পিটার নরম্যান ডে আজাদ আলম
৯ অক্টোবর ছিল পিটার নরম্যান ডে। পঞ্চাশ বছর পর নিজের জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়ায় যথাযথ স্বীকৃতি পেল পিটার। পিটার নরম্যান মারা যান ২০০৬ সালের ৩ অক্টোবর এবং তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় ৯ই অক্টোবর। আমেরিকার ট্রাক অ্যান্ড ফিল্ড ফেডারেশন এই দিবসটি ২০০৬ সাল থেকেই পালন করে আসছেন অতি শ্রদ্ধার সাথে। যুগান্তকারী ঘটনার সৃষ্টিকারী পিটার নরম্যান তার নিজ দেশে সেই শ্রদ্ধা অর্জন করলো এ বছর থেকে।
কি ছিল সেই যুগান্তকারী, গ্রাউন্ড ব্রেকিং ঘটনা?
পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ১৯৬৮ সাল। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট বেশ জোড়ে সোরে চলছে। সিভিল রাইটসের কিংবদন্তি নেতা মার্টিন লুথার কিং আততায়ীর গুলিতে নিহত হন এ বছরের প্রথমার্ধে। সামাজিক বৈষম্যের শিকার কৃষ্ণাঙ্গদের দাবিয়ে রাখতে স্টিম রোলার চলছিল পৃথিবীর প্রায় সব শ্বেতাঙ্গ প্রধান এবং শ্বেতাঙ্গ শাসিত দেশগুলোতে। ভিয়েতনামের যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে কারারুদ্ধ ১৯৬৪ সালের অলিম্পিকে মুষ্টিযুদ্ধ চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী।
অস্ট্রেলিয়ায় হোয়াইট অনলি পলিসিতে সবে মাত্র চিড় ধরেছে। আদিবাসীরা আদম শুমারিতে মাত্র দু’বছর হলো নাম লেখানোর যোগ্যতা পেয়েছে। ভোটাধিকারও পেয়েছে এই বছরই। সাদা আর কৃষ্ণকায় অলিম্পিয়ানরা তখনও এক টয়লেট ব্যবহার করতে পারতো না। একই ওয়াটার ফাউন্টেনে পানি পানের অনুমতিও ছিল না তাদের। এমনি সময়ের ঘটনা। ১৯৬৮ সাল। অলিম্পিক খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে মেক্সিকো শহরে। ২০০ মিটারের দৌড়ে অংশগ্রহণ করছেন পিটার নরম্যান। দৌড়াতে হবে বিশ্ব রেকর্ডধারী টমি স্মিথ এবং তারই সম পর্যায়ের দৌড়বিদ জন কার্লোসের পাশাপাশি। দুজনই আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ এবং লম্বায় ৭ ফিটের কাছাকাছি। পিটার নরম্যান অস্ট্রেলিয়ান, শ্বেতবর্ণের। অপেক্ষাকৃত খর্বাকৃতির। পাঁচ ফিট আট।
২০০ মিটার দৌড়ের বাছাই পর্বে চমক লাগিয়ে দিল পিটার। অলিম্পিক রেকর্ড করলেন তিনি। যদিও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। সেমি ফাইনালের আগেই সে রেকর্ড ভেঙ্গে চুরমার। চলছিল যেন রেকর্ড ভাঙ্গনের প্রতিযোগিতা। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই ২০০ মিটার ফাইনালের সবাই আগের অলিম্পিক রেকর্ড ভঙ্গকারী। রেকর্ড ভেঙ্গেই স্থান করতে পেরেছে সবাই ফাইনাল রেসে দৌড়ানোর জন্য।
খর্বাকৃতির পিটারকে বেশ বেখাপ্পাই লাগছিল এই দৌড়ে। দৌড় শুরু হতে দেড়ি হচ্ছে কারণ এর আগের খেলার পুরষ্কার বিতরণ দেড়ি হচ্ছে। এই ফাঁকে সহজ সরল স্যালভেশন আর্মির ভলান্টিয়ার, ঈশ্বরভক্ত পিটার সবাইকে গুডলাক জানাচ্ছেন আর হ্যান্ডশেক করছেন। বাকিরা যেখানে ফাইনালের টেনশনে সটান সেখানে পিটারের এই আচরণ অনেকের বিরক্তির কারণ হচ্ছিলো।
শুরু হলো দৌড়। পিটার পিছিয়ে পড়েছে বেশ খানিকটা। ১০০ মিটার পার হয়ে গেছে। আর বুঝি মেডেল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। পিটার তার দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ১০০ মিটারের পরই পিটার হলো সবচেয়ে দ্রুতগামী। সবাইকে টপকে সামনে এগুচ্ছে সে। শুধুমাত্র টমিকে টপকাতে পারলো না পিটার। টমি ১৯.৮৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে করল বিশ্ব রেকর্ড। এটাই বিশ্বের কোন মানব সর্বপ্রথম ২০ সেকেন্ডের নিচে অতিক্রম করলো ২০০ মিটার দৌড়ের শেষ সীমানা। পিটারের অবস্থান ২য় । অলিম্পিক সিলভার মেডেল তার। সময় ২০.০৬ সেকেন্ড। জন কার্লোস ৩য়। .০৪ সেকেন্ডে পিছিয়ে পিটারের চেয়ে। অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক প্যান্ডেলে তখন হৈ হৈ কাণ্ড। বিশ্বময় বিস্ময়কর খবর। হোয়াইট ম্যান ক্যান রান!
কিন্তু আরও বড় বিস্ময়, বড় চমক, বড় প্রতীকী বিক্ষোভ অপেক্ষা করছিল বিশ্ববাসীর জন্য।
টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস আগেই ঠিক করে রেখেছিল তাঁরা প্রেজেন্টেশন ডায়াসে অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস এর ব্যাজ পড়বে যদিও তা অলিম্পিয়ানদের জন্য নিয়ম বহির্ভূত প্রদর্শনী। মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ব্ল্যাক পাওয়ারকে স্যালুট জানাবে তারা। এই ভঙ্গিমাতে অলিম্পিক ডায়াসে দাঁড়ানোও দণ্ডনীয় অপরাধ। সব জেনেও বর্ণবাদী আন্দোলনকে জোরদার করাই ছিল জন এবং টমির মূল লক্ষ্য। এই মুভমেন্ট বছর দেড়েক হলো শুরু হয়েছে আমেরিকায় । এই পরিকল্পনার কথা পিটারকে জানালো জন কার্লোস। মানবতাবাদী পিটার কোন বিরূপ ফলাফলের কথা চিন্তা না করেই নির্দ্বিধায় বলে ফেললো, “আই উইল স্ট্যান্ড উইথ ইউ।” জন কার্লোস যদিও পিটারকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেছিল এই বলে, পিটার, “তোমাকে আমাদের সাথে হাত মিলাতে হবে না। এটা নেহায়েত আমাদের কালোদের ব্যাপার। আমাদের সাথে জড়ালে ভবিষ্যতে অনেক খেসারত দিতে হতে পারে।”
কথা মানে নি পিটার। তার অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য অন্য একজন অলিম্পিয়ানের থেকে ধার নিয়ে বুকে লাগিয়েছিল Olympian Projects for Human Rights ( OPHR) ব্যাজ।
স্থান মেক্সিকো শহরের অলিম্পিকের মেডেল প্রেজেন্টেশনের ডায়াস। দাঁড়িয়েছেন ২০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ বিজয়ী তিনজন। Black আমেরিকান টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস। white অস্ট্রেলিয়ান পিটার নরম্যান। মেডেল প্রেজেন্টেশন শেষে টমি স্মিথ আর জন কার্লোস মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে মাথা নিচু করে স্যালুট জানালো কালো তথা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনকে। পিটার নরম্যান নীরবে দাঁড়িয়ে পূর্ণ সমর্থন জানালো তাদের এই স্যালুটকে। এ কথা নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায় মনে মনে তারও অদৃশ্য হাতও মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঁচুতে উঠেছিলো। সবার বুকে জ্বল জ্বল করছিল Olympian Projects for Human Rights এর ( OPHR) ব্যাজ।
শ্বেতবর্ণের পিটার নরম্যান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেললো টমি এবং কার্লসকে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিল বর্ণবৈষম্যের মত ঘৃণ্য মতবাদকে। সৃষ্টি হলো যুগান্তকারী ইতিহাস। “সবার উপড়ে মানুষ সত্য, তাহার উপড়ে নাই।” এই স্লোগান টিই যেন প্রক্ষেপিত হচ্ছিল তাঁদের তিনজনের ডায়াসের দণ্ডায়মান অবস্থান থেকে।
সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গেল। সৃষ্টি হলো এক নতুন অধ্যায়ের। সাদা এবং কালোদের সমন্বয়ে লং মার্চ। কালোদের সাথে সাদাদের মিলিত হাত, প্যারেড, সভা সমিতি সবখানেই ধ্বনিত হচ্ছিল, “I will stand with you”.
সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী তিন দৌড়বিদ, সেই মনুমেন্টাল অ্যাকশনের মাশুল দিয়ে গেছে সারাজীবন। কেউ আর ফিরে আসেনি অলিম্পিক স্কোয়াডে। অলিম্পিক কোড অফ কন্ডাক্ট অমান্য করার দোষে দোষী হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের বৃহত্তম মঞ্চ থেকে।
পিটার ১৯৭২ সালে কোয়ালিফাই করার পরেও অলিম্পিক দলে অন্তর্ভুক্তি পায় নি। হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ান পলিসি তখনও ছিল শক্তিশালী। অলিম্পিক কোড অফ কন্ডাক্ট অমান্য করার লোক দেখানো অজুহাতে বাদ পড়ে গিয়েছিল কোয়ালিফাই করার পরেও। আসলে সিলেক্টররা পিটারের সেই সেদিনের কৃষ্ণ পিরীতির দাদ তুলতেই তাকে বাদের খাতায় রেখেছিল।
এমনকি সিডনীর ২০০০ সালের অলিম্পিকেও অনারারী গেস্ট হিসেবে আপ্যায়ন পত্র পান নি পিটার। যদিও এখন পর্যন্ত সেই বহন করছে ২০০ মিটার দৌড়ের অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড । কোন অস্ট্রেলিয়ানের সামর্থ্য হয়নি ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে পিটারের রেকর্ডকৃত সময়সীমাকে অতিক্রম করার।
সময়ের চাহিদায় অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। অনেক ড্রাকোনিয়ান ল এরও স্থান হয় আস্তাকুড়ে। পরিবর্তন হয় পুরো জাতির মানসিকতার। জয় হয় মানবতার।
গত ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্ট পিটারের প্রতি অন্যায় আচরণের ক্ষমা চাইলেন তাঁর পরিবারের কাছে।
সুদীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী পরে পিটার পেল তার যোগ্য সম্মান। এ বছরই অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম পালিত হলো পিটার নরম্যান ডে। সিদ্ধান্ত হলো মেলবোর্নের ফেডারেশন স্কয়ারে পিটারের আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপিত হবে। পিটার এতদিন পরে স্থান পেল তার যোগ্য আসনে। মানবতার গলায় শোভা পেল জয়ের মালা।
পঞ্চাশ বছর পর গ্লানীমুক্ত হলো অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিকের ইতিহাস।
আজাদ আলম, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|