল্পীর শৈল্পিক কারিশমায় সুধী জনেরা সবাই ভাসছিলেন অনাবিল আনন্দ বিলে। এই ছিল সে রাতের আসরের সারাংশ।
বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত প্রয়াত শিল্পী বশির আহমেদ ছিলেন ষাট থেকে আশির দশকের চিত্র জগতের প্রথম সারির প্লে ব্যাক শিল্পী। কি বাংলা ছবি বা উর্দু ছবির। তাঁরই সুযোগ্য সন্তান সদালাপী রাজা বশির গাইলেন বাবার গাওয়া বিখ্যাত সব গান গুলো। উপহার দিলেন প্রাণবন্ত মনোমুগ্ধকর সংগীত সন্ধ্যার। তার এ গানের মঞ্চ অলংকৃত করে রেখেছিলেন আরও বেশ কিছু পরিচিত এবং কম পরিচিত শিল্পী মুখ।
রাজা বশির প্রয়াত বাবা ও মাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বাবার বিখ্যাত দেশ প্রেমের গান "আল্লাহ এ দেশ তোমারি দান" দিয়ে শুরু করেন গানের জলসা। মাতৃভূমির প্রতি পরম ভালোবাসায় সিক্ত গানের কথাগুলো গেঁথে গেল সবার হৃদয়ে। দ্বিতীয় গান ছিল" সন্ধান "ছবির গান বিখ্যাত গীতিকার আনোয়ার পারভেজের লেখা "খুঁজে খুঁজে জনম গেল কাঁদল শুধু এই আঁখি"। এর পরের গান "ময়নামতি" ছবির। গাজী মাজহারুল আনোয়ার লেখা এবং সুরে "ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না, দুরে আছি সেই ভালো কাছে ডেকো না। " এর পরের দুটো গান ছিল বাংলাদেশের কিংবদন্তী গীতিকার ও সুরকার খান আতার। "আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো ,ঢালো আরো ব্যথা ঢালো, জ্বালো আগুন আরো জ্বালো। "এবং " পিঞ্জর খুলে দিয়েছি। যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি। যারে যাবি যদি যা"। বশির আহমেদের জনপ্রিয় এ গানগুলোর সাথে আমরা যারা বড় হয়েছি তারা সবাই যেন ফিরে গিয়েছিলাম ৭০ বা ৮০ র দশকের চলচ্চিত্র গানের অনুরোধের আসরে। গানের ফাঁকে ফাঁকে বাবা মায়ের সাথে জড়িয়ে থাকা খণ্ড কিছু কথা, কিছু স্মৃতি টানছিলেন রাজা বশির। বাবা মায়ের ভালবাসার প্রকাশও ঘটেছিল গানের মধ্য দিয়ে। গাইলেন বাবার প্রিয় গান। মা মিনা বশিরের উদ্দেশ্যে গাওয়া এই গান রাজা বশির নিবেদন করলেন শ্রোতার সাড়িতে আসীন প্রিয়তমা রুনা বশিরকে। "যে আমার কবিতা, যে আমার গানে, যে আমার সুর যে আমার তালে তুমি কি সেই।" প্রচুর করতালির মাধ্যমে শিল্পী দম্পতির প্রেমালাপকে স্বাগত: জানালেন দর্শকবৃন্দ।
চা নাস্তা বিরতির পর আবার গানের পালা। এবারে স্থানীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সুদীপ্তা গাইলেন, "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি" এবং আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান"। সুদীপ্তার সুন্দর পরিবেশনা আসরের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। আমাদের মাঝেই এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল যে এই শিল্পী জানি নাই। হয়তোবা আমাদেরই ঘাটতি। খুঁজি নি আগে।
শিল্পী এহসান রেজা পলক গাইলেন দুটো নজরুলের গান। "মোরে আদর দিয়ে ভুলিও না, পাওয়ার আশায় ভুলিও। আঘাত দিয়ে তুলিও"। " কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে আসলে, আমার কথার ফুল গো আমার গানের মালা গো। " শিল্পী পলক কে অনেকেই মামা বলে চিনেন। ওনার প্রায় সমবয়সী ভক্ত ভাগ্নেদের অনুরোধে উনি আবার গাইবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আহবান জানালেন পরবর্তী শিল্পী রবিন কে। এতক্ষণ গিটার বাজাচ্ছিল রবিন। রবিন রাজবংশী বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর ছেলে। বাবার স্মৃতিচারণ করে ভাষার উপরে লেখা বিখ্যাত গানটি উপহার দিলেন সবাইকে। "মাটি কান্দে মায়ের দুঃখে, বেটির দুঃখে বাপে কান্দে। এই ফাগুনে হারাইছে যে তার সোনা মানিক চান্দে রে "। সুললিত কণ্ঠে দরদে ভরা এই গানটির শেষে মনের অজান্তেই চোখের কোনে পানি এসে গেলো। দর্শকদের অনুরোধে রবীন গাইলেন বিজয় সরকারের লেখা মরমি গানটি, যে গানটি একসময় গ্রামে গঞ্জে শহরে অনেকের গলায় শোনা যেত। "এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে"। রবীন রাজবংশীর দরাজ গলায় এই পরম সত্য বানী গুলো যেন ঠাণ্ডা পরশ বুলিয়ে দিল সবার মনে।
আবারও রাজা বশির আসলেন গানের ডালি নিয়ে। ময়না মতি ছবির হৃদয় ছোঁয়া গান, "অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়, মিছে আমি শিকল দিলাম রাঙ্গা দুটো পায়"। এ গানের প্রথম এই দুটো কলি জানে না এমন লোক কমই ছিল বাংলাদেশে। ৬৯ সালে ময়না মতি ছবি রিলিজের পর এ গান ছিল প্রেমের বিরহ গানের রাজা। এবং রাজা বশিরের কণ্ঠে উপস্থিত সবাই খুঁজে পেল যেন প্রায় অর্ধ শতাব্দীর আগেকার সেই গাওয়া গলাটি। তুমুল করতালির মাধ্যমে দর্শকেরা সেটি জানাতে ভুললেন না। গানটি গাওয়ার পর রাজা বশির ফিরে গেলেন ২০০৩ সালের এক ঘটনায়। স্মৃতি চারণ কিছুটা। বশির আহমেদ এই গানটি গান শেষবারের মত তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের আসরে। মেয়ে যে তার ময়না, অনেক আদরের পোষা ময়না পাখী। এতদিনের মায়া মমতার শিকল ছিরে চলে যাচ্ছে পরের বাড়িতে। এরপর তিনি এ গান আর গান নি হয়তবা গাইতে পারেন নি।
রাজা বশির গেয়েই চলেছেন একের পর এক বাবার গান। প্রেমের গান, "এই বৈশাখে লেখা প্রেমের চিঠি নির্জনে পড়ে নিও, কাঁকন কার বাজে রুমঝুম, নয়ন কার ঘুমে ঘুম"। দেশের গান, "আমার খাতার প্রতি পাতায় প্রতি কবিতায়, তোমার কথা যে অজান্তেই মা লেখা হয়ে যায়"। মরমি গান," মওলা মওলা, এ জনম এ মরণ কেন হয় মওলা জানে, আল্লাহ জানে"। এ গানগুলো পরিবেশনার শেষে বাবা মার বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া চাইলেন সবার কাছে। এমনি সোনার ছেলে রাজা বশির।
রাজা বশির এই একান্ত পরিবেশটাকে যেন অনেক চেনা পরিচিত মনে করেছিলেন তাই খোলা মনেই অনেক একান্ত আপন কথা বলে যাচ্ছিলেন গানের ফাঁকে ফাকে। বিয়ে করেছেন প্রেম করেই। স্ত্রীর নাম রুনা বশির। স্বামীর সাথে গান গান মাঝে মাঝে। কিভাবে তাদের প্রেম এবং বিয়ে হয় সে কথাগুলো বেশ মজা করেই বললেন সবাইকে। গানের কলি দিয়ে শ্রোতাদের মাঝে বসা রুনাকে গান গাওয়ার জন্য আহবান জানালেন রাজা, "আমাকে যদি এত বাস ভালো বল ওগো বল তুমি দুটি কথা বলো গানে গানে"। হাসির রোল পরে গেলো কামরার চার দেয়ালের মাঝে। এরপর শিল্পী জুটি কয়েকটা দ্বৈত সঙ্গীত গাইলেন মনের মাধুরী মিশিয়ে, গাইলেন দ্বৈত কণ্ঠে "আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল" এবং এই পরিচিত গানটির সাথে তাল মিলিয়ে শ্রোতার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গলা মিলালেন। ঘরোয়া পরিবেশ যেন আরও ঘরোয়া আমেজে ঘনীভূত হল।
বশির আহমেদের জন্ম উর্দু ভাষী এক সদাগর পরিবারে এবং গানের হাতে খড়ি হয় উর্দু ভাষাতেই। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান দিল্লিতে সঙ্গীত পিয়াসু বশির আহমেদ এবং তালিম নেন ওস্তাদ বেলায়েত হোসেনের কাছে। পরে তালিম নেন বোম্বেতে প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলির কাছে। অনেক বিখ্যাত গান গেয়েছেন তিনি উর্দু ভাষাতেও। সেগুলো থেকে রাজা বশির পরিবেশন করলেন তালাশ ছবির কয়েকটি বিখ্যাত গান। "কুছ আপনি কহিয়ে কুছ মেরা সুনিয়ে" এর মধ্যে একটি।
রাজা বশির বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেও গান লিখছেন এবং সুর দিচ্ছেন। পুরো সময়টা কাটে এখন গানের ভুবনেই। নিজের লেখা এবং ইমন রাগের সুরে অনেক দরদ দিয়ে গাইলেন, "ফুলের মত ঝরে গেছো জীবনের স্মৃতি থেকে, এই জীবনের মঞ্চে আমাকে রেখে। " এবং "সেই যে কবে ঘর ছেড়েছি আর তো ঘরে ফেরা হলো না"।
গান আর শেষ হয় না স্রোতাদের চাহিদাও শেষ হয় না। পলক মামা আসলেন আবার মান্না দে’র বিখ্যাত গান নিয়ে। "এরি নাম প্রেম" তাঁর প্রতিশ্রুতি উনি রক্ষা করলেন। এবং গাইলেন চমৎকার ভাবে।
শেষ তো হোতেই হবে কোন না কোন সময়। সমবেত ভাবে গাওয়া হল সেই সুবিখ্যাত সাধের লাউ গানটি। "সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী"।
শেষ হলো গানের আসর। থেকে গেল পরম তৃপ্তি আর আনন্দের রেশগুলো। প্রতিটি গানেই তবলা সংযোজনে ছিলেন জনাব রাশেদুল কবির।
রাজা যায় রাজা আসে। পুরোপুরি বাঙ্গালী রাজা বশির। শুধু গানের সুরেই নয়, কথার ঢঙ্গে, পোশাকের রঙে এবং অঙ্গের ভঙ্গিমা দিয়ে জয় করলেন সবার মন। থেকে গেলেন, চলে গেলেন না। রাত যতই গভীর হলো সবার মনের গভীর থেকে গভীরে ঠাঁই নিলেন। বের হতে দিলেন না কেউ। সওদাগরী পরিবারের রাজা কথা দিলেন আবার কখনো সিডনীর কোথাও গানের ডালি ভরা সওদা নিয়ে হাজির হবেন। সবাই আশীর্বাদ করলেন রাজা দম্পতিকে বাবা মায়ের মতই যেন বাংলা গানের রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করতে পারে তারা। সায়রা মির্জা এবং সাইয়েদা ফারহানা'র একনিষ্ঠ সহযোগিতায়, জাফির হোসেন এবং সুরভী ছন্দা'র কুটিরে এই ছন্দময় গানের আয়োজন অনেকদিন মনে থাকবে সবার।
আজাদ আলম, সিডনি
|