বোয়িং 747 আকাশের রাণীর রাজকীয় পঞ্চাশ বছর পূর্তি! আজাদ আলম
১৯৬৮ থেকে ২০১৮। পঞ্চাশ বছর জন্ম জয়ন্তী পালিত হলো সেদিন ৩০ শে সেপ্টেম্বর আকাশচারী বিশালকায় উড়োজাহাজটির। ১৯৬৮ তে জন্ম নিলেও বাণিজ্যিক ভাবে যাত্রী নিয়ে আকাশে উড়বার ছাড়পত্র পায় ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে।
২০০৭ সালে এয়ার বাস কোম্পানির দোতলা উড়ো জাহাজ A380 আসার আগে পর্যন্ত বোয়িং 747 ছিল সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী প্লেন। মজার কথা, বড় মাপের মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট তৈরির চিন্তা ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় 747। জাম্বো জেট নামে পরিচিত বোয়িং 747 দূর পাল্লার পরিবহন। পৃথিবীকে ছোটো করে ফেলেছে ঘণ্টায় ৫৫০ মাইল (৮৮৫ কি.মি.) এর বেশি গতি দিয়ে। বেশি যাত্রী বহনের কারণেই সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের ভিতরে চলে এসেছে প্লেন ভ্রমণ।
বর্তমানে, উন্নত মানের ইঞ্জিন আবিষ্কারের কারণে তেলের খরচ কমতে থাকে এবং আরো বেশি বেশি মানুষের সাধ্যের আওতায় আসতে থাকে প্লেনের যাতায়াত। এই বিশাল প্লেনের জন্ম ওয়াশিংটন স্টেটের এভারেট শহরে। জন্ম থেকেই এর নাম হয় জাম্বো জেট। এই জাম্বো জেটের আতুর ঘরের আকার আকৃতিও তেমনি বিশাল। যাকে ছাপিয়ে এখন পর্যন্ত কোন বিল্ডিং তৈরি হয় নি সারা বিশ্বে। ৭৫ টি ফুটবল গ্রাউন্ডের সমন্বিত অথবা ডিজনি ল্যান্ডের আয়তন সমান ঘরে যার জন্ম তাকে নিয়ে সাড়া পৃথিবীর মানুষের বিস্ময়ের এখনো শেষ নেই।
প্রথম 747 তৈরি করতে সময় লেগেছিল মাত্র ১০ মাস। ৫৫,০০০ দক্ষ জনবলের অবিরাম প্রচেষ্টায় এই জাম্বো জেটের প্রথম মোড়ক উন্মোচন হয় ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ তে। সেই থেকে আজ অবধি থেমে থাকে নি তার চমক আর অবিরাম বিশ্ব ভ্রমণ। জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত ১,৫৪৮ টি বিভিন্ন মডেলের 747 তৈরি করা হয়েছে। ২০১৭ সালে সর্বশেষ নতুন যাত্রী বাহি 747 তৈরি হয় এবং সেটা কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান বহরে শোভা পাচ্ছে। কারগো বাহি 747-800 এখনো তৈরি হচ্ছে। সব কিছুরেই শেষ আছে। অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে এ জগত থেকে। 747 এর 100, 200 সিরিজ কে বলা হত ডাইনোসর বোয়িং। সেই পরিবারের প্লেনগুলি এখন লোহালক্কড় এর ভাংরিতে পরিণত হয়েছে; তাদের কিছু কিছু হাড়গোড় এখনো আমেরিকার মোহাবি মরুভূমিতে পাওয়া যেতে পারে। মোহাবি মরুভূমিকে বলা হয় প্লেনের গোরস্তান। সার্ভিস থেকে অবসর নেবার পর বেশির ভাগ প্লেনগুলোকে এখানেই দাফন করা হয়।
অবাক করা কিছু তথ্য
প্রথম জাম্বো প্লেনটির দৈর্ঘ্য ছিল ৬৩.৫ মিটার, পাখার দৈর্ঘ্য ৫৯ মিটার এবং লেজের উচ্চতা ৬ তলা বিল্ডিং এর সমান।
অতিকায় এই জাম্বো জেটটি ৩০ লক্ষ যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি এবং এটা জোড়া লাগেতে ৩০ লক্ষ পেরেক, রিবিট এবং নাট-বল্টু ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে।
ব্যবহৃত ইলেকট্রিকাল তারের পরিমাণ ৩০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সমান।
747 বানাতে ৭৫,০০০ বিভিন্ন ড্রয়িং তৈরি করতে হয়েছিল ড্রাফটসম্যানদের।
১৫,০০০ এর বেশী বার উইন্ড টানেল টেস্টিং করতে হয়েছে প্লেনের পাখার ডিজাইন তৈরি করতে যা প্লেনের উড়বার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্লেনটিকে চূড়ান্ত উড্ডয়ন সার্টিফিকেট পাওয়ার আগে ১০ মাস ধরে ১,৫০০ বার টেস্ট ফ্লাইটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এ পর্যন্ত বোয়িং 747 প্রায় ৭৮ বিলিয়ন (৭,৮০০ কোটি) কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। যা এক লক্ষ বারের বেশী চাঁদে আসা যাওয়ার সমান।
747 এ পর্যন্ত সাড়ে তিন বিলিয়নের (৩৫০ কোটি) বেশি যাত্রী বহন করেছে। ৪ ইঞ্জিনের প্রতিটির পাওয়ার ৬৫,০০০ পাউন্ডের বেশি
তেল নিতে পারে প্রায় ২,৪০,০০০ লিটার।
সর্বোচ্চ টেক অফ ওয়েট ৩৩৩ টন।
টেক অফ স্পিড ঘণ্টায় ১৮০ মাইল (২৮৮ কি.মি.)
ল্যান্ডিং স্পিড ঘণ্টায় ১৬০ মাইল (২৫৬ কি.মি.)
পুরনো মডেলের 747 এর ককপিটে লাইটস, সুইচ, গেজ, ইন্ডিকেটর ইত্যাদির সংখ্যা ছিল প্রায় ১,০০০ এর মত। এখন কম্পিউটারের যুগে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ তে।
বিস্ময়কর এই আবিষ্কারকে ছাপিয়ে নতুন নতুন প্লেনে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে আজকাল। পরিবহণ খরচ কমানোর প্রতিযোগিতায় দুই ইঞ্জিন চালিত প্লেনের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট আকাশের রাণীর কদর তাই কমে যাচ্ছে। চার পাঁচ বছর পর যাত্রী নিয়ে আর কোনদিন আকাশে উড়বে না বোয়িং 747। কিন্তু মানব সভ্যতার আকাশে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে এই “কুইন অফ দি স্কাই”!
আজাদ আলম, বোয়িং 747 প্রকৌশলি, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|